Thank you for trying Sticky AMP!!

ময়মনসিংহ নগরের চর কালীবাড়িতে অবস্থিত সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের স্কুল ঘাসফুল শিশুনিকেতন

স্বপ্ন বুননের কারখানা ‘ঘাসফুল’

চরকালীবাড়ি এলাকায় ভাড়া করা দুটি টিনের ঘরে চলে ঘাসফুল স্কুলের কার্যক্রম। দুটি পালায় মোট ১৪৭ জন শিশু সেখানে পড়াশোনা করছে।

ময়মনসিংহ শহরতলির চর কালীবাড়ি এলাকায় ছোট একটি ভাড়াবাড়িতে বসবাস করেন রবিলা খাতুন। ১২ বছর আগে তাঁর স্বামী মারা যান। এরপর তিনি চার সন্তান নিয়ে বিপাকে পড়েন। অন্যের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ নেন। দুটি ছেলেকে দেন দোকানের কর্মচারীর কাজে। অভাবের সংসারে সন্তানদের পড়াশোনার কথা কখনো মাথায় আসেনি রবিলা খাতুনের।

স্বামী মারা যাওয়ার সময় রবিলার ছোট ছেলে মো. সোহবানের বয়স ছিল পাঁচ মাস। এখন তার বয়স ১৩ বছর, পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। পাশাপাশি বিকেলে কখনো আইসক্রিম আবার কখনো অন্য কোনো কিছু ফেরি করে। এরপর রাতে বাড়ি ফিরে বসে পড়াশোনায়। সোহবান স্বপ্ন দেখে বড় হয়ে সে সরকারি চাকরি করবে।

সোহবানকে এ স্বপ্ন বুনে দিয়েছে ‘ঘাসফুল শিশু নিকেতন’ নামের একটি বিদ্যালয়। অবৈতনিক বিদ্যালয়টি শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে শিক্ষা উপকরণও দেয়। সোহবানের মতো ওই এলাকার অনেক দরিদ্র পরিবারের শিশু স্কুলটিতে পড়ে।

এখান থেকে পড়া শেষ করে অনেকেই উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজেও পড়ছে। ঘাসফুল শিশু নিকেতনটি চরকালীবাড়ি এলাকায় বসবাস করা অসংখ্য নিম্নবিত্ত মানুষের জন্য নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে।

বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্যোক্তার নাম আখতারুজ্জামান ও দীপন বসাক। আখতারুজ্জামান পেশায় ওয়েব ডেভেলপার। দীপন বসাক অনলাইন ব্যবসায়ী। তাঁরা দুজনই ময়মনসিংহে বসবাস করেন। কীভাবে এ স্কুল করার চিন্তা মাথায় এল জানতে চাইলে আখতারুজ্জামান বলেন, ২০১৩ সালে এলাকায় একটি মিছিলে তিনি চর কালিবাড়ী এলাকার দরিদ্র পরিবারের কয়েকজন শিশুকে দেখেন। ওই মিছিলে শিশুদের নিয়ে আসা হচ্ছিল এক বেলা খাবার দেওয়ার শর্তে। ওই ঘটনা তাঁকে অনেক ভাবায়। এরপর চর কালীবাড়ি এলাকায় স্কুল করার চিন্তা মাথায় আসে তাঁর। এরপর সমমনা বন্ধুদের নিয়ে তিনি স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন। ২০১৪ সালে চালু হয় স্কুলটি।

আখতারুজ্জামান আরও বলেন, তাঁরা স্কুলটি গড়ে তোলার পর ঢাকায় বসবাস করা লেখিকা বন্দনা কবীর তাঁদের সহায়তায় এগিয়ে আসেন। এটি করার উদ্যোগকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে গড়ে তোলা হয় ‘হিউম্যানিটাস সোশ্যাল সার্ভিস সেন্টার’ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিবন্ধনপ্রাপ্ত এ সংগঠনটির সভাপতি বন্দনা কবীর। বন্দনা কবীরের স্বামী ইকবাল কবীর ‘তুসুকা’ (তুলা, সুতা, কাপড়) নামের একটি পোশাক কারখানার পরিচালক। তুসুকা প্রতি মাসে এ প্রতিষ্ঠানে আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে থাকে।

ঘাসফুল শিশু নিকেতনের সঙ্গে শুরু থেকেই সহযোগিতা নিয়ে আরও যুক্ত আছেন আরিফ চৌধুরী, ফাতেমা তুজ জোহরা, মুনমুন দাস, মাহফুজা মুমু প্রমুখ। স্কুলটি পরিচালনা করেন রাজিয়া আফরিন।

সম্প্রতি সরেজমিন দেখা যায়, টিফিনের সময় স্কুলের শিশুরা বালুময় মাঠে মনের আনন্দে খেলা করছে। তারা জানায়, স্কুলে আসতে তাদের ভালো লাগে। তাদের অনেকেই স্কুল ছুটির পর বিভিন্ন ধরনের কাজ করে। তাতেও তাদের কোনো কষ্ট নেই। স্কুলে যেতে পেরে তারা বেশ আনন্দ পায়।

স্কুলের বাইরে কথা হয় ওই এলাকার বাসিন্দা মতিউর রহমানের সঙ্গে। তাঁর দুটি হাত দুর্ঘটনায় কেটে গেছে। আগে টেলিভিশন মেরামতের কাজ করতেন। এখন আর তাঁর কোনো কাজ নেই। তাঁর মেয়ে মার্জিয়া ঘাসফুল স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। মতিউর রহমান বলেন, ‘আমার বাড়ি থেকে ঘাসফুলের স্যারেরা মেয়েকে স্কুলে নিয়ে গেছে। বিনা পয়সায় পড়ানোর পাশাপাশি আগে ঈদে নতুন জামা আর সেমাই-চিনিও দিত।’

স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চর কালীবাড়ি এলাকাটি ২০১৯ সালে সিটি করপোরেশনের আওতায় আসে। ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে ধু ধু বালুতে বিস্তৃত এলাকাটি সিটি করপোরেশনে যুক্ত হলেও এখনো নগরায়ণ হয়নি। বেশির ভাগ মানুষ নিম্ন আয়ের। মূল শহরে বাড়ি ভাড়া করার সক্ষমতা যাঁদের নেই, তাঁদের অনেকেই এ এলাকায় বাড়ি ভাড়া করে বসবাস করেন।

এলাকার অনেক পরিবার এখনো ‘দিন আনি দিন খাই’ অবস্থা থেকে বেরোতে পারেনি। ছেলেমেয়েরা একটু বড় হতেই মা–বাবার সঙ্গে কাজে চলে যায় পরিবারের আয় বাড়াতে। স্কুলে পড়ানোর চিন্তা খুব সহজে তাঁদের মাথায় আসে না। ১০ বছর ধরে কাজ করে ঘাসফুল ওই সব মানুষের চিন্তাও বদলে দিয়েছে। দারিদ্র্যের কারণে ঝরে পরা শিশুদের স্কুলমুখী করছে প্রতিষ্ঠানটি।

আখতারুজ্জামান বলেন, শুরুর দিকে স্কুলটি সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত ছিল। করোনার সময় আর্থিক সংকট দেখা দেয়। এখন পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়।