Thank you for trying Sticky AMP!!

বড় কষ্টে বইছে ভৈরব নদ

মরে গেছে ভৈরব নদ। ভারতের নন্দনপুর সেতুর নিচ দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এই নদ। মেহেরপুরে বাংলাদেশ–ভারত সীমান্ত পিলারের সামনে। ছবি: প্রথম আলো
>
  • ভারতে গঙ্গার শাখা নদী জলাঙ্গি থেকে ভৈরবের উৎপত্তি।
  • ভারত বহু বছর আগে রেগুলেটর তৈরি করে ভৈরবের প্রবাহ বন্ধ করে দিয়েছে।

এক মাঠে দুই দেশ। মাঠে চাষ হচ্ছে সরিষা, পেঁয়াজ। ছোট একটি আল দেশ আর মানুষের সীমানা ঠিক করেছে। আলের এ পারে বাংলাদেশের মেহেরপুর জেলার কুতুবপুর ইউনিয়নের শোলমারি গ্রাম। ওপারে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার করিমপুর থানার নন্দনপুর গ্রাম। শোলমারির রইস উদ্দীনের সঙ্গে নন্দনপুরের জামাত আলী শেখের প্রতিদিন দেখা হয়, কথা হয় ফসলের মাঠে।
১৪ ফেব্রুয়ারি ফসলের মাঠে এই দুজনের সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়। নন্দনপুর বাজার থেকে মাইকে বাংলা গানের সুর ভেসে আসে। জামাত আলী শেখ প্রায় ৩০০ গজ দূরের সেতুটি দেখিয়ে বলেন, নন্দনপুর সেতু। সেতুর তলা দিয়ে বাংলাদেশে আসা নদই ভৈরব নদ।

মেহেরপুর জেলার এই সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে ভৈরব। পাড়ে গিয়ে দেখা যায় মজা খালের মতো। হাঁটুপানি, স্রোত নেই। আছে কচুরিপানা আর শেওলা। আগন্তুকের সাড়া পেয়ে বক পাড়ি দেয় সীমান্ত। সুর, পাখি সহজে সীমান্ত পাড়ি দেয়। ভৈরবও পাড়ি দিয়েছে, তবে শূন্য বুকে।

মাঠে কাজে ব্যস্ত কৃষকদের ধারণা, উত্তরে অর্থাৎ ভারতে কোথাও বাঁধ আছে ভৈরবের ওপর। তাই পানি আসে না। নদী বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাত প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ভারতে গঙ্গার শাখা নদী জলাঙ্গি থেকে ভৈরবের উৎপত্তি। ভারত বহু বছর আগেই রেগুলেটর তৈরি করে ভৈরবের প্রবাহ বন্ধ করে দিয়েছে।
নিরন্তর প্রবহমান জলধারাই নদ-নদী। বরফগলা পানি বা বৃষ্টি এই জলধারার উৎস। নদ-নদী উৎপত্তিস্থল থেকে সমুদ্রগামী হয়। সমুদ্রে বা কোনো মোহনায় যাত্রা শেষ করে। মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণী, উদ্ভিদ বেঁচে থাকলে নদ-নদীকে জীবন্ত বলা হয়। নদ-নদী নৌচলাচলের উপযোগী হতে হয়।

হিন্দু দেবতা শিব রুদ্রমূর্তি ধারণ করলে তাঁকে ভৈরব বলে ডাকা হয়। ১৬০ কিলোমিটার ভৈরবের কোথাও রুদ্রমূর্তি নেই। ৮০ শতাংশই প্রায় স্রোতহীন, প্রাণহীন। মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, যশোর, খুলনা হয়ে সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে সাগরে মিশেছে। নাম পরিবর্তন হয়েছে। ভৈরবের ওপর বাঁধ, কালভার্ট, সেতু হয়েছে। দুই পাড় দখল হয়েছে। শুষ্ক ভৈরবের মাঝখানে ধান চাষ হচ্ছে। যশোর-খুলনায় যে অংশে স্রোত আছে, সেখানে মিশছে কলকারখানার বর্জ্য।

মৃত ভৈরব
মেহেরপুরের শোলমারি থেকে কাথুলি পর্যন্ত ভৈরবের দুই পাশে দুই দেশ। কাথুলিতে বিজিবি ফাঁড়ির কাছে দুই তীরে বাংলাদেশ। সীমান্ত থেকে কাথুলি পর্যন্ত প্রায় ৭ কিলোমিটার ভৈরবের মধ্যে ধানখেত চোখে পড়ে।
মেহেরপুর শহরের পাশ দিয়ে গেছে ভৈরব। কাথুলি থেকে মুজিবনগর উপজেলার রতনপুর পর্যন্ত ২৯ কিলোমিটার খনন করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। নদের দুই পাড়ে ঢিবি করে মাটি রাখা। ২০১৫ সালের এপ্রিলে ‘ভৈরব নদ পুনঃখনন’ প্রকল্পের আওতায় খনন শুরু হয়েছিল। ১২৯ কোটি টাকার প্রকল্পটি গত বছর শেষ হয়েছে।
নদের খনন করা অংশে দুই পারের মানুষকে গোসল করতে, মাছ ধরতে দেখা গেছে। গ্রামের মানুষ বলেছেন, খননে লাভ হয়েছে। সেচের সুবিধা বেড়েছে। তবে এমনও অভিযোগ আছে যে যথেষ্ট গভীর না করেই খনন করা হয়েছে।
রতনপুরে একটি স্লুইসগেট (পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণকারী কপাট) তৈরি হয়েছে। সেখানে তির তির করে পানি নামছে। গেটের ভাটিতে তিনটি ছোট নৌকায় বসে মাছ ধরতে দেখা যায় তিন মৎস্যজীবীকে। বললেন, তাঁরা পুঁটি ধরছেন। অন্য মাছ নেই।
রতনপুর থেকে প্রায় শুষ্ক চেহারা নিয়ে ভৈরব ঢোকে চুয়াডাঙ্গা জেলায়। চলতে থাকে পূর্ব-দক্ষিণে। দুই পারে দখল বাড়তে থাকে। উত্তর থেকে এসেছে মাথাভাঙ্গা নদী। দামুড়হুদা উপজেলার সুবুলপুর গ্রামে মাথাভাঙ্গায় মিলিত হয় ভৈরব।

ভৈরব-মাথাভাঙ্গা মোহনায় ভৈরবের প্রশস্ততা সর্বোচ্চ ৩০ ফুট। বাঁশের সাঁকোর ওপর দাঁড়িয়ে পাটচোরা গ্রামের ষাটোর্ধ্ব তাহের আলী বলেন, নদী বুজে গেছে। কোনো রকমে দু-একটা নৌকা চলে।
মিলিত স্রোত মাথাভাঙ্গা নাম নিয়ে যায় দর্শনায়। মাথাভাঙ্গার চলা শেষ দর্শনাতে। দর্শনার পর মাথাভাঙ্গার একটি শাখা ভৈরব নামে বাংলাদেশে প্রবাহিত, অন্যটি পশ্চিমে ভারতে গেছে, নাম চুর্নি। নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক ম ইনামুল হক তাঁর বাংলাদেশের নদনদী বইয়ে লিখেছেন, ব্রিটিশ আমলে আসাম-বেঙ্গল রেলসেতু নির্মাণের জন্য দর্শনার দক্ষিণে ভৈরব নদ মাটি দিয়ে ভরাট করা হয়। সেই থেকে ভৈরবের স্রোত ক্রমেই কমতে থাকে।

ভৈরব নদের মাঝে ধান চাষ। চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার আন্দুলবাড়িয়া এলাকায়।


দর্শনার পর থেকে ভৈরব দখলের চেহারা স্পষ্ট। দেহাটি-কাশিপুর সেতুর ওপর দাঁড়ালে পশ্চিম দিকে দেখা যায়, নদ পুরোটাই দখলে। স্থানীয় লোকজন বলেছেন, একজন সার ব্যবসায়ী নদ দখল করে পুকুর করেছেন ১০-১২ বছর আগে। কিছু দূর পর ভৈরবের ওপর ইটভাটাও হয়েছে।

চুয়াডাঙ্গার ধোপাখালি গ্রামে শুধু পাড়ে নয়, নদজুড়ে ধান চাষ চোখে পড়ে। গ্রামের ফারুক হোসেন বলেন, নদের পারে পূর্বপুরুষের জমি আছে। নদের মাঝে জেগে ওঠা জমি তাঁরা সরকারের কাছ থেকে বন্দোবস্ত নিয়েছিলেন। বন্দোবস্ত বাতিল হয়েছে, জমি ভোগ চলছে। গ্রামের অনেকেই ভোগ করছেন।

ভৈরব যত দক্ষিণে যায়, প্রশস্ততা বাড়ে। জীবননগর উপজেলার মাধবপুর সেতুর ওপর দাঁড়ালে চোখে পড়ে নদজুড়ে ঘন কচুরিপানা। এই অবস্থায় ভৈরব গেছে ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুরে। মহেশপুর সদরে চা-বাজারের অনেকেই বলেন, নদের নাম কপোতাক্ষ। শত বছরের পুরোনো নাম। মহেশপুর পৌর ল্যাবরেটরি স্কুলের প্রধান শিক্ষক এ টি এম খায়রুল আনাম বলেন, ‘সরকারি কাগজপত্রে যাই থাকুক, পূর্বপুরুষেরা একে কপোতাক্ষ নামে ডাকত, আমরা সেই নামেই ডাকি।’

কোটচাঁদপুর থেকে ভৈরব গেছে যশোর জেলার চৌগাছা উপজেলায়। চৌগাছার তাহেরপুরে ভৈরব থেকে জন্ম নিয়েছে কপোতাক্ষ। পশ্চিম দিকের বড় শাখাটি কপোতাক্ষ নাম নিয়ে বয়ে গেছে মধুকবির বাড়ি সাগরদঁাড়ির দিকে। পূর্ব দিকের ক্ষীণ শাখাটি ভৈরব। কপোতাক্ষ আর ভৈরবের মাঝের ব-দ্বীপের মতো জায়গায় পাঁচতারার আদলে অবকাশ কেন্দ্র (রিসোর্ট) করছে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। তাদের মালামাল নেওয়ার জন্য ভৈরবের ওপর রাস্তা হয়েছে। ভৈরব এখানে পুরোপুরি বন্ধ।

চায়ের দোকানের প্রবীণেরা
চৌগাছা-আড়পাড়া সড়কের পাশে রোস্তমপুর বাজার। আজিজুল মৃধার চায়ের দোকানে সকাল-বিকেল আড্ডা দেন প্রবীণেরা। ১৭ ফেব্রুয়ারি সকালে আড্ডার বিষয় হয়ে ওঠে ভৈরব। সিকি কিলোমিটার দূরের ভৈরবের দিকে তাকিয়ে তাঁরা বলেন, একসময় ভৈরব ছিল চায়ের দোকান পর্যন্ত। ভৈরব প্রমত্ত ছিল। বিশাল বিশাল নৌকা চলত। এখানে খেয়াঘাট ছিল। যাঁর বাড়ির সামনে নদ, তিনিই দখল করে জমি বাড়িয়েছেন। এরশাদের আমলে নদের পারের খাসজমি বন্দোবস্ত পেতেন ভূমিহীনেরা। বন্দোবস্ত প্রথা বাতিল হলেও জমির দখল কেউ ছাড়েননি।
ভৈরব খননের খবর আছে প্রবীণদের কাছে। তাঁরা বলেন, খনন হলে পাট জাগের পানি হবে, গরু-ছাগলের খাওয়ার পানির কষ্ট কমবে, গোসল ও সেচের সুবিধা হবে। মাছের খরা কাটবে।

খনন আটকে যাচ্ছে
যশোর শহর দিয়ে ভৈরব গেছে। শহরের প্রাণকেন্দ্র দড়াটানায় যে বড় নর্দমা চোখে পড়ে, দুর্গন্ধ নাকে আসে সেটি আসলে ভৈরব। দড়াটানা সেতুর ওপর দাঁড়ালে দেখা যায় ভৈরবের পাড়ে ছোট-বড় স্থাপনা, কয়েকটি বহুতল ভবন। শহরে শক্তিমানদের শক্ত দখল।
যশোরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) রেজা-ই-রাব্বি প্রথম আলোকে বলেন, শহরের মধ্যে ভৈরবের পাড়ে অবৈধ স্থাপনা ২৯৬টি।
পাউবো জানিয়েছে, ২৭২ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘ভৈরব রিভার বেসিন এলাকার জলাবদ্ধতা দূরীকরণ ও টেকসই পানিব্যবস্থাপনা উন্নয়ন প্রকল্প’ বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। তাহেরপুর থেকে যশোর সদর উপজেলার বসুন্দিয়া পর্যন্ত ৯২ কিলোমিটার নদ পুনঃখনন হবে।
ইতিমধ্যে ৫০টি স্থাপনা উচ্ছেদ না করার জন্য উচ্চ আদালত থেকে নিষেধাজ্ঞা নিয়েছেন দখলদারেরা। প্রভাবশালী দখলদারদের কারণে ভৈরব খননকাজ আটকে যেতে পারে এমন আশঙ্কা অনেকেরই।
দখল সম্পর্কে আইনুন নিশাত বলেন, ভৈরব খনন করা একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। দখলদারদের শক্ত হাতে উচ্ছেদ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে চারটি নদী নিয়ে হাইকোর্টের একটি রায় কাজে লাগাতে পারে সরকার।

ভৈরব নদের ওপর বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। খুলনার খালিশপুর–সংলগ্ন এলাকায়।


দূষণে বিপর্যস্ত ভৈরব

যশোরের বসুন্দিয়া থেকে আফ্রাঘাট পর্যন্ত চার কিলোমিটার ভৈরবে পানি অন্য এলাকার চেয়ে বেশি। আফ্রাঘাটে ভৈরবে মিলিত হয়েছে চিত্রা নদী। ভৈরব-চিত্রার মিলিত প্রবাহ ভৈরব নামে খুলনার রূপসা বিস্তৃত। এই ৩৭ কিলোমিটার ভৈরবে নৌযান চলাচল করতে দেখা গেছে।
এই অংশে দুই তীর দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে শতাধিক কারখানা ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। কারখানাগুলো রাসায়নিক বর্জ্য ফেলছে ভৈরবে। ভৈরবে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন অভয়নগর গ্রামের বর্মণ পাড়ার বনমালী বিশ্বাস। তিনি বলেন, ভৈরবে আগে নানা ধরনের প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। চামড়ার মিলের বিষাক্ত জলে ভৈরবের জল নষ্ট হয়ে গেছে। মাছ পাওয়া যায় কম।
উপজেলা জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা মো. আনিছুর রহমান বলেন, ‘রাসায়নিক বর্জ্যের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। মাছ ও কাঁকড়া মরে ভেসে উঠছে। গত ৩৮ বছরে নদ থেকে ১৫ প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে।’
১৮ ফেব্রুয়ারি আফ্রাঘাট থেকে নৌপথে রূপসা যেতে দেখা যায়, কলকারখানা ও বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ভৈরব দখল করে স্থাপনা সম্প্রসারিত করেছে। বার্জ ও কার্গোতে পণ্য ওঠানো-নামানোর জন্য নদের মধ্যে ইট, বালু, সিমেন্ট ও পাথর ফেলে ভরাট করে পাকা ঘাট তৈরি করা হয়েছে। নদের মাঝে কংক্রিটের দেয়াল তুলেছে কেউ।
নওয়াপাড়া নদীবন্দরের সহকারী পরিচালক মাসুদ পারভেজ বলেন, দখলের কারণে ভৈরবের গতিপথেরও পরিবর্তন হয়েছে। সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হয়েছে মশরহাটি এলাকায়। সেখানে সেতু নির্মাণ করতে গিয়ে ভৈরবে বাঁধ দেওয়া হয়েছিল। পাউবোর অনুমতি নেওয়া হয়নি।
শোলমারি গ্রামে শুরু হওয়া নদটি খুলনা শহরের রূপসা ঘাটে শেষ হয়। এরপর পশুর নামে সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগরে মেশে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দখল আর দূষণ দেখে মনে হয় আন্তর্জাতিক এই নদের মালিক বা কর্তৃপক্ষ নেই। যৌথ নদী কমিশনের কাছে ভৈরবের তথ্য নেই। ৪ মার্চ কমিশনের সদস্য মো. মোফাজ্জল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভৈরবের বিষয়ে দেওয়ার মতো তথ্য নেই।’

(প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন যশোর প্রতিনিধি মাসুদ আলম ও মনিরুল ইসলাম, ঝিনাইদহের আজাদ রহমান, চুয়াডাঙ্গার শাহ আলম ও মেহেরপুরের প্রতিনিধি আবু সাঈদ)