Thank you for trying Sticky AMP!!

চিংড়ি দেখে উৎফুল্ল সবাই। বাগদা চিংড়ি তুলে দেখাচ্ছেন এক শ্রমিক। সম্প্রতি খুলনার ডুমুরিয়ার হাসানপুর গ্রামে জোয়ার্দ্দার মৎস্য খামারে

লোনাপানির বাগদা মিঠাপানিতে চাষ

উপকূলের লোনাপানি বাগদা চিংড়ির আধার। হেক্টরের পর হেক্টর জমিতে লোনাপানি তুলে চিংড়ি চাষ করেন চাষিরা। বাগদা চিংড়ি আর লোনাপানি যেন একসূত্রে গাঁথা। আজন্ম লোকে তা–ই জানে। এবার সেই সূত্রে খানিকটা ছেদ পড়েছে। স্থানীয় এক চাষি লোনাপানির বদলে মিঠাপানিতে বাগদা চাষ করেছেন।

মিঠাপানিতে বাগদা চাষ করে সাফল্য পাওয়া এই চাষির বাড়ি খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার হাসানপুর গ্রামে। নাম মো. তবিবুর রহমান জোয়ার্দ্দার (৪৬)। নিজের আগ্রহ, চেষ্টা, অভিজ্ঞতা ও নিরলস পরিশ্রমের গুণে এমন সাফল্য পেয়েছেন তিনি। শুধু কি বাগদা! একই পুকুরে তিনি একসঙ্গে মাছ চাষও করছেন। গলদা চিংড়ির চাষও চলছে। মাছ, চিংড়ির পর পানি সেচে ওই জমিতে ধান চাষ করছেন।

মৎস্য কর্মকর্তারা বলছেন, এই পদ্ধতির চিংড়ি চাষের শুরুতে পোনাকে ১৫-২০ দিন নিয়ন্ত্রিত লবণাক্ত পানিতে (৫-৭ পিপিটি) রাখা হয়। পরে লবণমুক্ত মিষ্টি পানির পুকুরে এনে চাষ করা হয়। লোনাপানির বাগদা ও মিঠাপানির বাগদার স্বাদ একই, কোনোভাবেই আলাদা করা যাবে না। মিঠা ও লোনা—দুই ধরনের পানিতে চিংড়ির বৃদ্ধির হারও প্রায় একই ধরনের।

প্রকৃতি ধ্বংস করে জমিতে লোনাপানি তুলে বাগদা চাষ করতে হয়। সে ক্ষেত্রে মিঠাপানিতে বাগদা চাষের সাফল্য প্রকৃতি সংরক্ষণে বড় ভূমিকা রাখতে পারবে। দিন দিন বাগদা চাষের জমি কমে যাওয়ায় উৎপাদনও অনেক কমে গেছে, কমে গেছে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনও
খুলনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জয়দেব পাল

তিন বছর ধরে নিজের এক একরের মিঠাপানির পুকুরে বাগদা চাষ করছেন তবিবুর। নিজের অভিজ্ঞতার পাশাপাশি সাহায্য নিয়েছেন মৎস্য কর্মকর্তাদের। তবে তিন বছরের মধ্যে এবারই সবচেয়ে বেশি সাফল্য পেয়েছেন। ওই পুকুর থেকে চিংড়ি পেয়েছেন প্রায় ৮০ মণ। প্রতি শতকে প্রায় ৩২ কেজির মতো বাগদা পেয়েছেন। ১২০ দিনে বাগদার গড় ওজন হয়েছে প্রায় ৫০ গ্রাম। খরচের প্রায় দ্বিগুণ লাভ হয়েছে তাঁর। চেষ্টা করলে শতকপ্রতি এক মণ পর্যন্ত বাগদা উৎপাদন করা সম্ভব বলে মনে করেন এই চাষি।

মিঠাপানিতে বাগদা চিংড়ি চাষ করে সফল তবিবুর রহমান। সম্প্রতি খুলনার ডুমুরিয়ার হাসানপুর গ্রামে

মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে চিংড়ি চাষ করা জমির পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৬২ হাজার ৯৮০ হেক্টর। সেখান থেকে চিংড়ি (বাগদা, গলদা, হরিণা) উৎপাদন হয়েছে ২ লাখ ৮৭ হাজার ৪৯৭ মেট্রিক টন। ওই বছর বিদেশে রপ্তানি করা হয়েছে ৩০ হাজার ৫৭১ মেট্রিক টন। রপ্তানির প্রায় ৮০ শতাংশই বাগদা, যা সম্পূর্ণ লোনাপানিতে উৎপাদন হয়।

Also Read: নোনা পানির চিংড়ি চাষ হচ্ছে মিঠা পানিতে

মিঠাপানিতে বাগদা চাষকে আশাজাগানিয়া বলছেন খুলনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জয়দেব পাল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রকৃতি ধ্বংস করে জমিতে লোনাপানি তুলে বাগদা চাষ করতে হয়। সে ক্ষেত্রে মিঠাপানিতে বাগদা চাষের সাফল্য প্রকৃতি সংরক্ষণে বড় ভূমিকা রাখতে পারবে। দিন দিন বাগদা চাষের জমি কমে যাওয়ায় উৎপাদনও অনেক কমে গেছে, কমে গেছে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনও।

বাগদা তুলে পুকুরে গলদা ছেড়ে দেবেন। সঙ্গে মাছ চাষও চলবে। নভেম্বর পর্যন্ত গলদা চাষ করে পুকুর শুকিয়ে ফেলবেন। এরপর সেখানে ব্রি ধান চাষ করবেন। মার্চের মধ্যে ধান কেটে পুকুর পুরোপুরি শুকিয়ে ফেলে সেখানে আবারও বাগদা চাষের প্রস্তুতি নেবেন।

পরীক্ষা–নিরীক্ষা শুরু

একসময় হাসানপুর গ্রামের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হতো হামকুড়া নদী। এখন সেই নদী আর নেই। নদী শুকিয়ে যাওয়ায় পুকুরে লোনাপানি তুলতে পারেন না চাষিরা। বাগদার চাষও গেছে কমে। তবিবুর তখন ভিন্ন পথে হাঁটলেন।

সে ২০১৯ সালের কথা। মিঠাপানির পুকুরে গলদা চিংড়ির সঙ্গে দুই হাজার বাগদার পোনা ছাড়লেন তবিবুর। ছাড়ার আগে ১৫-২০ দিন সেগুলোকে লোনাপানি ও মিঠাপানিতে বেঁচে থাকার উপযোগী করে তুললেন। অন্য একটি পুকুরে পলিথিন দিয়ে ছোট হাউসের মতো বানিয়ে তাতে বাজারের লবণ ব্যবহার করে পানি নোনা করলেন। ওই বছর ১৫০ থেকে ২০০টির মতো বাগদা পেলেন তবিবুর। এতে উৎসাহ বেড়ে যায় তাঁর। পরের বছর গলদার পাশাপাশি ২০ হাজার বাগদার পোনা পুকুরে ছাড়েন। চার মাস পর পান ৮-৯ হাজার বাগদা।

লবণাক্ত মাটির ‘সোনা’ পাকচোং ঘাস
অনেকের টাকা, একার শ্রমে কোটি টাকার খামার
গরিবের ‘ডাক্তার আপা’

এরপর ২০২১ সালে গলদা বাদ দিয়ে সরাসরি বাগদা চাষের প্রস্তুতি নেন। পুকুর প্রস্তুত করে ৫০ হাজার পোনা ছাড়েন। বেঁচে যায় প্রায় ৩২ হাজারের মতো বাগদা। ২০২২ সালে প্রথমবার ৫০ হাজার পোনা ছেড়ে ২৭ মণ বাগদা পান। ওই বছর দ্বিতীয়বার আড়াই লাখ পোনা দিয়ে চাষ করতে গিয়ে বিপাকে পড়েন। অ্যারোটর যন্ত্র (অক্সিজেন বাড়ানোর কাজে ব্যবহৃত ঘূর্ণন যন্ত্র) নষ্ট হয়ে বাগদা মারা যায়। প্রায় পাঁচ লাখ টাকা লোকসানে পড়েন তিনি। তবে এবার ওই পুকুরে ৮০ হাজার পোনা দিয়ে প্রায় ৮০ মণের মতো বাগদা চিংড়ি পেয়েছেন।

Also Read: এবার জিআই সনদ পেল বাগদা চিংড়ি

চিংড়ি–মাছ–ধান চাষ

মিঠাপানির পুকুরে চিংড়ির খাবার দিলে পানিতে এক ধরনের সবুজ প্ল্যাঙ্কটন তৈরি হয়। ওই প্ল্যাঙ্কটন বাগদার জন্য ক্ষতিকর। মৎস্য কর্মকর্তাদের পরামর্শে সেই প্ল্যাঙ্কটন খেয়ে ফেলতে রুই, কাতলাসহ অন্যান্য মাছ ছাড়লেন তবিবুর। এতে বাগদা চিংড়ির আর কোনো ক্ষতি হয়নি।

বাগদা তুলে পুকুরে গলদা ছেড়ে দেবেন। সঙ্গে মাছ চাষও চলবে। নভেম্বর পর্যন্ত গলদা চাষ করে পুকুর শুকিয়ে ফেলবেন। এরপর সেখানে ব্রি ধান চাষ করবেন। মার্চের মধ্যে ধান কেটে পুকুর পুরোপুরি শুকিয়ে ফেলে সেখানে আবারও বাগদা চাষের প্রস্তুতি নেবেন।

বাগদা চিংড়ির খাবারদাবারেও ভিন্নতা আছে, বললেন তবিবুর। লবণমিশ্রিত খাবার দিতে হয় এদের। দিনে তিনবার খাবার দেন। এর মধ্যে দুবার লবণমিশ্রিত খাবার, আরেক বেলা সাধারণ খাবার দেন।

পুকুরে গিয়ে দেখা যায়, জনা পঞ্চাশেক শ্রমিক কাজ করছেন। কেউ জাল টানছেন, কেউ চিংড়ি তুলছেন। আবার কেউ চিংড়িভরা প্লাস্টিকের ক্যারেট মাথায় নিয়ে পাকা সড়কের দিকে যাচ্ছেন।
পুকুর থেকে তোলার পর বাগদা চিংড়ি এনে একত্রিত করা হচ্ছে

চিংড়ি ধরার দিন

গত ২৬ আগস্ট পুকুর থেকে বাগদা সংগ্রহের আয়োজন করেন তবিবুর। সেদিন তাঁর জোয়ার্দ্দার মৎস্য খামারে গিয়ে দেখা যায়, ওই গ্রামের পাকা সড়ক যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে একটি পিকআপ। পিকআপে থরে থরে সাজানো ক্যারেট। চিংড়ি নেওয়ার জন্য সেগুলো আনা হয়েছে। পিকআপের পাশের একটি জায়গায় ত্রিপল বিছিয়ে চিংড়ি রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখান থেকে খানিকটা ভেতরের দিকে খামার।

Also Read: মিঠাপানির বাগদা

পুকুরে গিয়ে দেখা যায়, জনা পঞ্চাশেক শ্রমিক কাজ করছেন। কেউ জাল টানছেন, কেউ চিংড়ি তুলছেন। আবার কেউ চিংড়িভরা প্লাস্টিকের ক্যারেট মাথায় নিয়ে পাকা সড়কের দিকে যাচ্ছেন। পুকুরের দক্ষিণ-পূর্ব পাশে তখনো দুটি অ্যারোটর যন্ত্র চলছে। জালে লাফাচ্ছে রুই-কাতলা। একেকটির ওজন কমপক্ষে দেড় কেজি। আর বাগদা তোলা হলো ৫৫ মণ।

মিঠাপানির চিংড়ি সংগ্রহের কথা শুনে সেদিন তবিবুরের খামারে এসেছিলেন ডুমুরিয়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আবুবকর সিদ্দিক। রিফ্রেক্টো মিটার দিয়ে সেদিন পুকুরের পানিতে লবণ পরীক্ষা করেন ওই কর্মকর্তা। তাতে লবণের মাত্রা শূন্য পিপিটি পাওয়া গেল।

রক্ষা পাবে প্রকৃতি

বাগেরহাটের চিংড়ি গবেষণা কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এইচ এম রাকিবুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণ বাগদা ৫ থেকে ১৮ পিপিটি (১ হাজার মিলিগ্রাম পানির মধ্যে ১৮ মিলিগ্রাম লবণ রয়েছে) পানিতে বাগদা চিংড়ি চাষ করা হয়। সে ক্ষেত্রে একেবারে শূন্য পিপিটিতে যদি বাগদা চাষ করা যায়, তাহলে সেটা সবার জন্যই ভালো। প্রকৃতিও লবণাক্ততার হাত থেকে রক্ষা পাবে।

গত ২৬ আগস্ট চিংড়ি ধরার দিন তবিবুর রহমানের খামারে গিয়েছিলেন অভিজিৎ বিশ্বাস নামের আরেক মৎস্য খামারি। ভান্ডারপাড়া ইউনিয়নের কানাইডাঙ্গা গ্রামে তাঁর একটি লোনাপানির বাগদা উৎপাদনের খামার রয়েছে। মিঠাপানিতে যে এভাবে বাগদা হতে পারে, তা দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন তিনি।

অভিজিৎ বলেন, ‘মিঠাপানিতে যে এত ভালো বাগদা হতে পারে, তা আগে কখনো কল্পনাও করিনি। আগামী বছর থেকে আমিও ওই পদ্ধতি অবলম্বনের চেষ্টা করব।’