‘আমার ছেলেডারে এইবায় পুলিশ গুলি কইরা মাইরা ফালাইলো’
মায়ের হাতের রান্না করা ছোট মাছ ছিল পোশাকশ্রমিক জালাল উদ্দিনের (৪০) খুব পছন্দের। সময় পেলেই তিনি মাকে দেখতে আসতেন গ্রামের বাড়িতে। কথা ছিল এক সপ্তাহ পর বাড়িতে থাকা অসুস্থ বৃদ্ধ মা জাহেরা খাতুনের (৭০) কাছে আসবেন জালাল। কিন্তু মায়ের সঙ্গে আর তাঁর শেষ দেখা হলো না। এর আগেই তিনি পাড়ি জমালেন না ফেরার দেশে।
গত বুধবার সকালে গাজীপুরের কোনাবাড়ীর জরুন এলাকায় মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলনরত পোশাকশ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। এ সময় জালাল উদ্দিনের শরীরে ছররা গুলি লাগে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গতকাল শনিবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে তিনি মারা যান। জালাল উদ্দিন ইসলাম গ্রুপের একটি পোশাক কারখানায় সুপারভাইজার পদে চাকরি করতেন। একই সংঘর্ষের ঘটনায় আঞ্জুয়ারা খাতুন (৩০) নামের আরও এক পোশাকশ্রমিক মারা যান।
নিহত জালাল উদ্দিনের বাড়ি নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার গড়াডোবা ইউনিয়নের বাঁশাটি ভুটিয়ার কান্দি গ্রামে। তিনি ওই এলাকার মৃত চান মিয়ার ছেলে। স্ত্রী নার্গিস আক্তার ও ৯ বছরের একমাত্র সন্তান জান্নাতুল ফেরদৌস বাকিয়াকে নিয়ে কোনাবাড়ী এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় বসবাস করতেন।
আজ রোববার দুপুরে জালাল উদ্দিনের গ্রামের বাড়িতে গেলে পরিবারের সদস্যদের আহাজারি করতে দেখা যায়। এ সময় পরিবারসহ প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জালাল উদ্দিনরা চার ভাই ও তিন বোন। পৈতৃক সূত্রে বাড়ির সামনে ২০০ শতাংশ ফসলি জমি ছাড়া তাঁদের আর তেমন কিছু নেই। স্থানীয় বাঁশাটি উচ্চবিদ্যালয়ে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছিলেন জালাল। এরপর তিনি জীবিকার সন্ধানে ঢাকায় চলে যান। সেখানে গিয়ে পোশাক কারখানায় চাকরি নেন। ১০ বছর আগে তিনি বিয়ে করেন।
স্ত্রী, সন্তান ও মাকে নিয়ে জালাল উদ্দিন কোনাবাড়ীতে ভাড়া বাসায় একসঙ্গেই বসবাস করতেন। কিন্তু মাসখানেক আগে মাকে চিকিৎসক দেখিয়ে গ্রামের বাড়িতে রেখে যান। নিয়মিতই মায়ের খোঁজখবর রাখতেন জালাল। গত মঙ্গলবার সকালে সর্বশেষ মায়ের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয় জালালের। বাড়িতে কখন আসবে— মা জানতে চাইলে জালাল বলেছিলেন, এক সপ্তাহ পর বাড়িতে আসবেন।
আজ দুপুরে মা জাহেরা বিলাপ করতে করতে বলছিলেন, ‘আমার ছেলেডারে এইবায় পুলিশ গুলি কইরা মাইরা ফালাইলো। অহন আমি কারে বাজান ডাকবাম। আমারে কেডা চোখের ডাক্তর দেখাইবো। কেডা আমারে দেহাশুনা করবো?’
জালাল উদ্দিনের চাচাতো ভাই আনিসুর রহমান প্রথম আলোকে জানান, কোনাবাড়ীতে ওই পোশাক কারখানায় ২৫ হাজার টাকা বেতনে সুপারভাইজার পদে চাকরি করতেন জালাল। তাঁর স্ত্রী কোনাবাড়ীতে একটি কিন্ডারগার্টেনে চাকরি করতেন। সেই চাকরিটিও কয়েক মাস আগে চলে যায়। মেয়েটি কোনাবাড়ীতে একটি কিন্ডারগার্টেনে প্রথম শ্রেণিতে পড়ছে। জালালের স্বপ্ন ছিল, লেখাপড়া করিয়ে মেয়েটিকে মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তুলবেন।
ভগ্নিপতি আবুল কাশেম বলেন, পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন জালাল উদ্দিন। তাঁর আয়েই চলত স্ত্রী, সন্তানসহ বৃদ্ধ মায়ের ভরণপোষণ। কিন্তু পুলিশের গুলিতে জালাল উদ্দিনের মৃত্যু হওয়ায় পরিবারটি অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে।
আক্ষেপ প্রকাশ করে কেন্দুয়া উপজেলার গড়াডোবা ইউনিয়ন পরিষদের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য হোসেন আহমেদ বলেন, ‘বসতভিটাটুকু ছাড়া জালালের সহায়সম্পদ বলতে কিছু নেই। জালাল আমার বন্ধু ছিল। এলাকায় একসঙ্গে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেছি। সে খুব ভালো মানুষ ছিল। এভাবে তার মৃত্যু হবে, এটা ভাবতেই পারছি না। জালালের মৃত্যুতে তার বৃদ্ধ মা, স্ত্রী ও সন্তান অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে।’ অসহায় পরিবারটির পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করবেন বলে জানান গড়াডোবা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান খান।
আরও পড়ুন
-
দুই দেশের সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় করতে ডোনাল্ড লুর সঙ্গে আলোচনা হয়েছে: পরিবেশমন্ত্রী
-
ভারতের দুই প্রতিষ্ঠানের মসলায় ক্ষতিকর জীবাণু, যুক্তরাষ্ট্রে সতর্কতা
-
১৫৩ রোহিঙ্গার জন্মনিবন্ধন: ইউপি চেয়ারম্যান সাময়িক বরখাস্ত
-
দুবাইয়ে বিশ্বের ধনকুবেরদের গোপন সম্পদের পাহাড়, কার কত
-
‘ভোটাররা আর আমাদের আন্ডার মেট্রিক বলতে পারবে না’