Thank you for trying Sticky AMP!!

সমাবেশে কসরত করছে ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলার চরভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা

চা দোকানি থেকে প্রধান শিক্ষক, গড়লেন দেশসেরা স্কুল

ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলার প্রত্যন্ত একটি গ্রাম! বিয়ের অনুষ্ঠান চলছে। শিশুর দল জটলা পাকিয়ে নিজেদের মধ্যে গল্পগুজবে ব্যস্ত। একজন হঠাৎ নিজের বিদ্যালয়ের বন্দনায় মেতে ওঠে। কান খাড়া করে ওদের কথা শুনছিলেন ঢাকা থেকে নিমন্ত্রণে আসা শিক্ষক রিয়াজুল ইসলাম। শিশুটি বলছিল, ‘আমাদের স্কুলের মতো দেশে আর কোনো স্কুল নেই। আমাদের স্কুল দেশসেরা।’ গোটা দেশে এত এত বিদ্যালয় থাকতে দারিদ্র্যকবলিত প্রত্যন্ত এই গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়টিই দেশসেরা শুনে হকচকিয়ে গেলেন ওই শিক্ষক। ঠিকানা খুঁজে হাজির হলেন সেই বিদ্যালয়ে। এসেই পার্থক্যটা চোখে পড়ল।

দেয়ালঘেরা বিদ্যালয়টির চত্বর যেন সবুজ ঘাসের গালিচা। চারদিক ঝকঝকে, তকতকে। দেয়ালে আঁকা বিভিন্ন প্রাণীর ছবি। বিদ্যালয় ভবনের দেয়ালে আঁকা ফুল, ফল, প্রাণীর ছবি। পাশে ছাবির বাংলা ও ইংরেজি নাম। রয়েছে মনীষীদের বাণী, নানা ছড়া। দেয়াল ঘেঁষে মনোরম পার্ক। টিফিনের সময় শিশুরা সেই পার্কে খেলে, ঘুরে বেড়ায়। আছে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম।

বিদ্যালয়টি হরিপুর উপজেলায়। নাম—চরভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এটি জাতীয়করণ হয় ২০১৩ সালে। মাত্র নয় বছরের মাথায় এসে বিদ্যালয়টি এবার দেশের শ্রেষ্ঠ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্বীকৃতি পেল। ১২ মার্চ ঢাকার ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয় (২০২২ সালের) হিসেবে চরভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের হাতে স্বীকৃতি স্মারক তুলে দেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন।

শুরুর কথা

২০০০ সালের কথা। ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলার বকুয়া ইউনিয়নের বহরমপুর বাজারে এরফান আলী চা-নাশতার দোকান চালাতেন। পাশেই ছিল একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। দিনে দুই-তিনবার চা নিয়ে এরফানকে ওই বিদ্যালয়ে যেতে হতো। এইচএসসি পাস করা এরফানও স্বপ্ন দেখতে লাগলেন শিক্ষকতা করার। ২০০১ সালে ছেলের প্রস্তাব পেয়ে গ্রামে একটি বিদ্যালয় খোলার জন্য ৩৩ শতাংশ জমি দেন এরফানের বাবা নুরুল ইসলাম। শুরু হয় এরফানের লড়াই। চরভিটা গ্রামের জঙ্গলাকীর্ণ ধানখেতের সেই জমি পরিষ্কার করে সেখানে খড়-বাঁশের তিনটি ঘর তৈরি করলেন। ঘরের বেড়ায় ঝুলিয়ে দিলেন চরভিটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাইনবোর্ড। ২০০৮ সালে স্নাতক পাস করেন এরফান। ২০১১ সালে বিদ্যালয়টি পাঠদানের অনুমতি পাওয়ায় উদ্দীপনা দেখা দেয় এরফান ও অন্য শিক্ষকদের মধ্যে। শিক্ষার্থীর সন্ধানে রাত-দিন অভিভাবকদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ান তাঁরা। এতে সফলতাও আসে। বিদ্যালয়টি ২০১৩ সালে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

যেভাবে পরিবর্তন

হরিপুর উপজেলার চরভিটা এলাকাটি দারিদ্র্যপ্রবণ। অধিকাংশই খেটে খাওয়া মানুষ। অভাব-অনটনের কারণে অনেক শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে খুব একটা হাজির হতো না। ২০১৩ সালেও চরভিটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৫০ শিক্ষার্থী ছিল। কিন্তু প্রতিদিন হাজির থাকত ৪০ থেকে ৫০ জন। বিষয়টি নিয়ে ভাবনায় পড়লেন প্রধান শিক্ষক এরফান আলী।
শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়মুখী করা ও ঝরে পড়া রোধের উপায় খুঁজতে থাকেন তিনি। একদিন বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদ, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি ও অভিভাবকদের নিয়ে মতবিনিময় সভা ডাকলেন। বিদ্যালয়ে এসে কোনো শিক্ষার্থীকে যাতে ক্ষুধার্থ থাকতে না হয়, সে জন্য বিদ্যালয়ে মিড ডে মিল (দুপুরের খাবার) চালুর পরিকল্পনার কথা জানালেন। প্রধান শিক্ষকের পরিকল্পনায় সবাই সম্মতি দিলেন। এরপর কাজে নেমে পড়লেন এরফান আলী। বাড়ি বাড়ি গিয়ে সবাইকে তাঁর উদ্যোগের কথা জানালেন। অভিভাবকেরা মুষ্টিচাল দিয়ে উদ্যোগের পাশে থাকার আশ্বাস দিলেন।

দেশ সেরা চরভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভেতরে মনোরম পার্ক

এরফান আলী গ্রামের লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে বিদ্যালয়ে মিড ডে মিল চালু করলেন। প্রতি মাসে এর জন্য ৩০ থেকে ৩৩ হাজার টাকা খরচ লাগে। কিন্তু প্রত্যন্ত এলাকায় মাসে মাসে এত টাকার জোগান নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। এ অবস্থায় স্থায়ী আয়ের কথা ভাবলেন এরফান। এই উদ্যোগ চালু রাখতে বিদ্যালয়ের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি নুরুল ইসলাম নিজের ছয় বিঘার একটি পুকুর ও এক বিঘা জমি সাময়িকভাবে বিদ্যালয়কে ব্যবহার করতে দিলেন।

শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাই মিলে পুকুরে হাঁসপালন, আর দুই বিঘা জমিতে পেঁপে ও সবজি আবাদ শুরু করলেন। যে টাকা আসত, তা চলে যেত মিড ডে মিলের তহবিলে। পাশাপাশি নেওয়া হয় সমাজসেবামূলক নানা উদ্যোগ। মিড ডে মিল চালুর পর থেকে শিক্ষার্থীদের গড় উপস্থিতি বেড়ে দাঁড়ায় ৯৫ শতাংশে। এ নিয়ে ২০১৫ সালের ৭ নভেম্বর ‘সবাই মিলে মিড ডে মিল’ শিরোনামে প্রথম আলোয় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটি নজরে এলে সে বছরের ১৯ নভেম্বর তৎকালীন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান বিদ্যালয়টির মিড ডে মিল কার্যক্রম পরিদর্শনে আসেন। পরিদর্শন শেষে মন্ত্রী বিদ্যালয়ে ব্যক্তিগত তহবিল থেকে দুই লাখ টাকা অনুদান দেন। পাশাপাশি দ্রুত বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণেরও আশ্বাস দেন।

২০১৬ সালে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সমন্বয় সভায় এই বিদ্যালয়ের মিড ডে মিলের মডেলটি আলোচনায় আসে। এরপর অধিদপ্তর থেকে চিঠি দিয়ে দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয়কে চরভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মিড ডে মিলের এ ধারণাকে অনুসরণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়।

বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা জানালেন, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সেই নির্দেশনার পর থেকেই বিদ্যালয়ের পরিবর্তন আসতে শুরু করে। বিদ্যালয়ের মাঠে স্থাপন করা হয় নানা খেলনা। পাশাপাশি গড়ে তোলা হয় পার্কের আদলে অবকাঠামো। শ্রেণিকক্ষে ব্যবস্থা করেন নানা শিক্ষা উপকরণের। চালু করেন মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে পাঠদান। মাইকের মাধ্যমে পরিচালিত হয় সমাবেশ (অ্যাসেম্বলি)।

তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের পরিচিত করে তোলার জন্য এখানে চালু করা হয় একটি কম্পিউটার ল্যাব। তৃতীয় শ্রেণি থেকেই এখানে কম্পিউটার শিক্ষা বাধ্যতামূলক। বিদ্যালয়ে রয়েছে সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা।

শিক্ষক রেহেনা খাতুন বলেন, ‘আমরা রাতে সোলারের (সৌরবিদ্যুৎ) আলোতে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত পাঠদান করি।’

বিদ্যালয়ে একদিন

বিদ্যালয়টি প্রায় দুই একর জমির ওপর। সম্প্রতি সেখানে গিয়ে দেখা গেল, ঘণ্টা বাজতেই শিক্ষার্থীরা যার যার শ্রেণিকক্ষে গিয়ে ঢুকল। যেতে যেতে চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী আবু সালেহ বলল, ‘আমাদের স্কুল অন্য সব স্কুলের চেয়ে অনেক আলাদা। ক্লাসরুমগুলো সাজানো–গোছানো। এখানে খেলনার পাশাপাশি পার্ক আছে। স্কুলে আসলেই আমার মন ভালো হয়ে যায়।’

বিদ্যালয়ের মাঠে প্রধান শিক্ষক এরফান আলীকে ঘিরে উল্লাস করছে চরভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। গত মঙ্গলবার তোলা ছবি

আরেক শিক্ষার্থী মিনারুল হক বলে, ‘আমি এর আগে কখনোই কম্পিউটারে হাত দিইনি। স্কুলে এসে কম্পিউটার চালানো শিখেছি।’

বিদ্যালয়ের কার্যালয়ে দেয়ালে সেঁটে দেওয়া হয়েছে তথ্য বোর্ড। বোর্ড থেকে জানা যায়, বর্তমান ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ২৭৫। আর শিক্ষক আছেন ৫ জন (খণ্ডকালীন শিক্ষক আছেন দুজন)। প্রাক্‌–প্রাথমিকসহ ছয়টি শ্রেণি রয়েছে।

হরিপুর উপজেলার বকুয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু তাহের বলেন, ২০১৩ সালে সরকারীকরণের সময় বিদ্যালয়টির অবকাঠামো ছিল না বললেই চলে। জরাজীর্ণ বেড়ার ঘরে চলত পাঠদান। শিক্ষার্থী হাজিরাও ছিল হতাশাজনক। সেই বিদ্যালয়টি এই কয়েক বছরে দেশের সেরা। সবার সমন্বিত প্রচেষ্টায় এটা সম্ভব হয়েছে।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এরফান আলী জানালেন, নিজের কাজ সব সময় যত্ন নিয়ে করেন তিনি। তাঁর ভাষ্য, ‘আমি আমার পেশাকে নেশা হিসেবে দেখেছি, আমার ডাকে সারা দিয়েছেন এলাকার সুধীজন। তাঁদের সহায়তায় মফস্‌সল এলাকার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে আমরা সেরা করতে পেরেছি।’ তিনি জানান, দেশসেরা স্বীকৃতির পেছনে যে ম্যাজিকটি কাজ করেছে, তা হলো এর পেছনে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি, অভিভাবক, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সমন্বিত প্রচেষ্টা।

চরভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় অন্য বিদ্যালয়গুলোর অনুপ্রেরণা—এমন মন্তব্য করে হরিপুর উপজেলার ভারপ্রাপ্ত শিক্ষা কর্মকর্তা এম এ জাহিদ ইবনে সুলতান প্রথম আলোকে বলেন, ওই বিদ্যালয়ের অনুকরণে উপজেলার প্রতিটি ক্লাস্টারে দুটি বিদ্যালয় গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সেরা বিদ্যালয় নির্বাচনের প্রক্রিয়া কী—জানতে চাইলে এই শিক্ষা কর্মকর্তা জানান, সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্বাচনে কম্পিউটার শিক্ষা, ফুলের বাগান, শৃঙ্খলা, উপকরণ এবং এর যথাযথ ব্যবহার, ছাত্রছাত্রী উপস্থিতির হার, ফলাফল, স্যানিটারি ল্যাট্রিন ব্যবহার, নাচ-গানসহ ১৫টি ক্যাটাগরিতে একটি বিদ্যালয়কে মূল্যায়ন করে সরকার। সেরা বিদ্যালয় নির্বাচনের প্রায় সব কটি ধাপে উত্তীর্ণ হয়েছে চরভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। জেলা-উপজেলার বিভিন্ন দপ্তর থেকে গোপনে এই মূল্যায়ন করা হয়। এভাবেই প্রথমে জেলায়, পরে বিভাগীয় এবং সবশেষে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয় হিসেবে মনোনয়ন পায় চরভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেরা বিদ্যালয় নির্বাচন করে থাকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা খন্দকার মুনছুর রহমান বলেন, জেলার প্রত্যন্ত এলাকায় বছর কয়েক আগে সরকারি হওয়া একটি বিদ্যালয় যে দেশসেরা হতে পারে, ওই বিদ্যালয়টি তার প্রমাণ।