Thank you for trying Sticky AMP!!

একটি পাখির অসামান্য ভ্রমণ

গিরিয়া হাঁস কিশোয়ার পিঠে বসানো হচ্ছে জিপিএস। গত বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি। ছবি: লেখক

কিশোয়ার কথা মনে পড়ে গেল। কিশোয়া একটি হাঁসের নাম। মেয়ে গিরিয়া হাঁস। মনে না পড়ে উপায় কী! আজ বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবস। তার ওপরে ‘পাখিতে যুক্ত সমগ্র বিশ্ব’ এবারে দিবসটির প্রতিপাদ্য। কিশোয়ার দেখা পেয়েছিলাম আমরা টাঙ্গুয়ার হাওরে।

সময়টা ২০১৯ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল এ পাখির পরিযায়ন রহস্য বের করা। ওর ওজন মাত্র ৩০০ গ্রাম। কিশোয়ার পিঠে ১০ গ্রাম ওজনের একটি জিপিএস লগার বসিয়ে দেওয়া হলো। পৃথিবীজুড়েই পাখির পরিযায়ন দেখতে এ পদ্ধতি ব্যবহার করেন বিজ্ঞানীরা। বাংলাদেশেও ২০১৯ সাল থেকে পদ্ধতিটি ব্যবহৃত হচ্ছে। আইইউসিএন বাংলাদেশ ওয়াইল্ড বার্ড মনিটরিং প্রোগ্রামের আওতায় কাজটি চলছে। সহায়তা করছে সুইডেনের লিনিয়াস বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক। জিপিএস লগার বসানোর পর থেকে আজ কিশোয়ার ভ্রমণের ৪৫৮তম দিন। ছোট্ট এই পাখির ভ্রমণলিপি সত্যিই অবাক করে দেওয়ার মতো।

৫ ফেব্রুয়ারির পর সে বছরের শীতের মৌসুমে কিশোয়া ৯০ দিন কাটিয়েছে বাংলাদেশে। টাঙ্গুয়া ছাড়াও খাবারের সন্ধানে ঘুরে বেরিয়েছে পশুয়াসহ বিভিন্ন হাওর-বাঁওড়ে। তবে বেশির ভাগ সময়ই রাতযাপন করেছে টাঙ্গুয়াতেই।

কিশোয়া পরিযায়ন শুরু করল গত বছরের ৫ মে। প্রথমে পাড়ি দিল হিমালয় পর্বতমালা। যেকোনো পাখির জন্যই হিমালয় পাড়ি দেওয়া কঠিনতম এক কাজ। ওই পথ সে পাড়ি দিল ১০ দিনে। এই যাত্রায় কিশোয়া সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সর্বোচ্চ ৫ হাজার ৬৬৫ মিটার উঁচু পর্যন্ত উঠেছিল। উড়েছিল ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৭৪.৪ কিলোমিটার বেগে। যাত্রাপথে বিশ্রাম নিয়েছিল তিনটি জায়গায়। হিমালয় পাড়ি দিয়ে সে আবাস গাড়ল চীনের কুইনহাই প্রদেশের সুলি লেকে। চলাচলের পথরেখা দেখে বোঝা গেল, সে বাসা বেঁধেছে একটি হ্রদের তীরে। সময়টা প্রজননকালের। প্রজননকালীন ৪ মাস ৭ দিন সময় সে ওখানেই কাটাল।

এর পরপরই ২০১৯ সালের ১১ অক্টোবর আবার রওনা দিল বাংলাদেশের দিকে। ১২ অক্টোবর পৌঁছোল জিগেলাং হ্রদে। এখানে এক দিনের বিশ্রাম। ১৩ অক্টোবর হিমালয় পাড়ি দিয়ে ভুটান সীমান্তে। ছোট্ট একটি পাখির এত দ্রুত হিমালয় অতিক্রম করা ছিল বিস্ময়কর।

১৪ অক্টোবর কিশোয়া যমুনা-তীরবর্তী সিরাজগঞ্জের দুর্গাপুরে আসে। নদীতে অনেক পানি। এতে দেখা দিল খাবারের সমস্যা। তাতে ১৫ অক্টোবর চলে এল পাবনার সুজানগরে। এরপর পরের একটি মাস কাটাল পদ্মা আর যমুনায়।

এ বছরের ২৩ জানুয়ারি কিশোয়া আবার ফিরে এল টাঙ্গুয়ার হাওরে। এটাই তার খাদ্যের প্রধান জায়গা। এন্তার কচি ঘাস আর পোকামাকড়। এখানে বিশ্রামে কাটল ২ মাস ২১ দিন।

>

এটি একটি পাখির গল্প
প্রতিবছর কিশোয়ার মতো লাখ লাখ পরিযায়ী পাখি আসে
প্রত্যেকের গল্পই ভিন্ন ভিন্ন

কিশোয়া ১৪ এপ্রিল আবার ওর পরিযায়ন শুরু করে হিমালয়ের কাছে যায়। এবারে অবশ্য পর্বত পাড়ি দিল না। ২০ এপ্রিল আবার ফিরে এল টাঙ্গুয়ার হাওরে। সময়টা ধান কাটার মৌসুম। খাবার তাই পর্যাপ্ত। তা ছাড়া করোনার প্রকোপে এ বছর মানুষের যাতায়াতও কম। ফলে কিশোয়ার মতো সব পরিযায়ী পাখিরই যাচ্ছে দারুণ সুসময়।

৫ মে অবশ্য কিশোয়া আবার ওর চূড়ান্ত পরিযান শুরু করেছে। গতকাল ছিল আসামের পাগলাগিয়া নদীর চাড়ানজঙ্গল এলাকায়। আজ সম্ভবত হিমালয় পাড়ি দিতে শুরু করবে।

৪৫৮ দিনের দীর্ঘ পর্যটনে কিশোয়া উড়েছে বাংলাদেশ, ভারত, চীন ও ভুটান সীমান্তবর্তী প্রায় ৯ হাজার ৫০৫ কিলোমিটার পথ। থেকেছে টাঙ্গুয়ার মতো ২৬টি জলাভূমিতে। খাদ্যের সন্ধানে গেছে সাত ধরনের জলাশয়ে। খাবারের সন্ধানে বাংলাদেশেই ভ্রমণ করেছে প্রায় ৯০টি জলাভূমি।

এটি একটি পাখির গল্প। প্রতিবছর কিশোয়ার মতো লাখ লাখ পরিযায়ী পাখি আসে। প্রত্যেকের গল্পই ভিন্ন ভিন্ন। কিশোয়ার পরিযায়ন দেখে মনে হয় পৃথিবী কত নাগালে। পরিযায়ী পাখিরা কিন্তু বিদেশি নয়, এরা বাংলাদেশেরই পাখি। পাখির কোনো দেশ নেই। ওরা বিশ্ব নাগরিক। পুরো পৃথিবীই তাদের দেশ।