Thank you for trying Sticky AMP!!

রূপপুর: জঙ্গলময় গ্রামটি এখন আলোঝলমলে রূপের শহর

১৯১৫ সালে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ চালুর মধ্য দিয়ে বদলের শুরু হয় পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার রূপপুর গ্রামের। নিভৃত পল্লিতে বাড়তে থাকে মানুষের আনাগোনা। শতবর্ষ পরে এসে রূপপুর আর গ্রাম নেই। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য সেখানে তৈরি হয়েছে বড় বড় ভবন। দেশি-বিদেশি নাগরিকদের পদচারণে নিভৃত গ্রামটি রূপ নিয়েছে ছোট্ট এক শহরে।

শরতের শুভ্র কাশফুলের পেছনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে আধুনিক বহুতল ভবন। যেখানে বসবাস করেন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে কর্মরত দেশি-বিদেশি ব্যক্তিরা। গতকাল বুধবার পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশী পেপার মিল এলাকায়

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ব্রিটিশ আমলে পুরো এলাকা ছিল জঙ্গলময়। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ তৈরির মধ্য দিয়ে রূপপুর গ্রামটির পরিবর্তন শুরু করেছিল ব্রিটিশরা। দক্ষিণের সঙ্গে উত্তরের যোগাযোগ সৃষ্টি করতে তৈরি করেছিল রেললাইনসহ বিভিন্ন স্থাপনা। পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পকে কেন্দ্র করে ব্রিটিশদের গড়া গ্রামটি এখন রুশদের (রাশিয়ান) পদচারণে মুখর হয়ে উঠেছে। তৈরি হয়েছে নতুন নতুন ইমারত, হাসপাতাল, রিসোর্ট, বিনোদনকেন্দ্র, বিপণিবিতানসহ নানা স্থাপনা। যে বদলের ছোঁয়া লাগছে জেলাব্যাপী। কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে বহু মানুষের।

Also Read: রূপপুরে পারমাণবিক জ্বালানি হস্তান্তর আজ

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি ‘ফ্রেশ নিউক্লিয়াস’ ফুয়েল বা ইউরেনিয়াম গত শুক্রবার প্রকল্প এলাকায় পৌঁছেছে। আজ আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর অনুষ্ঠান উদ্বোধন করা হবে। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের অনলাইনে যোগ দেওয়ার কথা রয়েছে।

বিস্তীর্ণ কৃষিজমিতে চলছে চাষাবাদ। পেছনে দেখা যাচ্ছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কুলিং টাওয়ার। গতকাল বুধবার পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশী এলাকায়

এ উপলক্ষে রূপপুরে প্রকল্প এলাকায় এখন সাজ সাজ রব। প্রকল্পের আবাসিক এলাকা ‘গ্রিন সিটি’র সীমানা প্রাচীরে দৃষ্টিনন্দন গ্রাফিতি আঁকা হয়েছে। গ্রাফিতিতে রাশিয়ান ও বাংলাদেশিদের বন্ধুত্বে বদলে যাওয়া এক জনপদের গল্প ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। শোভা পাচ্ছে দেশীয় সংস্কৃতি, বাংলাদেশ-রাশিয়ার সম্পর্ক এবং বিভিন্ন শিক্ষণীয় বিষয়। আছে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ, রূপপুর প্রকল্পের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ, ভালোবাসার রূপপুর, ঐতিহ্যবাহী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, লালন শাহ সেতু, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অর্জনসহ নানা অঙ্কন। ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বাংলাদেশের ফুল, পাখি, সূর্য ও আবহমান বাংলার নানা সংস্কৃতি। দৃষ্টিনন্দন এই দেয়ালে নিজেকে ফ্রেমবন্দী করতে ছুটছেন অনেকে। অন্যদিকে প্রকল্প এলাকা সাজানো হয়েছে রাশিয়া-বাংলাদেশ দুই দেশের পতাকা ও বিভিন্ন ফেস্টুন-ব্যানারে। সব মিলিয়ে রূপপুরজুড়ে প্রকল্পে কর্মরত দেশি-বিদেশি শ্রমিক ও স্থানীয় লোকজনের মধ্যে আনন্দের বন্যা বইছে।

Also Read: ব্রিটিশদের শহরে রুশদের দাপট

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মূল প্রকল্পটি হচ্ছে পদ্মা নদীর তীরঘেঁষা রূপপুর গ্রামে। প্রকল্পের আবাসিক এলাকা ‘গ্রিন সিটি’ নির্মাণ করা হয়েছে পার্শ্ববর্তী দিয়াড় সাহাপুর গ্রামে। সাত বছর আগেও দিয়াড় সাহাপুর গ্রামে কোনো উঁচু ভবন ছিল না। ব্রিটিশ আমলে পুরো রূপপুর জঙ্গলময় থাকার কারণে দিনের আলোয় মানুষ চলতে ভয় পেত। প্রথম ব্রিটিশরাই এলাকাটি পরিষ্কার করেছিল। এরপর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প দিনে দিনে রূপপুর গ্রামকে শহরে পরিণত করেছে। বদলে দিয়েছে গ্রামের দৃশ্যপট।

মহাসড়ক ধরে পাবনা থেকে কুষ্টিয়ার দিকে যেতে বাঁয়ে চরসাহাপুর, ডানে দিয়াড় সাহাপুর। দুই পাশে তাকালে চোখে পড়ে বদলের চিত্র। বাঁ দিকে লিচুবাগান আর গ্রামীণ কাঁচা-পাকা বাড়ি। ডানে বড় বড় ইমারত। মহাসড়ক থেকে ঢালু রাস্তা ধরে নামলেই দিয়াড় সাহাপুর গ্রাম। ছোট রাস্তার পাশেই ‘নতুন হাট’ নামে ছোট একটি বাজার। শাকসবজি, ফলমূল, মাছ-মাংস নিয়ে বাজারে বসেছেন ক্রেতারা। শত শত রাশিয়ান ঘুরে বেড়াচ্ছেন বাজারে। মনে হয়, রাশিয়ার কোনো শহরে বাঙালিরা পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন। বাজারটির চারপাশে সেলুন, রেস্টুরেন্ট, সুপারশপ, ক্যাফে, ক্লাবসহ আধুনিক সব দোকান। রাশিয়ান ভাষায় নাম দেওয়া হয়েছে এসব দোকানের।

বাজারে কেনাকাটা করছেন রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পে কর্মরত বিদেশি নাগরিকেরা। পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার নতুন হাট গ্রিন সিটি এলাকায়

প্রকল্পের শ্রমিক ও ঈশ্বরদীর পশ্চিম টেংরি গ্রামের রিপন আলী বলেন, ‘রূপপুর প্রকল্প আমাদের জীবন বদলে দিয়েছে। বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি দিয়েছে। আমার মতো বহু যুবক বেকারত্ব থেকে জীবিকার সন্ধান পেয়েছে।’ সাহাপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৬ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য আরিফুল ইসলামের মতে, ব্রিটিশরা রেললাইন তৈরির পর ঈশ্বরদীতে আর তেমন কোনো উন্নয়ন ছিল না। রূপপুর প্রকল্প সেই উন্নয়নের দ্বার উন্মোচন করেছে।

Also Read: রুশ-বাংলাদেশিদের বন্ধুত্বে বদলে যাওয়া এক জনপদ

বর্তমানে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার রাশিয়ান নাগরিকের পদচারণে মুখর থাকছে পুরো এলাকা। তাঁদের জন্য বড় বড় ইমারত যেমন তৈরি হয়েছে, তেমন বিপণিবিতান, হোটেল, রেস্তোরাঁ, রিসোর্ট, হাসপাতাল ও বিনোদনকেন্দ্র হয়েছে দিয়াড় সাহাপুর গ্রামে। রাশিয়ানদের চাহিদা বিবেচনায় আশপাশের বিভিন্ন গ্রামে হচ্ছে হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁ। এসব প্রতিষ্ঠানের নাম দেওয়া হয়েছে রাশিয়ার বিভিন্ন নামের সঙ্গে মিল রেখে। বদলের এই হাতছানি পড়েছে পুরো জেলায়। রাশিয়ানদের চাহিদার কথা বিবেচনা করে ঈশ্বরদীতে নতুন করে ৩টি রিসোর্ট, ৮টি রেস্তোরাঁ, ১৫টি বেসরকারি হাসপাতাল, ৫টি সুপারমল তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে জেলা সদরে একটি হাসপাতাল, দুটি রিসোর্ট এবং নতুন করে অন্তত পাঁচটি রেস্টুরেন্ট হয়েছে। অন্যদিকে রূপপুর প্রকল্পে কর্মস্থান তৈরি হয়েছে জেলার প্রায় ১৫ হাজার মানুষের। ফলে ব্যক্তি উন্নয়নের পাশাপাশি জেলাব্যাপী সার্বিক উন্নয়ন শুরু হয়েছে।

পাকশী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. সাইফুজ্জামান বলেন, রূপপুর প্রকল্প আশপাশের কয়েকটি গ্রাম বদলে দিয়েছে। শত শত মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করেছে। বহু বাড়িতে বিল্ডিং উঠেছে। ইউরেনিয়াম হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে এসব অর্জন পূর্ণতা পেতে যাচ্ছে। সবাই খুব আনন্দিত।

উৎসবের আমেজে সেজেছে রূপপুর এলাকা। গ্রিন সিটির দেয়ালজুড়ে আঁকা হয়েছে ছবি

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক শৌকত আকবর বলেন, রূপপুরে জ্বালানি পৌঁছানোর মধ্য দিয়ে প্রকল্পটি পূর্ণতা লাভ করেছে। জ্বালানি হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ পারমাণবিক শক্তির মালিক হবে। নির্মাণ প্রকল্পটি পারমাণবিক স্থাপনায় উন্নীত হবে।

শৌকত আকবর আরও বলেন, ‘নির্মাণকাজটি সম্পূর্ণ করার জন্য আমাদের যে সক্ষমতা অর্জন করা প্রয়োজন, জ্বালানি সংরক্ষণ ও ভৌত সুরক্ষার জন্য যে নিরাপত্তা প্রয়োজন, এর সব সক্ষমতা আমরা অর্জন করেছি। পারমাণবিক কেন্দ্র পরিচালনার জন্য আমরা দক্ষ জনবল তৈরি করেছি। আমরা সব দিক থেকে প্রস্তুত হয়েছি। এই সার্বিক সক্ষমতা অর্জন আমাদের সবার জন্য গর্বের। দেশের জন্য গর্বের।’

Also Read: রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে সাজ সাজ রব, দেখুন ছবিতে