Thank you for trying Sticky AMP!!

গাইবান্ধার কাশিয়াবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে পাঠ গ্রহণ করছেন ৬৫ বছর বয়সী আবদুল মান্নান। আজ মঙ্গলবার সকালে

‘নেকাপড়া না জানলে কোনো কাম হয় না, তাই ওয়ানোত ভরতি হচি’

জন্মের পর থেকেই দেখেছেন দারিদ্র্যের রুক্ষ রূপ। অভাবের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে অল্প বয়সে শুরু করেন দিনমজুরের কাজ। তাই কখনো বিদ্যালয়ের চৌকাঠ মাড়ানো হয়নি। জীবনসংগ্রামে নানা পেশা বদলে ৬৫ বছর বয়সে এসে আবদুল মান্নান এখন গ্রামে সড়কের পাশে বসে খিলি পান বিক্রি করেন। কিন্তু পড়াশোনা না জানায় এখানেও নানাভাবে ঠকেন তিনি। অনেকেই তাঁর কাছ থেকে বাকিতে পান কিনে পরে পুরো টাকা শোধ করেন না। অক্ষরজ্ঞান নেই বলে হিসাবও ঠিকমতো রাখতে পারেন না তিনি। সে জন্য জীবনের শেষ প্রান্তিকে এসে পড়ালেখা শেখার উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি।

আবদুল মান্নানের বাড়ি গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার কিশোরগাড়ি ইউনিয়নের কাশিয়াবাড়ী গ্রামে। পড়ালেখা শিখতে ৬৫ বছর বয়সে এসে তিনি ভর্তি হয়েছেন কাশিয়াবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে।

এ বয়সে পড়াশোনা করতে কেমন লাগছে জানতে চাইলে আবদুল মান্নান বলেন, ‘নেকাপড়া না জানলে কোনো কাম হয় না, পান বাকি দিয়া ঠকিয়া তা বুচচ্চি। যার কাচে পাই এ্যাকশো ট্যাকা, তাই কয়, ষাইট ট্যাকা পান চাচা। এংকা করি ম্যালা ট্যাকা মার খাচি। তাই এবারক্যা ওয়ানোত ভরতি হচি। দেকি নেকাপড়া শিকপ্যার পাই কিনে।’ তিনি হাসতে হাসতে বললেন, ‘ওয়ানোত ভরতি যকন হচি, ম্যাট্টিক (এসএসসি) পাস দেমো। তকন কাউয়ো হামাক ঠকপ্যার পাবার নোয়ায়।’

নাতির ছেলের হাত ধরে বিদ্যালয়ে যাচ্ছেন আবদুল মান্নান। আজ মঙ্গলবার সকালে

গাইবান্ধা জেলা শহর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে কাশিয়াবাড়ী গ্রাম। একই গ্রামে স্থাপিত বিদ্যালয়টি। পলাশবাড়ী উপজেলা শহর থেকে গ্রামের মেঠো পথ ধরে বিদ্যালয়ে যেতে হয়। বিদ্যালয়ের তিন দিকে প্রকৃতিঘেরা পরিবেশ। একদিকে কাশিয়াবাড়ী বাজার। পাশে কাশিয়াবাড়ী স্কুল অ্যান্ড কলেজ।

আজ মঙ্গলবার সকালে ওই বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, নাতি-নাতনির বয়সী শিশুদের সঙ্গে বসে পাঠ গ্রহণ করছেন আবদুল মান্নান। মনোযোগ দিয়ে পড়া শুনছিলেন। কখনো আশপাশে তাকাচ্ছেন। কখনো বই নাড়াচাড়া করছেন।

আবদুল মান্নান জানান, প্রতিদিন সকালে বই-খাতা-কলম হাতে নিয়ে নাতি মাহফুজার রহমানের ছেলে (স্থানীয় ভাষায় পুতি) কাওসার মিয়ার (৬) হাত ধরে বিদ্যালয়ে যান। প্রথম শ্রেণিতে তাঁর রোল নম্বর ৩৭।

শ্রেণিকক্ষে পাঠদান গ্রহণ করছেন ৬৫ বছর বয়সী আবদুল মান্নান

আবদুল মান্নান বলেন, অনেক আগেই তাঁর বাবা তছিম উদ্দিন ও মা মুসলিমা বেগম মারা যান। অভাবের সংসারে ছয় ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। সংসারে সব সময় অভাব লেগেই থাকত। লেখাপড়া করার সুযোগ পাননি। ছোটবেলা থেকে দিনমজুরের কাজ করেন। এরপর প্রায় দুই যুগ রিকশা চালান। একসময় বয়সের কারণে রিকশা চালাতে পারছিলেন না। বাধ্য হয়ে খিলি পান বিক্রি শুরু করেন। স্থানীয় বাজারে রাস্তার পাশে তাঁর ছোট্ট দোকান। এখানে চার বছর ধরে তিনি খিলি পান বিক্রি করছেন। সকালে বিদ্যালয়ে যান। বিকেলে ছুটির পর দোকানে বসেন। তাঁর দুই মেয়ে ও এক ছেলে। মেয়েদের বিয়ে হয়েছে আগেই। তাঁদের একজনের নাতি কাওসারের সঙ্গে বিদ্যালয়ে যান তিনি।

ওই বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির ছাত্র আহাদ বলে, আবদুল মান্নান তাদের নানার বয়সী। তারপরও তিনি তাদের সঙ্গে পড়ছেন। তাঁকে পেয়ে খুব ভালো লাগছে। প্রথম শ্রেণির অন্য ছাত্রছাত্রীরাও একই কথা বলে।

কাশিয়াবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মনিরুজ্জামান মণ্ডল বলেন, ‘তিনি দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য আমাকে অনুরোধ করে আসছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছর তাঁকে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়েছে। তাঁকে বইও দেওয়া হয়েছে। তিনি শিশু শিক্ষার্থীদের মতোই নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসেন। ক্লাসের শিশু ছেলেমেয়েরাও তাঁকে পেয়ে খুশি।’

কাশিয়াবাড়ী বাজারে নিজের দোকানে পান বিক্রি করছেন আবদুল মান্নান

পলাশবাড়ী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এ কে এম মোকসেদ চৌধুরী বলেন, দেরিতে হলেও আবদুল মান্নান লেখাপড়া শেখার প্রয়োজন মনে করেছেন, এটা খুব ভালো উদ্যোগ। এ বয়সে শিক্ষা গ্রহণ করে নিজে হিসাব রাখতে পারলে তাঁর কাজে লাগবে। তিনি বলেন, এই বৃদ্ধের পড়ালেখার প্রতি বিশেষভাবে নজর দিতে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে বলা হয়েছে।