Thank you for trying Sticky AMP!!

আসামিপক্ষের নজরদারিতে নিহত সাইফুলের পরিবার, জীবন নিয়ে শঙ্কা

সাইফুল ইসলাম ওরফে রাসেল হত্যা মামলার প্রধান আসামি আফতাব উদ্দিন ওরফে রাব্বী

ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে রাতভর মারধর ও নির্যাতন করে সাইফুল ইসলাম ওরফে রাসেল হত্যা মামলা তুলে নিতে চাপ দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ তাঁর পরিবারের। ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের দাবি, জীবন নিয়ে শঙ্কায় আছেন তাঁরা। তাঁদের ও তাঁদের বাড়িতে আসা–যাওয়া করা সবাইকে নজরদারিতে রাখছেন সাইফুল হত্যাকাণ্ডের হোতা আফতাব উদ্দিন ওরফে রাব্বীর পরিবারের লোকজন।

এর মধ্যে মামলার প্রধান আসামি স্বেচ্ছাসেবক লীগ থেকে বহিষ্কৃত নেতা আফতাব উদ্দিন ওরফে রাব্বীসহ ১১ জনকে গ্রেপ্তারের তথ্য জানিয়েছে পুলিশ। আফতাব ছাড়া অন্য আসামিদের নাম প্রকাশ করা হয়নি। আগামীকাল বুধবার এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করা হবে জানিয়েছেন ঢাকা জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (কেরানীগঞ্জ সার্কেল) শাহাবুদ্দীন কবীর।

Also Read: কথা না শুনলেই তিনি ডাকেন ‘টর্চার সেলে’

এদিকে ঘটনার পর আফতাব উদ্দিন ও তাঁর বাবা শুভাঢ্যা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি বাছের উদ্দিনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিষয়ে সোচ্চার হয়েছেন এলাকাবাসী। তাঁরা বলছেন, বাবার পথ ধরে আফতাব নিজেও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, চাঁদাবাজি, জমি দখল, মাদক ব্যবসা চালিয়ে আসছিলেন। বাপ–বেটা মিলে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন।

নিহত সাইফুল ইসলাম ওরফে রাসেল

নজরদারিতে পরিবার

আজ মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জর শুভাঢ্যা ইউনিয়নের খেজুরবাগ নার্সারিপাড়া এলাকায় নিহত সাইফুল ইসলামের বাবার ভাড়া বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ঘরের এক কোণে সাইফুলের মা কুলসুম বেগম (৬০) বসে আছেন। তাঁর সঙ্গে রিনা বেগম নামের এক নারী বসে আছেন। ঘরে প্রবেশ করার পরপরই কুলসুম বেগম ইশারায় এ প্রতিবেদককে ওই নারীর সামনে কিছু না বলার সংকেত দেন।

কাঁদতে কাঁদতে কুলসুম বেগম বলেন, ‘বাবা (সাইফুল ইসলাম) আমার কই গেল? আমার কইলজাডা ছিঁড়া যায়। শেষবারের মতো পোলাডা আমার লগে দেহাও করতে পারল না। যারা আমার পোলারে মারসে, আল্লাহ তাগো সবাইরে দেখসে। আল্লাহ তাগো বিচার করব।’ সেখানে থাকা রিনা বেগম বলেন, ‘রাসেলের মায়রে দেখতে আইছি। কেউ আমারে পাঠায় নাই। এমনেই আইছিলাম। আর কতক্ষণ থাইক্যা চইল্যা যামু।’

Also Read: কেরানীগঞ্জে রাতভর নির্যাতনে যুবকের মৃত্যু, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতার বিরুদ্ধে মামলা

স্ত্রী–মেয়েকে হুমকি

বেলা আড়াইটার দিকে ইউনিয়নের চরকালীগঞ্জ এলাকায় নিহত সাইফুলের ভাড়া বাসায় গিয়ে দেখা যায়, তাঁর স্ত্রী মৌসুমি আক্তার (রিয়া) ও তাঁর মেয়ে জান্নাত আক্তার (১১) ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় ঘরে বসে আছেন। প্রতিবেদক নিজের পরিচয় দেওয়ার পর মৌসুমি আক্তার তাঁর স্বামীর বিদেশযাত্রার জন্য প্রস্তুত জামাকাপড়ের ব্যাগ দেখান। ওই ব্যাগ থেকে তিনি তাঁর স্বামীর ব্যবহার করা জামাকাপড় বের করে দেখান।

মৌসুমি আক্তার বলেন, ‘আমার স্বামীকে হত্যার পর থেকে আফতাব উদ্দিন রাব্বীর পরিবার আমাদের প্রতিনিয়ত হুমকি ও ভয়ভীতি দেখিয়ে আসছে। মামলা তুলে নিতে আমাদের ওপর বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে। তারা আমার মেয়ের ও আমার ক্ষতি করার হুমকি দিচ্ছে। ভয়ে মেয়ে স্কুলে যেতে পারছে না। মেয়ে ঘুমের মধ্যে ভয়ে চিৎকার দিয়ে ওঠে। আসামিদের লোকজন বিভিন্ন সময়ে কৌশলে বাড়িতে এসে আমাদের প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে যাচ্ছে।’

স্বামী সাইফুল ইসলামের লাগেজ (ব্যাগ) থেকে জামা কাপড় বের করে দেখাচ্ছেন মৌসুমি আক্তার। মঙ্গলবার দুপুরে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা ইউনিয়নের চরকালিগঞ্জ এলাকায়

নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন জানিয়ে মৌসুমি আরও বলেন, ‘আমাদের পরিবারের সদস্য ও স্বজনদের আফতাব উদ্দিন রাব্বীর বাবা আওয়ামী লীগ নেতা বাছের উদ্দিন ও তাঁর চাচা শুভাঢ্যা ইউপির চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেনের বাহিনীর লোকজন সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখছেন। সাদাপোশাকের পুলিশ, সাংবাদিক যাঁরাই আমাদের বাসায় আসছেন, তাঁদেরও তাঁরা নজরদারি করছেন। এ অবস্থায় কে সাংবাদিক, কে প্রশাসনের লোক—আমরা কাউকেই বিশ্বাস করতে পারছি না। আমাদের ঘরের দরজায় কেউ টোকা দিলে আমরা আঁতকে উঠি। আমরা ভয়ে কেউ বাসা থেকে বের হতে পারছি না। আমি মেয়েকে নিয়ে ভয়ে ভয়ে দিন কাটাচ্ছি।’

আফতাব উদ্দিন ও তাঁদের বাহিনীর লোকজনের ভয়ে স্কুলে যেতে পারছে না জানিয়ে সাইফুল ইসলামের মেয়ে জান্নাত আক্তার বলে, ‘১০ জানুয়ারি আমার স্কুলের যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভয়ে আমি স্কুলে যেতে পারি না। বাবাকে মারধরের ভিডিও দেখার পর মনে হয় কেউ ঘুমের মধ্যে আমার মাথায় হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করছে। একা থাকতেও ভয় পাই। আমি রাব্বীসহ আমার বাবার হত্যাকারীদের ফাঁসি চাই।’

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন আফতাব উদ্দিনের চাচা ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও শুভাঢ্যা ইউপির চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন। তিনি বলেন, রাসেলের (সাইফুল ইসলাম) পরিবারের সদস্যদের হুমকি দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। বরং তাদের কেউ হুমকি দিলে প্রমাণ সাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাবা শুভাঢ্যা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি বাছের উদ্দিনের সঙ্গে আফতাব উদ্দিন

বাপ–বেটার ত্রাসের রাজত্ব

সাইফুল ইসলামকে হত্যার পর আফতাব উদ্দিন ও তাঁর বাবা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি বাছের উদ্দিনের বিষয়ে মুখ খুলতে শুরু করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তাঁদের ভাষ্য, রাজনৈতিক পদ ও ক্ষমতা ব্যবহার করে শুভাঢ্যা ইউনিয়নে তাঁরা গড়ে তুলেছেন ত্রাসের রাজত্ব।

স্থানীয় বাসিন্দাদের কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বাছের উদ্দিন ২০০৮ সাল থেকে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতির পদে আছেন। তাঁর ভাই হলেন ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং এ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন। ভাই ও নিজের রাজনৈতিক পদের দাপটে বাছের ও তাঁর ছেলে আফতাব উদ্দিন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, মাদক ব্যবসা, জমি দখল, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপকর্ম করে কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা।

বাবার একমাত্র সন্তান আফতাব উদ্দিন কোনোমতে এসএসসি পাস করেই জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতে। ২০২৩ সালের দিকে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা ছাত্রলীগের সম্মেলনে তিনি সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী হয়েছিলেন। তবে তিনি কাঙ্ক্ষিত পদ পাননি। পরে আওয়ামী লীগ নেতা বাবা–চাচার ক্ষমতায় দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ বাগিয়ে নেন বলে অভিযোগ আছে।

স্থানীয়রা জানান, স্বেচ্ছাসেবক লীগে পদ পাওয়ার পর আফতাব আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। বাবা ও বেটা মিলে শুভাঢ্যা ইউনিয়নে গড়ে তোলেন তাঁদের ‘আব্বা’ বাহিনী। এ বাহিনী দিয়ে তাঁরা কেরানীগঞ্জ গার্মেন্টসপল্লির আগানগর, পূর্ব আগানগর, খেজুরবাজ, কালীগঞ্জ, চরকালীগঞ্জ, কালীগঞ্জ ডকইয়ার্ড, নুরু মার্কেট, গুদারাঘাট ও সদরঘাট এলাকায় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা তুলতেন।

পূর্ব আগানগর এলাকার পোশাক ব্যবসায়ী সামাদ হাওলাদার বলেন, ‘রাব্বীর বাহিনীর অত্যাচারে আমরা শান্তিতে ব্যবসা করতে পারছিলাম না। সে (আফতাব) তার সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে ব্যবসায়ীদের হুমকি দিয়ে চাঁদা আদায় করত।’

পারগেন্ডারিয়া ও মীরেরবাগ এলাকার একাধিক বাসিন্দা জানান, আফতাব ও তাঁর বাবা বাছের উদ্দিন আব্বা বাহিনীর লোকজনদের দিয়ে খেজুরবাগ, সাতপাখি, তেলঘাট, বড়ইতলা, পারগেন্ডারিয়া, আগানগর, ডকইয়ার্ডসহ কয়েকটি এলাকায় মাদকের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন। বাছের উদ্দিন জমির সালিসের নামে জমির মালিকদের হুমকি দিয়ে কম দামে জমি কিনে নিতেন।

এ বিষয়ে জানতে বাছের উদ্দিনের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও সংযোগ বন্ধ পাওয়া যায়।