Thank you for trying Sticky AMP!!

ইয়াসে ক্ষতি প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা

মূলত স্থায়ী ও টেকসই বাঁধের অভাবে উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও পূর্ণিমার প্রভাবে প্রবল বেগে লোকালয়ে পানি ঢুকছে। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সোনাইছিড় ইউনিয়নের ঘোড়ামরা এলাকায়

ঘূর্ণিঝড় ইয়াস মূলত আঘাত হেনেছিল ভারতের ওডিশায়। এর প্রভাবে দেশের উপকূলীয় এলাকায় স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েক ফুট বেশি উঁচু জোয়ার হয়েছিল। জোয়ারের পানিতে লোকালয় তলিয়ে যাওয়ায় মোট ২ হাজার ৯৫১ কোটি ৭০ লাখ ৩০ হাজার ৬২৭ টাকার ক্ষতি হয়েছে। মাঠপর্যায় থেকে তথ্য নিয়ে এই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়।

উপকূলীয় এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা ও দুর্যোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত স্থায়ী ও টেকসই বাঁধের অভাবে উপকূলীয় এলাকায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়েছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বাঁধগুলো নির্মিত হয়েছিল ষাটের দশকে। সিডর, আইলা, মহাসেন, আম্পানের মতো একের পর এক ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে বাঁধগুলো অনেকটাই জরাজীর্ণ। বাঁধ সংস্কারে বড় কোনো উদ্যোগও নেওয়া হয়নি। ফলে অল্পতেই অনেক বেশি ক্ষতি হচ্ছে।

চলতি বছরের ২৬ মে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ভারতে আঘাত হেনেছিল। এর প্রভাবে বাংলাদেশের ১৫টি জেলার ৭৭টি উপজেলা ও ১৩টি পৌরসভায় ক্ষয়ক্ষতি হয়, মৃত্যু হয় ৭ জনের। ঝড়ের পর থেকে চলতি বছরের ১৭ জুন পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ১৩ লাখ ৬৩ হাজার ৯৬০ জনকে বিভিন্ন ধরনের মানবিক সহায়তা দিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। ক্ষয়ক্ষতির সরকারি এই হিসাব সম্প্রতি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে উপস্থাপন করা হয়েছে।

ইয়াসের প্রভাবে যখন জোয়ারের উচ্চতা বেড়েছিল, তখন দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় স্থানীয় জনগণকে বাঁধ রক্ষার লড়াইয়ে নামতে দেখা গিয়েছিল। ঝড়ের পর এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে স্থানীয়দের তোপের মুখেও পড়েছিলেন একাধিক সাংসদ। এরপর গত জুন মাসে জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে বাঁধের দাবিতে গলায় প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে বক্তব্য দেন পটুয়াখালী-৩ (গলাচিপা-দশমিনা) আসনের আওয়ামী লীগের সাংসদ এস এম শাহজাদা। তাঁর প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, ‘আর কোনো দাবি নাই, ত্রাণ চাই না বাঁধ চাই’।

ইয়াসের প্রভাবে খুলনার উপকূলীয় এলাকায় নদীতে জোয়ারের পানির উচ্চতা সাত থেকে আট ফুট বেড়ে গিয়েছিল। এতে খুলনা জেলার কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা ও বটিয়াঘাটা উপজেলার বিভিন্ন এলাকার বেড়িবাঁধ ভেঙে ও বাঁধ উপচে অর্ধশতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়। দু-এক দিনের মধ্যেই এলাকাবাসী স্বেচ্ছাশ্রমে ওই ভাঙা বাঁধ মেরামত করেন। কয়রা উপজেলার শাকবাড়িয়া নদীর বাঁধ এখনো ভাঙা থাকায় নিয়মিত জোয়ারের সময় গাতির ঘেরি গ্রামের একটি অংশে পানি ঢোকে।

ইয়াসে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের অনেকে এর আগে আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। তাঁদের একজন সঞ্জয় সরকার। শাকবাড়িয়া নদীর ধারে ছিল তাঁর মাছের ঘের। আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর এক যুগ ধরে একটু একটু করে গুছিয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু নদীর বাঁধ ভেঙেছে একেবারে তাঁদের বাড়ির পাশ দিয়েই। ইটের তৈরি ঘর ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে। এখন পরিবার নিয়ে তাঁর আশ্রয় হয়েছে বাঁধের ওপর।

* চলতি বছরের ২৬ মে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস মূলত ভারতে আঘাত হেনেছিল। * ১ লাখ ২০ হাজার ৭১২টি খানা (পরিবার) ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

সঞ্জয় সরকার বলেন, সবই ছিল, কিন্তু এখন কিছুই নেই। অধিকাংশই ভেসে গেছে। বাঁধের ওপর তৈরি করা খুপরিতেই সংসার পেতেছেন তিনি।

কয়রা এলাকাটি পড়েছে সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগ-২-এর আওতায়। এই বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাশিদুর রহমান বলেন, ইয়াসের প্রভাবে কয়রায় ৬টি স্থানের ১১টি পয়েন্টে ৬৪০ মিটার বাঁধ ভেঙে গেছে। এর মধ্যে গাতির ঘেরি ছাড়া সব কটিই মেরামত করা হয়েছে। ওই স্থানে মূলত বাঁধের কাজ করবে জাইকা। সংস্থাটি ইতিমধ্যে ঠিকাদার নিয়োগ করেছে, লোক নিয়োগ করে কাজ এগিয়ে নিচ্ছে।

কত ক্ষতি

ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে সারা দেশে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, মাঠপর্যায় থেকে এর বিস্তারিত তথ্য নিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। গত ২২ জুন ক্ষয়ক্ষতির হিসাব চূড়ান্ত করে মন্ত্রণালয়। তাতে দেখা যায়, ইয়াসের প্রভাবে দেশে মোট ১ লাখ ২০ হাজার ৭১২টি খানা (পরিবার) ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাকা, আধা পাকা ও কাঁচা ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫৩ হাজার ৪৩৪টি। ২ হাজার ৮৭১টি গবাদিপশু (ভেড়া, ছাগল, গরু ও মহিষ) ভেসে যায়। হাঁস-মুরগি ভেসে যায় ১৮ লাখ ৫৩ হাজার ৬৬৪টি। শস্যখেতের ক্ষতি হয়েছে ৮ হাজার ৬২ হেক্টর, ১ হাজার ১২৭ হেক্টর বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হ্যাচারি, মৎস্য ও চিংড়িঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২ হাজার ১৯৯ দশমিক ১৮ হেক্টর।

ইয়াসের প্রভাবে উঁচু জোয়ারে দেশের বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকায় মোট ৫ হাজার ৬২৭ দশমিক ১৯ কিলোমিটার বাঁধের ক্ষতি হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ লাইনের ক্ষতিও হিসাবে যুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে মন্ত্রণালয়ের হিসাবে ২২১ দশমিক ২৯ কিলোমিটার বিদ্যুতের লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইয়াসে। ৩০০টি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ২০২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ৭টি হাসপাতাল, ৮টি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইয়াসের ফলে ৩৬৯ দশমিক ৯৫ কিলোমিটার পাকা সড়ক, ৩১৬ কিলোমিটার ইট বা খোয়া নির্মিত সড়ক, ১ হাজার ৫৪৮ কিলোমিটার কাঁচা সড়ক, ১২২টি ব্রিজ-কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের ১ হাজার ৬৮০টি নলকূপ, ১১ হাজার ২৭০টি স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার, ৭ হাজার ৬৯৩টি পুকুর বা জলাশয়, ২৩০টি নৌকা ও ৫৮০টি মাছ ধরার উপকরণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ক্ষয়ক্ষতির যে হিসাব করা হয়েছে, তা যদি সঠিক হয়, তাহলে বলতে হবে, প্রাকৃতিক বিপর্যয় যতটুকু হয়েছে, তার চেয়ে ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেশি হয়েছে। এর একটাই কারণ, উপকূলীয় বাঁধগুলো অরক্ষিত। তিনি বলেন, ১৯৫০ সালের পর উপকূলীয় বাঁধ সংস্কারে নব্বইয়ের দশকে বড় ধরনের কাজ হয়েছিল। এর পর থেকে ধারাবাহিক উপেক্ষা ও উদাসীনতা দেখা গেছে। ঘূর্ণিঝড় আইলা বাঁধের ব্যাপক ক্ষতি করেছিল। কিন্তু এরপর সংস্কারে বড় পদক্ষেপ দেখা যায়নি। বাঁধ সংস্কারে সরকার জোরালো পদক্ষেপ নিলে ক্ষতি অনেক কম হতো। এটা সরকারের অনুধাবন করা উচিত।

[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, খুলনা।]