Thank you for trying Sticky AMP!!

মারাত্মক বায়ুদূষণ, বাড়ি ছাড়ছে মানুষ

নওয়াপাড়া নদীবন্দরে কাজ করা কয়লাশ্রমিকেরা আক্রান্ত হচ্ছেন নানা রোগে। গত রোববার যশোরের নওয়াপাড়া বাজার এলাকায়। ছবি: এহসান-উদ-দৌলা

রাজধানীর লালবাগ বা ফার্মগেট নয়, বায়ুদূষণের ভয়াবহতা দেখতে চাইলে যেতে হবে যশোরের নওয়াপাড়ায়। সেখানে এক সন্ধ্যায় রাস্তার পাশে দাঁড়ালেই চলবে। অল্প সময়েই গায়ের জামাকাপড় বিবর্ণ হয়ে উঠবে। একযোগে নাকে ঢুকবে ধোঁয়া, ধূলিকণা ও দুর্গন্ধ। পরিস্থিতি এতটাই মারাত্মক যে অনেকে ঘরবাড়ি বিক্রি করে অন্যত্র সরে গেছেন।

সরেজমিন দেখা গেছে, কয়লা থেকে নির্গত বস্তুকণায় নওয়াপাড়ার বাসাবাড়ি, গাছগাছালি কালচে ও বিবর্ণ হয়ে পড়েছে। নওয়াপাড়া নদীবন্দরে প্রতিদিন বার্জ ও কার্গো থেকে শত শত ট্রাক কয়লা ওঠানো-নামানো হয়। আমদানি করা এসব কয়লা রাখা হয়েছে স্তূপ করে। অভয়নগর উপজেলার রাজঘাট থেকে প্রেমবাগ পর্যন্ত প্রায় ১৫ কিলোমিটার এলাকায় কয়লার শত শত স্তূপ (ড্যাম্প)। কয়লা থেকে নির্গত ধূলিকণা ও উৎকট গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে পুরো এলাকায়।  

কয়লার দূষণে অতিষ্ঠ হয়ে ইতিমধ্যে এলাকার ১৫ থেকে ২০ জন ঘরবাড়ি বিক্রি করে পরিবার নিয়ে অন্যত্র বসবাস করছেন। তাঁদের মধ্যে রাজঘাটের বাসিন্দা ও সিংগিয়া আদর্শ ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক কামরুল আলম, রাজঘাটের হোসেন আলী, জুলফিকার আলী, আমিনুর রহমান ও শরীফুল ইসলাম অন্যতম। তাঁদের একজন হোসেন আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘কয়লাওয়ালাগো জ্বালায় টিকতে না পাইরে বাড়িসহ ৭ শতক জমি পানির দামে বেচে দিয়ে চলে আইচি।’

ঢাকা থেকে প্রায় ২৩৫ কিলোমিটার দূরে যশোরের অভয়নগর উপজেলার ছোট্ট বাণিজ্যিক কেন্দ্র এই নওয়াপাড়া। সেখানে বায়ুদূষণের মাত্রা কি, জানতে চাইলে যশোরে পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কামরুজ্জামান সরকার প্রথম আলোকে বলেন, এখানে বায়ুর মান পরিমাপের কোনো ব্যবস্থা নেই।

সম্প্রতি স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) এক পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ঢাকার বায়ু সহনশীল মাত্রা চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি দূষিত। এর মধ্যে পুরান ঢাকার লালবাগ সবচেয়ে দূষিত। এরপর আছে ফার্মগেট এলাকা। তবে লালবাগ ও ফার্মগেটের চেয়ে যশোরের নওয়াপাড়ার অবস্থা যে ভয়াবহ তা ওই এলাকায় কিছুক্ষণ দাঁড়ালেই উপলব্ধি করা যায়। 

রোগাক্রান্ত হচ্ছে মানুষ

নওয়াপাড়ার বাসিন্দারা জানান, সেখানে মানুষের প্রায়ই শ্বাসকষ্ট, গলায় জ্বালাপোড়া, হাঁচি, কাশি, সর্দি লেগে থাকছে। চর্মরোগের প্রাদুর্ভাবও ঘটছে। ঘরদুয়ার, জামাকাপড় কিছুতেই পরিষ্কার রাখা যাচ্ছে না। সবখানেই যেন কয়লার কালি লেগে রয়েছে।

গত রোববার নওয়াপাড়া মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কথা হয় পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী আরজিন বিনতে আজহারের সঙ্গে। আরজিন বলল, রাস্তায় নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। গন্ধের কারণে নাক চেপে স্কুলে আসতে হয়। একই শ্রেণির ছাত্র মিশকাত আহমেদ জানায়, রাস্তায় ধোঁয়ার জন্য চোখ জ্বলে, প্রায়ই হাঁচি আসে।

উপজেলার সরকারি হাসপাতাল সূত্র জানায়, সেখানে প্রতিদিন গড়ে ৬০০ রোগী বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসে। তাঁদের বেশির ভাগ শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা নিয়ে আসে। আর হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর প্রায় ২০ ভাগ শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণজনিত। 

অভয়নগর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মাহমুদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, গত এক বছরে উপজেলায় শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণজনিত রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। কয়লার ময়লা থেকেই এর উৎপত্তি।

উন্মুক্ত স্থানে শত শত কয়লার স্তূপ

অভয়নগরের ওপর দিয়ে পাশাপাশি বয়ে গেছে ভৈরব নদ এবং যশোর-খুলনা রেলপথ ও মহাসড়ক। এই তিন পথ নওয়াপাড়ায় এসে সমান্তরাল হয়েছে মাত্র দেড় থেকে দুই শ মিটার দূরত্বে। এই ত্রিমাত্রিক যোগাযোগের সুবিধায় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সবচেয়ে বড় বিপণনকেন্দ্র হয়ে উঠেছে নওয়াপাড়া। এক সময় এটা ছিল খাদ্যশস্য, রড, সিমেন্ট, বালু, পাথর, সার বিপণনের কেন্দ্র। ২০১৬ সাল থেকে সে জায়গা দখলে নিয়েছে কয়লা। বিদেশ থেকে আনা এ কয়লা চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ও মোংলা বন্দরে খালাস হওয়ার পর ছোট ছোট বার্জ ও কার্গোতে করে সেগুলো নওয়াপাড়ায় আসে। সেখান থেকে সড়ক ও নদীপথে এই কয়লা দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানা গেছে, বছরে গড়ে প্রায় দুই লাখ মেট্রিক টন জ্বালানি কয়লা নওয়াপাড়ায় আসছে। 

গত রোববার সরেজমিনে দেখা যায়, যশোর-খুলনা মহাসড়ক ও রেলপথ এবং ভৈরব নদের পাড়ে খোলা আকাশের নিচে অন্তত দুই শ বড় বড় কয়লার স্তূপ। এর বিরুদ্ধে এলাকার সচেতন বাসিন্দারা বিভিন্ন সময়ে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছেন। এ নিয়ে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি অভয়নগর উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে জেলা প্রশাসকের সভাপতিত্বে সভা হয়। সভায় নওয়াপাড়া আবাসিক এলাকা এবং যশোর-খুলনা মহাসড়ক ও রেলপথের পাশ থেকে কয়লার ড্যাম্প এক সপ্তাহের মধ্যে সরানোর সিদ্ধান্ত হয়। আজ বুধবার সময়সীমা শেষ হচ্ছে। যশোরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আরিফ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এক সপ্তাহ হয়ে গেলে আমরা অভিযান চালাব।’

প্রাণঘাতী উপাদান, মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি 

স্থানীয় বাসিন্দা ও কয়লাশ্রমিকেরা জানান, প্রায়ই কয়লার স্তূপে আগুন ধরে ধোঁয়ার কুণ্ডলী ওঠে। তখন শ্রমিকেরা পানি ছিটান। অনেক কয়লা থেকে দুর্গন্ধও বের হয়। ভৈরব নদ ও মহাসড়কের পাশে ২০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ছাত্র-শিক্ষকেরাও কয়লার দূষণের শিকার হচ্ছেন।  ড্যাম্পের আশপাশের গাছ মরে যাচ্ছে। ঘরবাড়ি ও কাপড়চোপড় ধুলায় ধূসর হয়ে যাচ্ছে। কয়লা ওঠানো-নামানোর কাজে যুক্ত প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক, তাঁরাও মারাত্মক দূষণের শিকার হচ্ছেন। নওয়াপাড়া ঘাটের শ্রমিক মাসুম শেখ প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাত্তিরি চোখ জ্বালাপুড়া করে, ঘুমোতে পারিনে। চুলকোয়ে সারা গায় ফুসকুনি ওঠে। সবই হচ্ছে কয়লার জন্যি।’ 

যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জলবায়ু ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, যশোরের নওয়াপাড়াতে যে কয়লার দূষণ চলছে, তা শুধু সূক্ষ্ম বস্তুকণা পিএম-২.৫ তৈরি করছে, তা নয়; সেখান থেকে মানবদেহের জন্য আরও মারাত্মক ক্ষতিকারক ভারী বস্তুকণা ও সিসার মতো প্রাণঘাতী উপাদান বের হচ্ছে। ওই পথ দিয়ে বাসে ও ট্রেনে গেলেই এসব দূষণ টের পাওয়া যায়। আর যারা সেখানে থাকে, তাদের জন্য মারাত্মক ও দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।