Thank you for trying Sticky AMP!!

‘সেই যে ঘর ছাইড়ে শহরে আইলাম, আর বাড়ি যাতি পারলাম না’

খুলনা নগরের দোলখোলা শীতলা বাড়ি মন্দিরের প্রধান ফটকের সামনে বহুকাল ধরে পাপড় বিক্রি করেন বারিক খাঁ

সামনে রাখা মাটির চুলায় গনগনে আগুন। চুলার ওপর বসানো লোহার কড়াইয়ে তেতে ওঠা তেলের মধ্যে ফেলা হচ্ছে রোদে শুকানো পাঁপড়। তেলের মধ্যে পড়ে মুহূর্তেই মুচমুচে হয়ে যাচ্ছে সেগুলো। পাশে রাখা বাঁশের ছোট ঝুড়িতে তেল ঝরিয়ে মুড়মুড়ে সেসব পাঁপড় পলিথিনে মুড়ে রাখছেন বারিক খাঁ।

খুলনা শীতলাবাড়ি মন্দিরের প্রধান ফটকের পাশে দীর্ঘকাল ধরে পাঁপড় বিক্রি করেন বারিক খাঁ। তবে সেই দীর্ঘ সময়টা ঠিক কত বছর, তা বলতে পারেন না তিনি। যেমনটা পারলেন না নিজের বয়স জানাতে। বয়স কত হয়েছে জানতে চাইলে বারিক খাঁ একটু হেসে দেন। মোটা গোঁফের নিচের সেই হাসিতেই বোঝা গেল সময়ের হিসাব রাখাটাকে অত বেশি ধার ধারেন না। আপন মনে কড়াই থেকে পাঁপড় তুলতে তুলতে বললেন, ‘বয়স তা ধরেন ৫০ থেকে ৫৫ বছর হবে। একটু কম বেশি হতে পারে। অত হিসাব তো আর মনে নেই। আর সঠিক হিসাব রাইখে লাভই–বা কী?’

আলাপে আলাপে জানা গেল, দিন–তারিখ সঠিক মনে না থাকলেও বারিক খুলনা শহরে এসেছেন অনেক বছর আগেই। যেখানটায় বসে তিনি পাঁপড় বিক্রি করেন, তার ঠিক বিপরীত পাশে ২৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের অফিস। তিনি যখন এখানে পাঁপড় বিক্রি শুরু করেন, তখন বর্তমানের অফিস ভবনটি টিনের ঘর ছিল। বারিকের কাছ থেকে তখন এক টাকা দিলে চারটি পাঁপড় মিলত।

বারিক খাঁদের বাড়ি ছিল পাইকগাছা উপজেলার সোলাদানা গ্রামে। এলাকায় বেড়িবাঁধের ভাঙনে দিশেহারা হয়ে তাঁরা বাবা চলে যান যশোরের কেশবপুর উপজেলার বুড়ুলী গ্রামে। বারিকের জন্ম সেখানেই। ছোটবেলাতেই মাকে হারান বারিক। চার ভাইবোনের সংসারে স্বাচ্ছন্দ্য ছিল না। খুলনা শহরের সাবেহের কবরখানা এলাকার একজন ধনী লোকের শ্বশুরবাড়ি ছিল বারিকদের গ্রাম বুড়ুলীতে। তিনিই তাঁকে খুলনা শহরে আনেন।

শহরে আসার দিনক্ষণও মনে রাখতে পারেননি বারিক। বললেন, ‘শহরে যখন আসি, তখন হাফপ্যান্ট পরি। বাড়ি থেকে আসতে ডুমুরিয়ার হামকুড়া নদীতে তখন ব্রিজ ছিল না; ফেরি চলত। শহরে আমাকে যে এনেছিল, তার বাড়ির অনেকগুলো গরু দেখাশোনা করতাম। বছরখানেক পর রাগারাগি করে সেখান থেকে বের হয়ে আসি। এরপর পাশের একটা দোকানে কাজ করতাম। সেই দোকান মালিকের বাড়ি ছিল ফকিরহাটের শুভদিয়া দেয়াপাড়া গ্রামে। শহর থেকে সেখানে গিয়ে ঘের দেখাশোনার কাজ নিই। ওখানে ছিলাম কয়েক বছর। এরপর আবার ফিরে এলাম শহরে। আসলে ঘের পাহারা দেওয়া ঝামেলার ছিল। ঘেরে চুরি–ছ্যাঁচড়ামি হয়, খুব রিস্ক থাকে।’

শহরে ফেরার পর বারিক রিকশা চালানো শুরু করেন। থাকার জায়গা না থাকায় সুবিধামতো যেকোনো জায়গায় রাত কাটাতেন। ক্রেতাদের পাঁপড় দিচ্ছেন বারিক খাঁ, পাশাপাশি আলাপ চলছে। বারিক বললেন, ‘ফকিরহাট থাইকে শহরে আইসে তখন থাকার জায়গা নাই। এসে ফুটপাতে হ্যানে-হোনে থাকতাম। পরে একটা রুটির দোকানে রাতে থাকতাম। সেই দোকানদার বিয়েশাদি দিয়ে দিল। বিয়ের পর বাসা ভাড়া করি। রিকশা চালানোর পাশাপাশি নারকেলগাছ থেকে ডাব পাড়া, বিভিন্ন গাছ পরিষ্কার আর যখন যা পেতাম, তা–ই করেই চলত।’

এখনো রিকশা চালান বারিক। নিজের রিকশা হয়েছে। আর বিকেল থেকে রাত সাড়ে ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত পাঁপড় বিক্রি করেন। বরিক বলেন, ‘রিকশা চালানোর শুরুর সময় শহরের নানা জায়গায় পাঁপড় ভাজা দেখতাম, খেতাম। একসময় তালতলা মন্দিরের ওখানে দুর্গাপূজার সময় পাঁপড় বিক্রি করতাম, শহরে ছোটখাটো মেলায় পাঁপড় নিয়ে যেতাম। সেটাই এখন ধরা যায় মূল পেশা। শুধু রোজার মাস বাদ দিয়ে বারো মাস এখানেই বসি। অনুষ্ঠানের জন্যও আমার কাছ থেকে অনেকে পাঁপড় নিয়ে যায়।’

চার আনা (২৫ পয়সা) পিস হিসেবে বিক্রি শুরু করেছিলেন বারিক। এখন সেই পাঁপড় ৫ টাকা পিস বিক্রি হচ্ছে। প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৬০০ টাকার বিক্রি হয়। অর্ধেকের বেশি লাভ থাকে তাতে। ফুলতলা গিয়ে রোদে শুকানো পাঁপড় অর্ডার দিয়ে আসেন বারিক। সময়মতো বড় বাজারে মাল নামিয়ে দিয়ে যান পাঁপড়ের কারিগরেরা।

স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে শহরের ভাড়া বাসায় থাকেন বারিক। আর্থিক টানাপোড়েন এখন খানিকটা কমেছে তাঁর। তবে জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় বেশ হিসাব কষে চলতে হচ্ছে বারিকের। বারিক বললেন, ‘কয়েক মাস আগেও ১০ কেজি পাঁপড়ের দাম ছিল ৯০০ টাকা। এখন একই পরিমাণ কিনতে হচ্ছে ১ হাজার ২০০ টাকায়। সব জিনিসের দাম বাড়ছে। মাছ, মাংস, তেল খাওয়া কমানো লাগছে। যে জিনিসের দাম বেশি বেড়েছে, সেটা কম কিনছি।’

গ্রামে যাওয়া পড়ে কিনা জানতে চাইলে বারিক বলেন, ‘যাতি তো ইচ্ছে করে, তারপরও যাওয়া হয় না। হয়তো বছরে এক দিন ঘুরে আসি।’ কথাটা শেষ করে কিছুটা আনমনা হয়ে কয়েক মুহূর্ত থেমে গিয়ে বারিক তাঁর ফেলে আসা সময় আর যেন দেখতে পাওয়া ভবিষ্যতের কথাটা এক নিশ্বাসে বলে ফেললেন, ‘সেই যে ঘর ছাইড়ে শহরে আইসলাম, খুলনায় থাইকে গেলাম আর বাড়ি যাতি পারলাম না। এই শহরেই বোধ হয় জীবনডা কাটাইনে লাগবে।’