Thank you for trying Sticky AMP!!

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে দ্বীপের স্কুলে, গল্প–গানে, ছবি এঁকে পড়ান শিশুদের

বিদ্যালয়ে গান, নাচ, ছবি এঁকে গল্প বলে ও হাতের কাজ করিয়ে পাঠদান করেন শমসের নেওয়াজ। সম্প্রতি কক্সবাজারের কুতুবদিয়ার ফ্লাইট লেফটেনেন্ট কাইমুল হুদা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে

তখন তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী শমসের নেওয়াজ। সালটা ১৯৯৪। সে বছর এক লঞ্চ দুর্ঘটনায় শমসেরের জীবনটা ওলট–পালট হয়ে যায়। তাঁর মায়ের মৃত্যু হয়। পরে কলেজশিক্ষক বাবাই তাঁকে কখনো গানের স্কুলে নিয়ে গেছেন, কখনো নাচের মঞ্চে তুলে দিয়েছেন। বাবার স্নেহেই বেড়ে ওঠেন তিনি। বাবাকে দেখেই শমসের সিদ্ধান্ত নেন, জীবনে যদি কিছু হতেই হয়, তবে শিক্ষক হবেন। সেই চাওয়া পূরণ হয়েছে তাঁর।

শমসের এখন চট্টগ্রাম বিভাগের শ্রেষ্ঠ সহকারী শিক্ষক। গত ১১ অক্টোবর চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর চট্টগ্রামের উপপরিচালক শফিকুল ইসলাম স্বাক্ষরিত চিঠিতে শমসের শ্রেষ্ঠ সহকারী শিক্ষক হিসেবে তাঁর নামটি দেখতে পান। এর পর থেকেই বাঁধভাঙা আনন্দে ভাসছেন কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়া উপজেলার এই বাসিন্দা। বর্তমানে কুতুবদিয়া উপজেলার আলী আকবর ডেইল ইউনিয়নের ফ্লাইট লেফটেনেন্ট কাইমুল হুদা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী শিক্ষক তিনি। সবাই তাঁকে মুক্তা নামেই চেনেন। শিক্ষার্থীদের কাছেও প্রিয় ‘মুক্তা ম্যাম’ নামে পরিচিত।

কথা বলে জানা গেল, পড়াশোনা শেষ করে চাকরিতে আসা পর্যন্ত শমসের নেওয়াজের দীর্ঘ যাত্রা মসৃণ ছিল না। এ পথে নানা বাধা পার করতে হয়েছে তাঁকে। জীবনের শুরুর দিকে মাকে হারানো, তারপর স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে প্রায় দেড় শ কিলোমিটার দূরের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া—সব মিলিয়ে সহজ কোনো পথে হাঁটতে পারেননি তিনি।

২০১০ সালে এই বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন শমসের। এর আগে তিন বছর ছিলেন একই উপজেলার বড়ঘোপ ইউনিয়নের পিলটকাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর পাস করা এই শিক্ষক ২০১৪ ও ২০১৯ সালে জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ সহকারী শিক্ষক নির্বাচিত হয়েছিলেন। এবার হলেন বিভাগীয় পর্যায়ে।

শমসেরের পড়ানোর ধরনটাই ভিন্ন। কখনো তিনি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গল্প করছেন, কখনো একসঙ্গে গান গাইছেন, আবার কখনো ছবি আঁকছেন। কবিতা, ছড়া কিংবা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি শুনিয়ে শিক্ষার্থীদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে যাওয়ার কারণে তাঁকে শিশুরা পছন্দ করে।

বিদ্যালয়ে গান, নাচ, ছবি এঁকে গল্প বলে ও হাতের কাজ করিয়ে পাঠদান করেন শমসের নেওয়াজ। সম্প্রতি কক্সবাজারের কুতুবদিয়ার ফ্লাইট লেফটেনেন্ট কাইমুল হুদা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে

‘শিক্ষকই হতে চেয়েছিলাম’

শিক্ষক পরিবার থেকেই উঠে এসেছেন শমসের। তাঁর বাবা মো. আক্কাস উদ্দিন কুতুবদিয়া মডেল উচ্চবিদ্যালয় অ্যান্ড কলেজের সাবেক শিক্ষক। মা তাহমিনা খানম চৌধুরী ছিলেন আবহাওয়া অধিদপ্তরের সরকারি কর্মকর্তা। ১৯৯৪ সালের লঞ্চ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান মা। এরপর শমসের ও তাঁর বোনের সব দায়িত্ব বাবার কাঁধে চলে আসে। শমসের বলেন, ‘বাবার অনুপ্রেরণা, স্নেহ সব সময় ছিল। খেলাধুলা ও সংস্কৃতিচর্চার জন্য তাগাদা দিতেন। কতটা আন্তরিকভাবে বাবা শিক্ষার্থীদের পড়াতেন, তা নিজের চোখেই দেখেছি। এ কারণে স্কুলজীবনেই শিক্ষক হওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।’

শমসের বলেন, ‘সব শিক্ষার্থীই আমার সন্তানের মতো। তাদের ভালোমন্দের খোঁজ রাখি নিয়মিত। বিদ্যালয়কে আনন্দনিকেতন হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। নিত্যনতুন কৌশলে শিক্ষার্থীদের পড়াই। পাশাপাশি শিল্প ও সংস্কৃতিমনা হিসেবে যাতে গড়ে ওঠে, সেদিকেই নজর দিই। মূলত এসব কারণেই সরকারি স্বীকৃতি মিলেছে। এই স্বীকৃতি আমার কাজের গতি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।’

শমসেরের স্বামী মো. শওকতুল ইসলামও শিক্ষক। তিনি কুতুবদিয়া সরকারি কলেজে কর্মরত আছেন। পরিবারে তাঁর দুই সন্তান।

ঝুলিতে নানা পুরস্কার, আছেন লেখালেখিতেও

শ্রেষ্ঠ শিক্ষক সম্মাননা অনুষ্ঠানে শিক্ষিকা শমসের নেওয়াজ

শমসের নেওয়াজ নজরুলসংগীত ও লোকনৃত্যেও পারদর্শী। এ বিষয়ে জাতীয় পুরস্কার আছে তাঁর ঝুলিতে। ২০০৯ সালে জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ উপলক্ষে আন্তপিটিআই সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় কক্সবাজার জেলা, চট্টগ্রাম বিভাগ হয়ে পরে প্রথম পুরস্কার পান। এ ছাড়া নিজ উপজেলায় শিক্ষা ক্ষেত্রে অবদান রাখায় ২০১৩ সালে পেয়েছেন জয়িতা সম্মাননা।

১৯৯৬ সালে শ্রেষ্ঠ শিশুশিল্পী পুরস্কার এবং ২০০২ সালে শ্রেষ্ঠ গার্লস গাইড স্বীকৃতিও পেয়েছিলেন শমসের। শিক্ষকতার পাশাপাশি শিল্পকলা একাডেমিতে নৃত্যপ্রশিক্ষক ও উপস্থাপক হিসেবে কাজ করছেন। সংস্কৃতিচর্চার পাশাপাশি লেখালেখিও করেন তিনি। ‘দ্বীপের শিক্ষা ও শিশুর মানসিক বিকাশ’ এবং ‘ডিজিটাল প্রাথমিক শিক্ষা বনাম উপকূলীয় প্রেক্ষাপট’ শিরোনামে তাঁর দুটি প্রবন্ধের বই প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া শিশুতোষ ছড়া ও কবিতার যৌথ কাব্যগ্রন্থও বেরিয়েছে।

শমসের নেওয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিদ্যালয়ের এই শিশুরা কাদামাটির মতো। তাদের যেভাবে গড়ে তোলা হবে, সেভাবেই পরবর্তীতে ভূমিকা রাখবে। আমি চেষ্টা করি, শিশুদের মধ্যে মানবিকতা, কোমলতা ঢুকিয়ে দিতে। যাতে বন্ধুর কষ্টে তারা কাঁদতে পারে। দেশ-বিদেশের নানা বইপত্র, গল্প, ইতিহাস জানার মাধ্যমেই এটি সম্ভব হবে। এই শিশুদের নিয়েই আমি এগিয়ে যেতে চাই।’