Thank you for trying Sticky AMP!!

বাড়ছে শ্বাসতন্ত্রের রোগ 

বরিশালে এবার শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় দ্বিগুণ।

ইটভাটার চিমনি থেকে বের হওয়া কালো ধোঁয়ায় দূষিত হচ্ছে বায়ু। সম্প্রতি বরিশাল সদর উপজেলার চরবাড়িয়া ইউনিয়নের আমিরগঞ্জ এলাকায়

বরিশাল বিভাগে বাড়ছে বায়ুদূষণের মাত্রা। এর ফলে এবার শীত মৌসুমে বিভাগে শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহজনিত রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও বেড়েছে। এর বড় শিকার হচ্ছেন শিশু, বয়স্ক, ডায়াবেটিস ও হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা। 

গত ৪ ডিসেম্বর বিশ্বব্যাংকের প্রকাশ করা ‘ব্রিদিং হেভি: বায়ুদূষণের নতুন তথ্যপ্রমাণ এবং স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে বায়ুদূষণে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বরিশাল বিভাগ। এ ক্ষেত্রে শীর্ষে ঢাকা বিভাগ। 

ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দেশের যেসব এলাকায় বায়ুদূষণ বেশি, সেখানের মানুষ বিষন্নতায়ও বেশি ভোগেন। দূষণপ্রবণ এলাকাগুলোর প্রায় ১৪ শতাংশ বাসিন্দা বিষন্নতার শিকার। এসব এলাকায় বাড়ছে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যাও। ২০১৯ সালে দেশে বায়ুদূষণে সর্বোচ্চ ৮৮ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। 

বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্র জানায়, এ হাসপাতালে গত বছরের নভেম্বরে ২৭ জন, ডিসেম্বরে ২৪ শিশু এবং জানুয়ারিতে তিন শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডে ডিসেম্বরে মারা গেছেন আরও চার বয়স্ক ব্যক্তি। তাঁদের সবার শ্বাসকষ্টজনিত রোগে মৃত্যু হয়।

এদিকে বরিশাল বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তর শহরের দুটি বাসস্ট্যান্ড ও একটি আবাসিক এলাকার প্রতিমাসে একবার বায়ুমান পরীক্ষা করে। সাসপেনডেড পার্টিকুলার ম্যাটারে (এসপিএম) এ পরীক্ষা করা হয়। ধোঁয়া, ধুলা, বাষ্প ও একটা নির্দিষ্ট সময় ধরে বাতাসে ভেসে থাকা কঠিন পদার্থের কণাকে এসপিএম বলে। এতে বরিশালে বেশিরভাগ এলাকায় এসপিএম মাত্রা ১৫০ থেকে ২০০। তবে নগরের নথুল্লাবাদ ও রূপাতলী বাসস্ট্যান্ডে এই মান কয়েকগুণ বেশি, যা জনস্বস্থ্যোর জন্য ভয়াবহ ক্ষতিকর। 

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্বের বায়ুমান যাচাইবিষয়ক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ‘এয়ার ভিজ্যুয়াল’–এর বায়ুমান সূচক (ইউএস একিউআই) মূলত বাতাসে অতিসূক্ষ্ণ বস্তুকণা (পিএম ২ দশমিক ৫ ও পিএম ১০) পরিমাপ করে বায়ুর মান নির্ধারণ করে। এয়ার ভিজ্যুয়ালের হিসাবে, পিএম ০ থেকে ৫০ থাকলে ওই স্থানের বায়ু স্বাস্থ্যকর। ১০০ থেকে ১৫০ থাকলে তা সংবেদনশীল লোকদের জন্য অস্বাস্থ্যকর। ১৫১ থেকে ২০০ থাকলে তা সবার জন্য অস্বাস্বাস্থ্যকর। ২০০ থেকে ৩০০–এর মধ্যে থাকা মানে খুবই অস্বাস্থ্যকর। বায়ুর মান ৩০০–এর বেশি থাকা মানে ওই স্থানের বায়ু বিপজ্জনক। 

এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের হিসাবে, বরিশালের বায়ুর মান ২৪ জানুয়ারি ছিল ১৩৫। গতকাল ২৬ জানুয়ারি বিভাগের বায়ুর মান বেড়ে দাঁড়ায় ১৬৪।

পরিবেশ অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় উপপরিচালক এইচ এম রাশেদ প্রথম আলোকে বলেন, পদ্মা সেতু চালুর পর বরিশাল অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের যানবাহন চলাচলের সংখ্যা বেড়েছে কয়েকগুণ। এ ছাড়া উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত পাকা সড়ক ও ভবন নির্মাণ, সরকারি বহুতল স্থাপনা নির্মাণ ও সরকারি বিভিন্ন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের এ বিভাগে। বেসরকারি পর্যায়ে আবাসন ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রসার হচ্ছে। আছে বৈধ-অবৈধ অসংখ্য ইটভাটা। এসব কারণে বাড়ছে বায়ুদূষণ।

বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বরিশাল বিভাগের ছয়টি জেলায় মোট ইটভাটা রয়েছে ৯৭০টি। এসব ইটভাটার মধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র পেয়েছে ৩৫০টি। বাকি ১৩৩টি ইটভাটা চলছে ছাড়পত্র ছাড়াই। এর মধ্যে পুরনো প্রযুক্তির ৪৮০টি, আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তির ৪০০টি এবং সম্পূর্ণ অবৈধ ড্রাম চিমনির ৯০টি ইটভাটা।

সরকারি হিসাবে বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে এক হাজারের কাছাকাছি ইটভাটার হিসাব পাওয়া গেলেও বাস্তবে রয়েছে অন্তত দেড় হাজার। এসব ভাটায় দেদার পোড়ানো হচ্ছে সংরক্ষিত বন ও সামাজিক বনের কাঠ। 

এ ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের বিভাগীয় উপপরিচালক এইচ এম রাশেদ প্রথম আলোকে বলেন, যেসব প্রতিষ্ঠান বা যানবাহন বায়ুদূষণের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মোবাইল কোর্ট ও এনফোর্সমেন্ট কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। পরিস্থিতি অনুযায়ী জরিমানা ও মামলা করা হচ্ছে।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সামগ্রিকভাবে দেশের বায়ুদূষণযুক্ত এলাকার ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ নারী ও ১১ দশমিক ৮ শতাংশ পুরুষ বিষণ্নতায় ভুগছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্ধারিত মাত্রা থেকে ১ শতাংশ দূষণ বাড়লে বিষণ্নতায় ভোগা মানুষের সংখ্যা ২০ গুণ বেড়ে যায়। 

ওই প্রতিবেদনে দূষণের প্রধান উৎস হিসেবে যানবাহনের ধোঁয়া, শুষ্ক মৌসুমে অবকাঠামো নির্মাণ ও মেরামতের কারণে সৃষ্টি হওয়া ধুলা এবং ইটভাটা থেকে নির্গত ধোঁয়া—এই তিনটিকে দায়ী করা হয়েছে। দূষিত এলাকার শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়াসহ অন্যান্য বক্ষব্যাধি প্রধান সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে বলে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়।

বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, বরিশালে এবার নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কিওলাইটিস, অ্যাজমা, শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়াসহ শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় দ্বিগুণ। এসব রোগীর বেশিরভাগ শিশু।

বরিশাল বিভাগে গত বছরের ৭ নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত দুই মাসে শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে ৩ হাজার ৬৭৩ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। বেসরকারি সূত্রের তথ্য অনুযায়ী এই সংখ্যা তিন গুণেরও বেশি।

বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক শ্যামল কৃষ্ণ মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, এবার শীতের শুরুতেই শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহজনিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি। এটা বেড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বায়ুদূষণের ভূমিকা রয়েছে।