Thank you for trying Sticky AMP!!

বংশী তুরাগ ধলেশ্বরী বিপন্ন

সাভারে মতবিনিময় সভায় বক্তব্য দেন সাবের হোসেন চৌধুরী। ছবি: প্রথম আলো

দখল–দূষণে অস্তিত্ব হারাচ্ছে বংশী, তুরাগ, ধলেশ্বরী নদীসহ ঢাকার সাভারের বিভিন্ন এলাকার খালবিল। মরে ভেসে উঠছে নদীর মাছ। অনাবাদি হয়ে পড়েছে ফসলি জমি। ছিদ্র হয়ে যাচ্ছে ঘরের চালা। জন্ডিস, চর্ম, হাঁপানি ও শ্বাসকষ্টের মতো নানা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিচ্ছে। বেকার হয়ে পড়ছেন কৃষক ও জেলে।

‘পরিবেশদূষণে বিপর্যস্ত সাভার, উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় গতকাল বুধবার এসব তথ্য তুলে ধরেন ভুক্তভোগীরা। জার্মান দূতাবাসের সহযোগিতায় বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা), নিজেরা করি, এএলআরডি ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এই মতবিনিময়ের আয়োজন করে।

সাভারের গলফ ক্লাব মিলনায়তনে সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী। বিশেষ অতিথি ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য রেজাউল করিম ও সাংসদ খোদেজা নাসরিন আক্তার হোসেন। এতে সভাপতিত্ব করেন বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। সভা পরিচালনা করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সাভার নদী ও পরিবেশ উন্নয়ন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক।

চামড়াশিল্প নগরের পাশের এলাকা সাভারের ফুলবাড়িয়া গ্রামের ভুক্তভোগী শাহানাজ বেগম বলেন, তাঁর গ্রামসহ আশপাশের অন্তত ১০টি গ্রামের মানুষের সুখ কেড়ে নিয়েছে ট্যানারি। একসময় যাঁর দুই বিঘা জমি ছিল, তাঁর ঘরে কোনো অভাব থাকত না। এখন পাঁচ বিঘা জমির মালিকও ভাত পান না। বর্জ্যের ক্ষতিকর প্রভাবে প্রায় সব জমি অনাবাদি হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, ট্যানারি বর্জ্যের প্রভাবে চালের টিন ফুটো হয়ে যাচ্ছে। মরে ভেসে উঠছে নদীর মাছ। বেকার হয়ে পড়ছেন এলাকার কৃষক–জেলেরা।

কোন্ডা এলাকার সোহেল আহম্মেদ বলেন, তাঁর ১০ বিঘা জমিতে একসময় প্রচুর ধান হতো। কিন্তু আমিনবাজারের ওয়েস্ট ডাম্পিং সাইটের কারণে ওই সব জমিতে কোনো ফসল হয় না। এলাকায় মশা-মাছির উপদ্রব বেড়ে গেছে। কর্ণপাড়া এলাকার ইয়াসমিন আক্তার বলেন, দখলদারদের কারণে সাভার পৌর এলাকার কর্ণপাড়া খালের কোনো অস্তিত্ব নেই। খালের ওপর গড়ে উঠেছে পাকা ভবন।

আশুলিয়ার ধলাই বিল এলাকার এক কৃষক বলেন, একসময় ধলাই বিলে লাখ লাখ টন ধান উৎপাদিত হতো। কিন্তু ডিইপিজেডের তরল বর্জ্যের কারণে ওই বিলে নামা যায় না।

সাভারের কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মুকশেফা বলেন, সাভারের কৃষিতে প্রচুর সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও যত্রতত্র গড়ে ওঠা শিল্পকারখানা আর দূষণের কারণে সেই সাভার কৃষিতে পিছিয়ে পড়ছে। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি বাবুল মোড়ল বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে আমরা বিভিন্ন আলোচনা সভা ও মতবিনিময় সভা থেকে সমস্যার কথা শুনে আসছি। কিন্তু সাভারের এসব সমস্যা সমাধানে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় না। আমরা চলতি বছরে একটি বা দুটি সমস্যার সমাধান চাই।’

সাভার নদী ও পরিবেশ উন্নয়ন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক বলেন, ট্যানারির অপরিশোধিত তরল বর্জ্যে ধলেশ্বরী নদী ও ডিইপিজেডের বর্জ্যে ধলাই বিল আর বংশী নদীর পানি দূষিত হচ্ছে। দখল হয়ে গেছে বংশী নদীর দুই তীর। তিনি বলেন, সাভারবাসীকে বাঁচাতে তরল বর্জ্য শোধন নিশ্চিত করতে হবে। আর নদী বাঁচাতে সিএস ম্যাপ ধরে নদীর সীমানা নির্ধারণ করতে হবে।

সাভার পৌরসভার মেয়র আবদুল গনি বলেন, উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বংশী নদী দখলদারদের যে তালিকা তৈরি করা হয়েছে, তাতে ৬৫ জনের নাম রয়েছে। ৬৫ নয়, দখলদারদের সংখ্যা ৬৬৫ বললেও কম হবে।

বেলার পক্ষ থেকে চামড়াশিল্প নগরীর আশপাশে কয়েকটি গ্রামে চালানো জরিপে অংশ নেওয়া চিকিৎসক আবদুর রাজ্জাক বলেন, ট্যানারির বর্জ্যের প্রভাবে শিশুসহ নানা বয়সের মানুষ জন্ডিস, চর্মরোগ, হাঁপানি ও শ্বাসকষ্টের মতো নানা রোগে ভুগছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সুলতান আহমেদ বলেন, ‘পৃথিবীতে লাখ লাখ প্রজাতি আছে, এর মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকারক হচ্ছে মানুষ। বুড়িগঙ্গা মরে গেছে, বংশী মরে যাচ্ছে—এর জন্য অন্য কোনো প্রাণী দায়ী নয়, দায়ী মানুষ। দূষণের জন্য আমরা যা কিছু পরিবেশে ফেলি, তা আবার আমাদের কাছেই ফিরে আসে। দূষণের কারণে খাদ্য, মাছ ও শাক-সবজির মধ্যে বিষ ঢুকে যাচ্ছে এবং সেটা আমরা খাচ্ছি। এভাবে বিষ আমাদের দেহে ঢুকছে।’

সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, ইতিপূর্বে বিভিন্ন আলোচনা সভা ও মতবিনিময় সভায় অনেক প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, বাস্তবায়ন হয়নি। তবে আজকের এই মতবিনিময় সভা কিছুটা ব্যতিক্রম। কেননা এই প্রথম সাভারের পরিবেশদূষণের বিষয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যদের নিয়ে মতবিনিময়ের আয়োজন করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা চাই, সত্যিকার অর্থে সাভারের বর্তমান পরিবেশের যেন উন্নতি করতে পারি। সে লক্ষ্যেই আমরা কাজ করব।’