Thank you for trying Sticky AMP!!

ক্যাম্পাসে শিয়ালের দিনরাত্রি

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠ এখন একটি শিয়াল–পরিবারের বিনোদনকেন্দ্র। ছবি: লেখক

২০২০ সালকে প্রাণ-প্রকৃতির ‘কামব্যাক ইয়ার’ বলেই মনে হচ্ছে। প্রায় দম বন্ধ হয়ে আসা প্রকৃতির একটু নিশ্বাস নেবার সুযোগ তৈরি হয়েছে করোনা মহামারিতে মানুষের সদর্প চলাচল সীমিত হয়ে পড়ায়। মানুষ হয়েছে ঘরবন্দী, আর প্রাণ-প্রকৃতি মেলেছে ডানা। পৃথিবীর নানা শহরে মানুষহীন শহরের রাস্তাঘাটে প্রাণীর চলাচলের খবর উঠে আসছে তথ্যমাধ্যমে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস প্রাণ-প্রকৃতির জন্য অবারিত। তবু শিক্ষক–শিক্ষার্থীর পদচারণমুখর ক্যাম্পাসের রাস্তাঘাট এখন নির্জন। ছাত্রদের উপস্থিতিতে সরগরম লেকপাড়ের রাস্তা এখন সুনসান। ক্যাম্পাস এখন সজীব আর সক্রিয় প্রাণ-প্রকৃতির দখলে।

গৃহবন্দী অবস্থার অবসাদ কাটাতে মাঝেমধ্যে এই রাস্তায় এসে দাঁড়াই। সব অচেনা লাগে। কোথাও কেউ নেই। দূরে রাস্তায় কুকুর ইতস্তত ঘোরাফেরা করে। ওরাও বড় নিঃসঙ্গ। নিয়মিত খাবার পেয়ে মামা-খালাদের সঙ্গে ওদের যে সখ্য গড়ে উঠেছিল, এরা বোধ করি তার অভাব বোধ করছে। জনমানবহীন রাস্তায় এরাই এখন ক্যাম্পাসের অন্যতম বাসিন্দা।

মানুষের চলাচল কমে যাওয়ায় ক্যাম্পাসে আরেক বাসিন্দা এসে জুটেছে। এরা আমাদের অতিপরিচিত শিয়াল। বেশ ফুরফুরে মেজাজে দিনাতিপাত করছে।

শিয়াল এমনিতে মূলত নিশাচর। সারাটা দিন নির্জন কোনো গর্তে বা ঝোপঝাড়ে ঘুমিয়ে কাটায়। সন্ধ্যার দিকে আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠে রাতের অভিযানের প্রস্তুতি নেয়। প্রায় সাত শ একরজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের দ‌ক্ষিণে পর্যাপ্ত ঝোপঝাড় থাকায় সেখানে পাতিশিয়ালের বসবাস দীর্ঘদিনের। ক্যাম্পাস জনবহুল হয়ে ওঠায় অন্য বন্য প্রাণীর মতো এরাও কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল। করোনাকাল এদের জন্য বয়ে এনেছে সুসময়।

ক্যাম্পাসের দ‌ক্ষিণে জীববিজ্ঞান অনুষদের বিপরীত দিকের যাত্রীছাউনির নিয়মিত পাহারাদার ছিল দুটি কুকুর। লকডাউনের শুরুতেও এদের সরব উপস্থিতি দেখেছি। বেশ অনেক দিন আর দেখছি না। দিনের বেলায় এখন দলবলে এলাকা রেকি করে বেড়ায় শিয়ালের দল। চিরশত্রু কুকুরগুলো এলাকা ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে। দিবানিদ্রা দিতে শিয়ালকে এখন আর ঝোপঝাড় বা গর্তবাসী হতে হয় না। দিনের বেলায় ওরা দিব্যি খোলা মাঠে বা রাস্তার ওপরে শুয়ে-বসে অলস সময় কাটাচ্ছে। নির্জন ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে নিরাপত্তাপ্রহরীদের পাশাপাশি। চলনে-বলনে কারও প্রতি কোনো তোয়াক্কা নেই।

ক্যাম্পাসের স্থায়ী বাসিন্দা এই শিয়ালগুলো করোনাকালে বেশ রোমান্টিক সময়ই পার করেছে। মাসখানেক আগে একটি শিয়াল–পরিবারে চারজন নতুন সদস্য যোগ হতে দেখলাম। খাবারদাবার মনে হয় পর্যাপ্তই পাচ্ছে। বেশ নাদুসনুদুস চেহারা। সন্ধ্যা নামলেই উচ্ছিষ্টের খোঁজে আবাসিক এলাকার আশপাশে এদের ঘোরাঘুরি আগের চেয়ে ঢের বেশি চোখে পড়ে।

বঙ্গবন্ধু হলের দ‌ক্ষিণ পাশের খেলার মাঠ এখন এই শিয়াল–পরিবারের দখলে। সন্ধ্যার আগে পারিবারিক নানা খুনসুটিতে মেতে ওঠে ওরা। ছেলেমেয়েদের শারীরিক কসরত আর শিকারের কৌশল শিখিয়ে সময় পার করছে মা-বাবা। খেলার মাঠে ঘাস গজিয়েছে। সেটা এখন ওদের বিনোদনকেন্দ্র।

শিয়াল সাধারণভাবে পরিবেশবান্ধব একটি প্রাণী। একসময় বাংলাদেশের গ্রামগুলোর ঝোপঝাড়ে হরহামেশা এদের দেখা যেত। কালেভদ্রে হাঁস-মুরগি চুরির কুখ্যাতি থাকলেও শস্যের জন্য ক্ষতিকর ইঁদুর নিয়ন্ত্রণে শিয়ালের ভূমিকা বিরাট। মানুষের উচ্ছিষ্ট আর মরা প্রাণী খেয়ে এরা পরিবেশও পরিচ্ছন্ন রাখে।

লেখক: অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়