Thank you for trying Sticky AMP!!

‘আবার সুদিন ফিরবে শীতলপাটির’

শীতলপাটি বুনছেন গীতেশ চন্দ্র। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ লোককারুশিল্প মেলায়

বাতাসে আমের মুকুলের গন্ধ আর দূর থেকে ভেসে আসা কোকিলের ডাক বলে দিচ্ছে প্রকৃতিতে চলছে বসন্তকাল। স্মৃতিকাতর হয়ে উঠেছেন ঝিনাইদহের শৈলকুপার স্কুলশিক্ষক আরিফুর রহমান। তিনি শৈলকুপা থেকে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে এসেছেন লোক ও কারুশিল্প মেলায়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা কারুপণ্য দেখতে এসে থামলেন কারুশিল্পী গীতেশ চন্দ্র দাসের শীতলপাটির দোকানে। সেখানেই আরিফুরের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।

শীতলপাটির দোকানে আসার কারণ বলতে গিয়েই স্মৃতি হাতড়াচ্ছিলেন আরিফুর। তিনি বলেন, ‘আমাদের ছেলেবেলায় ঘরে বসার আসন বলতেই ছিল কাঠের পিঁড়ি, বেতের মোড়া আর শীতলপাটি। শীত বা বসন্তের সকালে মক্তব শেষ করে এলে মা মুড়ি–চিড়া খেতে দিতেন। আমরা খাবার আর শীতলপাটি নিয়ে চলে যেতাম বাড়িলাগোয়া খোলা জমিতে। বাড়ির শিশু ও বৃদ্ধরা একসঙ্গে বসে রোদ পোহাতাম। খাবার খেতাম। কেউ সেখানে বসেই পড়াশোনা করত। আর গরমের দুপুর মানেই ছিল শীতলপাটি নিয়ে পুকুরপাড়ে বা গাছের ছায়ায় ঘুমিয়ে থাকা। আমাদের পড়াশোনা, ঘুম, অবসর—সবকিছুর সঙ্গেই শীতলপাটি জড়িয়ে আছে। এখন তো চেয়ার–টেবিল হয়েছে, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ এসেছে। শীতলপাটির আর দেখা মেলে না।’

শীতলপাটি–জড়ানো শৈশবের গল্প বলতে বলতেই গীতেশ চন্দ্রের দক্ষ হাতে বোনা কয়েকটি পাটি নেড়েচেড়ে দেখলেন আরিফুর রহমান। এবার দরদামের পালা। গীতেশ চন্দ্র পাঁচ বাই চার হাতের একটি পাটির দাম চাইলেন তিন হাজার টাকা। তাতেই যেন রীতিমতো ভিরমি খেলেন আরিফুর। বলেন কী! এই পাটি তিন হাজার!

পাটি না কিনেই চলে গেলেন আরিফুর। যেতে যেতে বললেন, তাঁরা এখন আর পাটি ব্যবহার করেন না। খুব প্রয়োজনে ব্যবহার করতে হলে দু–আড়াই শ টাকায় প্লাস্টিকের পাটি পাওয়া যায়।

আরিফুর আসার আগে নিজের দোকানে বসে গীতেশ চন্দ্রও ঠিক একই কথা বলছিলেন তাঁর মৌলভীবাজারের আঞ্চলিক ঢঙে। এখন সবাই কম দরের রেক্সিন আর প্লাস্টিকের পাটি কেনে। একসময় শীতলপাটি ছাড়া বিয়ে হতো না। এখন বিয়েতেও মানুষ প্লাস্টিকের পাটি দেয়। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ, চেয়ার–টেবিল, এসি; তার ওপর শীতলপাটির দাম অনেক বেশি। শীতলপাটি এখন আর কারও প্রয়োজন নয়, শখ। মানুষ শখ করে শীতলপাটি কেনে। কেবল শখে কোনো শিল্প টেকে না।

গীতেশ চন্দ্রের বাড়ি মৌলভীবাজারের রাজনগরের তুলাপুর গ্রামে। বংশপরম্পরায় ৬০ বছর ধরে শীতলপাটি বোনেন তিনি। তাঁর বাবা গিরীশ চন্দ্র দাস এবং তাঁরও পূর্বপুরুষেরা এই শীতলপাটি বুনেছেন বংশপরম্পরায়। শত শত বছর ধরে দক্ষ হয়ে ওঠা গীতেশ চন্দ্রদের হাত ধরেই ২০১৭ সালে বিরল সম্মান বয়ে আনে এই শীতলপাটি। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো সিলেটের শীতলপাটিকে বিশ্বের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান দেয়।

দক্ষিণ কোরিয়ার জেজু দ্বীপে অনুষ্ঠিত ইউনেসকোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সংরক্ষণে গঠিত আন্তর্জাতিক পর্ষদের সেই সভায় বুননশিল্পী হিসেবে গীতেশ চন্দ্রও অংশ নিয়েছিলেন। বিশ্ব ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে শীতলপাটির গল্প নিয়ে গিয়েছেন চীন, জাপান, নেপাল, ভারতসহ নানান দেশে। তবে তাতে গীতেশের আক্ষেপ যেন আরও বেড়েছে। বংশপরম্পরায় পাওয়া এই শৈল্পিক জ্ঞান তাঁর পরিবারের কাউকে আর দিয়ে যেতে পারেননি।

গীতেশ চন্দ্র বলছিলেন, ‘পাঁচ বাই সাত ফুটের একটা পাটি বুনতে এক মাস সময় লাগে। সর্বোচ্চ দাম পড়ে ছয় থেকে দশ হাজার টাকা। এত দরের পাটি কেউ কেনে না। মাসে দু-একটা পাটি বিক্রি হলেও তাতে সংসার চলে না। যন্ত্রে বোনা প্লাস্টিকের পাটির কাছে আমাদের হাতে বোনা শীতলপাটি হেরে গেছে। এ কারণে নতুন প্রজন্মের কেউ আর এ কাজ শেখে না। আমার একমাত্র ছেলেকেও শেখাতে পারিনি। পড়াশোনা করে সে এখন একটি কলেজে শিক্ষকতা করে। শত বছরে পাওয়া জ্ঞান আমার মৃত্যুর সঙ্গে শেষ হয়ে যাবে।’

তবে গীতেশ চন্দ্রের আশা, শীতলপাটির বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করার পাশাপাশি এই পণ্য বিদেশে রপ্তানি করা গেলে ‘আবার সুদিন ফিরবে শীতলপাটির’।

গীতেশ জানান, সিলেটসহ সারা দেশ থেকেই শীতলপাটি হারিয়ে যাচ্ছে। দুই দশক আগেও তাঁর গ্রাম তুলাপুর, পাশের গ্রাম বিলবাড়ি, সাদাপুর ও বেড়কুড়িতে হাজারো পরিবার শীতলপাটি বুনত। সেই গ্রামগুলোয় কেউ আর এখন পাটি বোনার কাজ করে না। হাতে গোনা দু-একটা পরিবার এই ঐতিহ্যকে এখনো ধরে রেখেছে।

কারুশিল্প মেলাতেই কথা হলো মৌলভীবাজারের আরেক বুননশিল্পী অজিত কুমার দাসের সঙ্গে। অজিত বলেন, তাঁর বাবা অশ্বিনী কুমার দাস, দাদা মুরাই রাম দাস, দাদার বাবা দ্বীপ রাম দাসসহ অন্তত আট থেকে দশ পুরুষ শীতলপাটি বুনেছেন।

বংশপরম্পরায় তিনি এ কাজ করলেও তার পাঁচ ছেলেমেয়ের কেউ এ কাজ শেখেননি।
বিশ্ব ঐতিহ্যের এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে করণীয় কী, তা জানতে চাই অজিত কুমারের কাছে। তিনি সরাসরি উত্তর দেন, ‘মানুষ কোনো দিন প্লাস্টিক, রেক্সিন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে, সৌন্দর্য আর শিল্পের মূল্যায়ন করলে এবং শীতলপাটির বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে হয়তো আবারও ফিরবে এই শিল্পের সুদিন।’