Thank you for trying Sticky AMP!!

সোনা জঙ্গার সন্ধানে

হাকালুকি হাওরের চাতলার বিলে উড়ন্ত অবস্থায় সোনা জঙ্গা l ছবি: লেখক

ঝলমলে রোদ, পরিষ্কার আকাশ। চা-বাগানের ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে এগিয়ে চলেছি। 
বিকেল পাঁচটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায়। থাকার ব্যবস্থা জেলা পরিষদের ডাকবাংলোয়। খুব ভোরে উঠতে হবে, তাই তাড়াতাড়ি খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়লাম।
কিন্তু ভোরে ঘুম থেকে উঠেই মন খারাপ হয়ে গেল। বাইরে ঝুমবৃষ্টি। কিছুক্ষণ পর আকাশ খানিকটা পরিষ্কার হলে অটোরিকশায় জুড়ীতে চলে এলাম। চা পান শেষে ‘হাওর রক্ষা কমিটি’র দুই সদস্যসহ হাকালুকির দিকে রওনা হলাম। বৃষ্টি না থাকলেও তেমন রোদ নেই। হাওরের বিভিন্ন বিল ঘুরে একসময় চাতলার বিলের পূর্ব পারের করচগাছগুলোর পাশে এসে দাঁড়ালাম। সঙ্গে থাকা পাখিবিদ শরীফ খান আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। বেশ কসরত করে একটি করচগাছের মগডালে উঠে আমার বাইনোকুলার দিয়ে চারদিক দেখতে লাগলেন। আর আমি শুধুই খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম বিশেষ একটি পাখি, মূলত যার সন্ধানে এখানে এসেছি। কাছে-দূরের সব পাখির দিকেই ক্যামেরা তাক করছি, আর ব্যস্তভাবে ক্লিক করছি। একসময় আকাশ কালো হয়ে এল। শরীফ খান করচগাছ থেকে নামলেন। বিলের এক মাছচাষির আমন্ত্রণে তার ডেরায় চা-বিস্কুট খাচ্ছি, এমন সময় পতপত শব্দ শুনে পেছনে তাকালাম। আরে বাপ রে, শামুকখোলের বিশাল একটি ঝাঁক এগিয়ে আসছে! সংখ্যায় হাজারের কম নয়। মাছচাষির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যেই-না অটোরিকশামুখী হয়েছি, অমনি ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। কোনোরকমে দৌড়ে অটোরিকশায় চড়লাম। অনেক কষ্টে অটোরিকশা ঠেলেঠুলে শেষমেশ রেস্টহাউসে পৌঁছলাম। ট্রিপটা জুতসই হলো না বলে দুজনেরই মন খারাপ।
ঢাকায় ফিরে ছবিগুলো কোনোরকমে ল্যাপটপে আপলোড করে নিত্যদিনের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। দিন দশেক পরে এক রাতে সূক্ষ্মভাবে ছবিগুলো পরীক্ষা করছিলাম। একটি ছবিতে হঠাৎ চোখ আটকে গেল। বেশ দূর থেকে তোলা ছবিটি জুম করে যা পেলাম, তাতে মন ভরে গেল। হাকালুকিতে যার সন্ধানে গিয়েছিলাম, সেই সোনা জঙ্গারই ছবি। সোনা জঙ্গা অর্থাৎ Painted Stork এ দেশে রঙিলা বক বা রাঙা মানিকজোড় নামে পরিচিত। চিকোনিডি পরিবারের এই সদস্যের বৈজ্ঞানিক নাম Mycteria leucocephala।
সোনা জঙ্গা বড় পাখি। লম্বায় ৯৩ থেকে ১০২ সেমি এবং ওজনে দুই থেকে সাড়ে তিন কেজি। মাথার পালকবিহীন অংশ কমলা-হলুদ। প্রজননকালে পুরুষের মাথা আলতা-লাল হয়ে যায়। লম্বা ঠোঁটের রং হলুদ। মেটে-বাদামি পায়ে যেন আলতামাখা। ঘাড়, পিঠ সাদা। দেহের নিচটা সাদা ও বুকে কালো ছোপ। ডানার ওপরটা কালো ও তাতে সাদা ছোপ। লেজের পালকেও আলতা-লাল রং মাখা।
এরা জলমগ্ন মাঠ, নদীর তীর, জোয়ার-ভাটার কাদাচর, হ্রদ ইত্যাদিতে জোড়ায় জোড়ায় বা ছোট দলে বিচরণ করে। অল্প পানিতে হেঁটে ও কাদায় ঠোঁট ঢুকিয়ে মাছ, ব্যাঙ, চিংড়ি, বড় কীটপতঙ্গ খায়। এরা সাধারণত চুপচাপ থাকে। তবে প্রজনন মৌসুমে নিচু স্বরে গোঙানোর মতো শব্দ করে।
জুলাই-অক্টোবর প্রজননকাল। পানিতে দাঁড়ানো উঁচু গাছের মগডালে ডালপালা দিয়ে মাচানের মতো বড়সড় বাসা বাঁধে। একই গাছে দলবদ্ধভাবে বাস করে। বাসা তৈরি হলে স্ত্রী তাতে তিন-চারটি সাদাটে ডিম পাড়ে, তাতে থাকে লম্বা বাদামি দাগ। ডিম ফোটে ২৮-৩৫ দিনে। বাচ্চারা প্রায় ২৮ দিনে উড়তে শেখে এবং নীল আকাশে স্বপ্নের ডানা মেলে।
সোনা জঙ্গা একসময় এ দেশের আবাসিক পাখি ছিল। কিন্তু নানা কারণে বিতাড়িত হয়েছে। বর্তমানে এ দেশে এরা শীতকালে অনিয়মিতভাবে আসে। সোনা জঙ্গা বিশ্বব্যাপী প্রায় বিপদগ্রস্ত এবং এ দেশে মহাবিপন্ন বলে বিবেচিত। তবে কদিন আগে ফেসবুকে তরুণ পাখিবিদ ওমর শাহাদাতের শেরপুর থেকে তোলা একটি অপ্রাপ্তবয়স্ক সোনা জঙ্গার ছবি দেখে মনে আশার সঞ্চার হলো। ওরা হয়তো আবার এ দেশে বাসা করার পরিবেশ ফিরে পাচ্ছে। আর যদি তা-ই হয়, তবে তা হবে এক আনন্দের খবর।