Thank you for trying Sticky AMP!!

এভাবে অযত্নে রাখা হয়েছে চট্টগ্রাম নগরের হালিশহরের নাথপাড়া বধ্যভূমি। কোনোরকমে একটি স্মৃতিচিহ্ন করে দায় সারা হয়েছে। এটির রক্ষণাবেক্ষণ নেই। পাশে ঘেঁষে গড়ে উঠেছে নানা স্থাপনা। গতকাল দুপুরে

ছেলের রক্তে স্নান করানো হয় মাকে

নাথপাড়ায় সেদিন এমন হত্যাকাণ্ডের একমাত্র কারণ, সেখানে আশ্রয় নেন ইপিআরের কয়েকজন সদস্য।

প্রথমে দরজার পাশে লুকিয়ে থাকা নিহারবালার বড় ভাইকে (দুলাল নাথ) কুড়াল ও কিরিচ দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে বিহারি ঘতকেরা। মাথা প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তাঁর। কিশোরী নিহারবালা তাঁর মেজদাকে (বাদল কান্তি নাথ) খাটের তলায় বুকের মাঝে আগলে রাখলেন ভয়ে।

সেখান থেকে টেনে এনে হত্যা করা হলো তাঁর মেজদাকেও। তারপর তাঁদের রক্ত দিয়ে তাঁর মাকে স্নান করাল ঘাতকের দল। সেকি বীভৎস দৃশ্য! আর সহ্য হলো না। জ্ঞান হারালেন তিনি। জ্ঞান ফেরে আগুনের আঁচে। বাড়িটা তখন জ্বলছিল।

নিহারবালা দেবী ওরফে খুকু নাথ ১৯৭১ সালে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন। চুল এখন ধবধবে সাদা। বাঁ হাতের পোড়া দাগ একাত্তরের ৩১ মার্চের সেই ভয়াবহতার রাতের কথা জানান দিচ্ছে এখনো। সেদিনের ঘটনা এখন আর কাউকে বলতে চান না। তারপরও বললেন। আক্ষরিক অর্থেই রক্তস্নাত সেই সময়ের স্মৃতি নিজের বুকে ক্ষতের মতো বয়ে চলেছেন এই বৃদ্ধা।

মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ এমনই এক বীভৎসতার মুখোমুখি হয়েছিলেন হালিশহর নাথপাড়ার বাসিন্দারা। এই নির্মমতার জীবন্ত সাক্ষী মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা নিহারবালা। নিজের চোখের সামনে বাবা হরিরঞ্জন নাথ, দুই দাদু ক্ষিরদবাসী নাথ ও পূর্ণচন্দ্র নাথ, দুই ভাই দুলাল কান্তি নাথ এবং বাদল কান্তি নাথ ও তাঁদের এক জেঠা শ্রীধাম নাথকে জল্লাদদের হাতে খুন হতে দেখেছেন। নাথপাড়ায় সেদিন এমন হত্যাযজ্ঞের একমাত্র কারণ, সেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন ইপিআরের (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) কয়েকজন সদস্য। ৪০ জন ইপিআর সদস্যসহ মোট ৭৯ জনকে হত্যা করেছিল পাশের বিহারিরা। সঙ্গে ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।

গতকাল শুক্রবার নগরের হালিশহর চুনা ফ্যাক্টরি এলাকার মধ্যম নাথপাড়ায় গিয়ে দেখা গেল, অনেকটা বদলে গেছে পুরোনো এই পাড়া। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাড়ায় ৩০টির বেশি পরিবার ছিল। এখন চারপাশে বড় বড় দালান।

নাথ পরিবার বলতে আছে কেবল দুটি। তাদের মধ্যে একটি নিহারবালাদের। নিহারবালারা ছিলেন চার ভাই ও দুই বোন। যুদ্ধে বিহারিদের হাতে খুন হওয়া দুই ভাই নিহারের বড়। বেঁচে থাকা দুই ভাই ছিলেন ছোট। এর মধ্যে ছোট ভাই মৃণাল নাথ মারা যান ২০১২ সালে। এখন ভাই সুনীল নাথ বেঁচে আছেন।

একাত্তরের দুঃসহ স্মৃতির ভাগ কাউকে দিতে চাননি বলে আজীবন সঙ্গীহীন কাটিয়ে দিলেন নিহারবালা। সেদিনের কথা তুলতেই বললেন, ‘প্রতিবছর বিজয় দিবসের আগে সাংবাদিকেরা আসেন। বিভিন্ন টেলিভিশন ও পত্রিকার লোকজন এসে খোঁজখবর নেন। এ ছাড়া সরকারি লোকজন কেউ আসেন না। মেলেনি শহীদ পরিবারের স্বীকৃতি। পাড়ার সামনে করা বধ্যভূমিটা পারছে না দখল করতে। এভাবে কাটছে আমাদের দিনকাল। কত দিন থাকতে পারব জানি না।’

নিহারবালা বলেন, ‘বাবা, জেঠা, দাদুসহ মোট ছয়জনকে হারাই আমরা। কিন্তু তারপরও আমাদের শহীদ পরিবারের মর্যাদা নেই। কী হবে এসব লিখে?’

 বাঁ হাতের পোড়া দাগ দেখিয়ে নিহারবালা বলেন, হত্যাযজ্ঞের পর বিহারি ও পাকিস্তানিরা পেট্রল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। আগুনের আঁচ লাগে নিহারবালার গায়ে। বাঁ হাত–পা পুড়ে যায়। আগুন লাগার পর দৌড়ে পাশের পুকুরে ঝাঁপ দেন তিনি।

নিহারের মা নিরবালা দেবী এই দুঃসহ স্মৃতি মাথায় নিয়ে ২০০৮ সালের ৬ মার্চ মারা যান। বেঁচে থাকা অবস্থায় শুধু কাঁদতেন নিরবালা। স্বামী, শ্বশুর, দুই ছেলে প্রত্যেককে কুপিয়ে যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল তাঁর সামনে। সেই দৃশ্য যত দিন বেঁচেছিলেন তাড়া করে ফিরেছে তাঁকে।

লেখক সাংবাদিক মুহাম্মদ শামসুল হকের চোখে দেখা ৭১ বইয়ে নাথপাড়া হত্যাযজ্ঞের প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে নিরবালা দেবীর বয়ান রয়েছে। সেখানে নিরবালা দেবী বলেছেন, ‘৩১ মার্চ সকালে ১০-১২ জন ইপিআর সদস্য আমাদের ঘরে এসে আশ্রয় নেন। দুপুরের দিকে বিহারিরা আক্রমণ করল পাড়ায়। কুড়াল ও কিরিচ দিয়ে হত্যা করল আমার বড় ছেলে দুলালকে। পরে বাদলকেও। তাদের রক্ত দিয়ে আমাকে স্নাত করানো হলো। তখন আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি।’

সেদিন এই নাথপাড়ার এমন কোনো পরিবার ছিল না যে স্বজন হারায়নি। পাশের ডলি নাথ হারিয়েছিলেন তাঁর বাবা অনিল নাথসহ তিন স্বজনকে। নারায়ণ চন্দ্র বৈষ্ণব হারিয়েছেন পিতামহ, ভাইসহ তিনজনকে। এত হত্যার পর এখনো শহীদ পরিবারের মর্যাদা পায়নি পরিবারগুলো। ২০০১ সালে একটি স্মৃতিসৌধ করা হয়েছিল পাড়ার কালীমন্দিরের পাশে। কিন্তু সেটা এখন অযত্ন–অবহেলায় পড়ে রয়েছে। একটি মাদ্রাসা লাগোয়া স্মৃতিসৌধটির পাশে ময়লা–আবর্জনা পড়ে রয়েছে।

সেদিন হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছিল পার্শ্ববর্তী আবদুর পাড়ায়ও। সেখানকার কয়েকজন মুসলমান বাসিন্দা নির্মম হত্যার শিকার হয়েছিলেন। তবে এত মৃত্যুর পরও এ এলাকার কেউ শহীদ পরিবারের মর্যাদা পাননি; বরং নিরাপত্তাহীনতা আর অনিশ্চয়তা মাথায় নিয়ে অনেকে চলে গেছেন পুরোনো ভিটাবাড়ি ছেড়ে।