Thank you for trying Sticky AMP!!

গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার পাটনিপাড়া গ্রামে বাঁশ দিয়ে কুলা, চালুনি, ডালি তৈরি করছেন নারী-পুরুষেরা। গত বৃহস্পতিবার

বাঁশশিল্প চলছে ধুঁকে ধুঁকে 

বাঁশশিল্পের সঙ্গে জড়িত অনেকে পৈতৃক পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন। তাঁরা বেছে নিয়েছেন দিনমজুরের কাজ।

গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে ঐতিহ্যবাহী বাঁশশিল্প চলছে ধুঁকে ধুঁকে। যাঁরা বংশানুক্রমে এখনো বাঁশশিল্পের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন, তাঁরা বাঁশের কাজ করে আর সংসার চালাতে পারছেন না। বাঁশের দাম বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে প্লাস্টিক সামগ্রীর ব্যবহার বেড়ে যাওয়াই এ শিল্প ধ্বংসের কারণ। বাঁশশিল্পের সঙ্গে জড়িত অনেকে পৈতৃক পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন। তাঁরা বেছে নিয়েছেন দিনমজুরের কাজ। অনেকে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালাচ্ছেন। তাঁদের অনুযোগ, এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই।

এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত সুন্দরগঞ্জের দাসপাড়া গ্রামের সুমি রানী দাস (৫২) বলেন, তাঁরা আগে থেকেই বাঁশ দিয়ে ঝুড়ি–চালুন–কুলা তৈরির কাজ করতেন। এই কাজের ওপর তাঁদের প্রশিক্ষণ নেই। বাবা-মায়ের কাছে কাজ শিখেছেন। এ ব্যবসা ভালোই চলছিল। এখন বাঁশের দাম বেশি। অন্য কাজ জানা নেই। তাই বংশগত এ ব্যবসা ধরে রেখেছেন। যে আয় হচ্ছে, তা দিয়ে চলছে না। ফলে বাধ্য হয়ে পাশাপাশি অন্যের বাড়িতে কাজ করতে হচ্ছে। এক ছেলে এ পেশা ছেড়ে অটোরিকশা চালাচ্ছেন।

গাইবান্ধা বিসিকের একটি সূত্র জানায়, সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় দুই শতাধিক পরিবার এখনেও বাঁশশিল্পের সঙ্গে জড়িত। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে প্লাস্টিক সামগ্রীর ব্যবহার বেড়ে গেছে। ফলে ঐতিহ্যবাহী বাঁশশিল্প ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। পৈতৃক পেশা হিসেবে এখনো যাঁরা বাঁশের জিনিসপত্র তৈরি করছেন, তাঁদের ব্যবসাও ধুঁকে ধুঁকে চলছে।

এ উপজেলায় এখনো যাঁরা বাঁশের কাজ করছেন, তাঁদের অধিকাংশের বসবাস পৌরসভার  দাসপাড়া ও তৎসংলগ্ন তারাপুর ইউনিয়নের পাটনিপাড়া গ্রামে। গত বৃহস্পতিবার সরেজমিনে ওই দুই গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, অনেক বাড়িতে বাঁশের কাজ চলছে। রাস্তার পাশে, বাড়ির উঠোন ও আঙিনায় কাজ চলছে। কেউ বাঁশ কাটছেন, কেউ ডালি, কুলা, চালুনি বানাচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে নারীর সংখ্যাই বেশি। পরিবারের স্বামী-স্ত্রী-সন্তান সবাই বাঁশের কাজ করছেন।

এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা জানান, উপজেলার বিভিন্ন হাটবাজার ও গ্রামে গ্রামে ঘুরে তাঁরা বাঁশ কেনেন। বর্তমান বাজারে প্রতিটি বাঁশ ৪০০-৪৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এসব বাঁশ দিয়ে কুলা, চালুনি, ডালি, মাছ ধরার পলো, হাঁস–মুরগির খাঁচা, চাটাই, ধামা তৈরি হচ্ছে। বাঁশের তৈরি এসব জিনিসপত্র স্থানীয় বাজারে বিক্রি হচ্ছে। স্থানীয় বাজারে প্রতিটি কুলা ৭০-৮০ টাকা, প্রতিটি চালুনি ৬০-৭০ টাকা, প্রতিটি ডালি ১৫০-২০০ টাকা, প্রতিটি মাছ ধরার পলো ২৫০-৩০০ টাকা, প্রতিটি হাঁস–মুরগির খাঁচা ২৫০-৩০০ টাকা এবং প্রতিটি পাঁচ ফুট প্রস্থ ও সাত ফুট দৈর্ঘ্যের চাটাই ২০০-২৫০ টাকায় বেচাকেনা হচ্ছে।

দাসপাড়া গ্রামের গৌতম চন্দ্র দাস (৫৬) বলেন, আগের মতো আর ব্যবসা ভালো চলছে না। দিন দিন গ্রামে বাঁশের বাগান কেটে ফসলি জমি ও বসতবাড়ি নির্মাণ করা হচ্ছে। ফলে বাঁশবাগানের সংখ্যা কমে গেছে। এ ছাড়া বাজারে স্বল্প দামে পাওয়া প্লাস্টিকের সামগ্রীর কদর বেড়ে গেছে। পক্ষান্তরে বাঁশের দাম বেড়েছে। এক বছর আগে প্রতিটি বাঁশের দাম ছিল ২২০-২৫০ টাকা। বর্তমান বাজারে প্রতিটি বাঁশ ৪০০-৪৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বেশি দামে বাঁশ কিনে বাঁশের তৈরি জিনিসপত্রও বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। এমনিতে প্লাস্টিকের সামগ্রীর দাম কম, তার ওপর বাঁশের জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। ফলে ক্রেতা নেই। এখন সংসার চালানোই কঠিন হয়ে পড়েছে।

একই গ্রামের গৌরাঙ্গ দাস (৫৬) বলেন, আগে বাঁশের কাজ করে যে আয় হতো, তা দিয়ে চারজনের সংসার চালাতেন। তবে বাঁশের দাম বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না। তাই এ পেশা ছেড়ে দিয়ে দিনমজুরের কাজ করছেন। ওই এলাকার সান্ত্বনা রানী (৫০) বলেন, তাঁর স্বামী বাঁশের কাজ করতেন। সংসারের খরচ জোগাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাই তিনি এ কাজ ছেড়ে দিনমজুরের কাজ করছেন।

পাটনিপাড়া গ্রামের দিলীপ চন্দ্র (৪১) বলেন, শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকায় চাকরি পাননি। বাধ্য হয়ে ১৫ বছর বয়সে বেছে নেন পৈতৃক পেশা। বাঁশ দিয়ে ডালি, কুলা, চালুন প্রভৃতি তৈরির কাজ শুরু করেন। দিলীপ চন্দ্র বলেন, হাটবাজার থেকে বাঁশ কেনেন। বাড়িতে বসেই ওই সব জিনিসপত্র তৈরি করেন। স্ত্রী-সন্তানেরা তাঁকে কাজে সহায়তা করেন। আগে খরচ বাদে মাসে ১১-১৩ হাজার টাকা উপার্জন হতো। তবে বর্তমানে প্লাস্টিকের সামগ্রীর ব্যবহার বেড়ে গেছে। ফলে এ ব্যবসায় মন্দা দেখা দিয়েছে।

এ ব্যাপারে গাইবান্ধা বিসিকের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) রবীন্দ্রনাথ রায়  প্রথম আলোকে বলেন, এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বাঁশের তৈরি জিনিসপত্র কিনতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। এসব জিনিসপত্র বাজারজাতকরণের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। বাঁশশিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা চাইলে তাঁদের ঋণ দেওয়া হবে।

উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা জাফর আহম্মেদ বলেন, যেসব তরুণ–তরুণী বাঁশের সামগ্রী তৈরি করছেন, পর্যায়ক্রমে তাঁদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবেন। স্বল্প সুদে তাঁদের ঋণ প্রদান করা হবে।