Thank you for trying Sticky AMP!!

নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত

নদীভাঙনে হারিয়ে গেছে বাড়িঘর। ত্রাণের আশায় দাঁড়িয়ে আছে শত শত মানুষ। রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার পাইকান গ্রাম থেকে গতকাল তোলা ছবি l মঈনুল ইসলাম

অব্যাহত বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, যমুনা, করতোয়াসহ দেশের প্রধান নদ-নদীর পানি বেড়েই চলেছে। বেড়েছে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বন্যাকবলিত জেলাগুলোর অভ্যন্তরীণ নদীগুলোর পানিও। এতে প্লাবিত হয়েছে আরও নতুন নতুন এলাকা। অবনতি ঘটেছে বন্যার। এই অবস্থায় দুই সপ্তাহ ধরে চলা বন্যার শিগগিরই উন্নতির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। দীর্ঘতর হচ্ছে বানভাসি লাখো মানুষের কষ্ট ও দুর্ভোগ।
এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বরাত দিয়ে গতকাল বাসস জানায়, ব্রহ্মপুত্রে ২৭ সেন্টিমিটার, তিস্তায় ৩০ সেন্টিমিটার, করতোয়ায় ৩২ সেন্টিমিটার ও ঘাঘটে ৩২ সেন্টিমিটার পানি বেড়েছে। আগামী ৭২ ঘণ্টায় লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, বগুড়া, রংপুর, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, টাঙ্গাইল, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, মুন্সিগঞ্জ, রাজবাড়ী ও ফরিদপুরে বন্যার অবনতি অব্যাহত থাকতে পারে।
কুড়িগ্রামে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা, দুধকুমারসহ জেলার ১৬টি নদ-নদীর পানি বেড়েছে। প্লাবিত হয়েছে নতুন নতুন চর, দ্বীপচর ও গ্রাম। গতকাল ব্রহ্মপুত্র বিপৎসীমার ৪০ সেন্টিমিটার ও ধরলা ৪৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।
জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা মিজানুর রহমান জানান, পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় আরও তিনটিসহ ৫৬টি ইউনিয়নের ৩৫৩ গ্রামের মানুষ এখন পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩৩ হাজার ৫২টি পরিবার, ১৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ২৩ কিলোমিটার বাঁধ।
গত ১৩ দিন পানিবন্দী হয়ে থাকা এ জেলার বানভাসি মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে তীব্র খাদ্য ও পানির সংকট। পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় জেলা প্রশাসক এ বি এম আজাদ আজ শুক্রবার এক জরুরি সভা আহ্বান করেছেন। ওদিকে ত্রাণ ঘাটতির কারণে দুর্গত লোকজনের সবাইকে ত্রাণ দেওয়া যায়নি বলে জানান বেরুবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মমিনুর রহমান। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্র জানায়, বন্যায় তলিয়ে গেছে ৩১ হাজার ২৩৬ হেক্টর জমির সবজি ও ফসল।
বন্যার অবনতি হয়েছে গাইবান্ধাতেও। জেলায় ব্রহ্মপুত্রের পানি ২২ সেন্টিমিটার, তিস্তার ৩০ সেন্টিমিটার, করতোয়ার ৩২ সেন্টিমিটার ও ঘাঘটের ৩৬ সেন্টিমিটার বাড়ে। ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপৎসীমার ১৭ সেন্টিমিটার ও ঘাঘটের পানি ৫৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। করতোয়া ও তিস্তার পানি বিপৎসীমা ছুঁই ছুঁই করছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি, সাঘাটা ও গাইবান্ধা সদর উপজেলার ২৯টি ইউনিয়নের নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৬ হাজার ৫৪টি বাড়িঘর। বন্ধ রয়েছে ১৭৮টি প্রাথমিক ও নয়টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়।
এ জেলায় পানিবন্দী লোকের সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ। চলছে খাবার, পানি, জ্বালানি ও গবাদিপশু খাদ্যের সংকট। নদীভাঙনে গত এক দিনেই ফুলছড়ির সিংড়িয়া এলাকায় বিলীন হয়েছে ৩৫টি বাড়ি। হুমকির মুখে আছে সিংড়িয়া-রতনপুর বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ।
জামালপুরের বন্যা পরিস্থিতিও ভয়াবহ। এখানে যমুনা বিপৎসীমার ৬০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলার ৪০টি ইউনিয়নের দেড় লক্ষাধিক মানুষ এখন পানিবন্দী। গতকাল দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার সানন্দবাড়ী এলাকায় বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে নতুন করে ২০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। মেলান্দহ-মাহমুদপুর সড়কের চারালদার এলাকার ডাইভারশন তলিয়ে গিয়ে সড়কটিতে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। ছড়িয়ে পড়েছে পানিবাহিত রোগবালাই। দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ বলেন, এই উপজেলা পরিষদের চত্বরে নৌকা চলছে। সরিষাবাড়ীতে ২৩টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান রয়েছে বন্ধ।
কয়েক দিন স্থিতিশীল থাকার পর সিরাজগঞ্জে গতকাল যমুনার পানি আবার বাড়ে। এতে যেসব এলাকা থেকে পানি নামতে শুরু করেছিল, সেসব এলাকায় আবার পানি ঢুকেছে। সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষা বাঁধের হার্ড পয়েন্টে নদীর পানি বিপৎসীমার ২৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে বালুঘুঘরি, রানীগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ দিয়ে পানি চুইয়ে পড়ছে। এ প্রসঙ্গে জেলা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী বাবুল চন্দ্র শীল বলেন, ‘বর্তমানে আমরা সবাই আতঙ্কিত। বিভিন্ন স্থানে বালুর বস্তা ফেলা হচ্ছে।’ রায়গঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফিরোজ শাহ্ বলেন, উপজেলাটিতে প্রায় ৭৫০ হেক্টর জমির আমন ধান ডুবে গেছে।
বগুড়ার ধুনটে যমুনার পানি ২১ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৯২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বাঙ্গালী ও ইছামতীর পানিও বেড়ে যাওয়ায় জনমনে বেড়েছে আতঙ্ক। উপজেলার ভান্ডারবাড়ী ইউনিয়নের ১২টি গ্রামের চার হাজার পরিবার নতুন করে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। গ্রামগুলোর ছয়টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তলিয়ে যাওয়ায় সেগুলোতে পাঠদান রয়েছে বন্ধ।
নীলফামারীতে গতকাল তিস্তার পানি সামান্য কমে তা বিপৎসীমার পাঁচ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। টানা ১৩ দিন পানিবন্দী হয়ে থাকলেও প্রয়োজনীয় ত্রাণসামগ্রীর অভাবে দুর্গত মানুষ অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাচ্ছে।
রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ পয়েন্টে পদ্মার বিপৎসীমার ১৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) এস এম মনোয়ার আহম্মেদ বলেন, নদীভাঙনের শিকার হয়ে দেবগ্রাম ইউনিয়নের ২০০ পরিবার অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। পানিবন্দী হয়ে রয়েছে প্রায় আড়াই হাজার পরিবার। দৌলতদিয়া ইউনিয়নে নদীভাঙনের শিকার হয়েছে আরও ৪০টি পরিবার।
মুন্সিগঞ্জে পদ্মার পানি গতকালও বেড়েছে। জেলার ছয় উপজেলার মধ্যে টঙ্গিবাড়ী, লৌহজং ও গজারিয়ার নিম্নাঞ্চলের মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। বাঁশ, বেড়া ও বালুর বস্তা দিয়ে নদীভাঙন থেকে রক্ষার চেষ্টা করা হচ্ছে টঙ্গিবাড়ীর বড়াইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন: নিজস্ব প্রতিবেদক, কুড়িগ্রাম ও সিরাজগঞ্জ এবং গাইবান্ধা, নীলফামারী, মুন্সিগঞ্জ, জামালপুর, সরিষাবাড়ী, রাজবাড়ী, গোয়ালন্দ, রায়গঞ্জ ও ধুনট (বগুড়া) প্রতিনিধি]