Thank you for trying Sticky AMP!!

৪ কারণে মিলছে না নদীর ইলিশ

দৃষ্টিনন্দন করে সাজানো ইলিশ

ভোজনরসিক ও জেলেদের মতে, সাগর আর নদী থেকে ধরা ইলিশ মাছের স্বাদে খানিকটা পার্থক্য আছে। নদী থেকে ধরা ইলিশের যে ঘ্রাণ থাকে, সাগরের ইলিশে তা তেমন পাওয়া যায় না। ভোলার নদীগুলোতে এ বছর জেলেদের প্রত্যাশা অনুযায়ী ইলিশ মিলছে না। তাঁরা বলছেন, ডুবোচর, সাগর থেকে নদীতে প্রবেশের মুখে বাধা, অবৈধ জাল আর উত্তরের ঢলে পলি–বর্জ্য থাকায় জেলাটিতে রুপালি ইলিশের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ভোজনরসিকেরা।
এদিকে নদীতে ইলিশ না পেয়ে সাগরে ছুটছেন জেলেরা। কিন্তু অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় এক–দুই বছর ধরে সাগরে যাওয়া নৌকার সংখ্যা বেড়েছে। জেলেরা নানা আয়োজন করে সাগরে যাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু যে পরিমাণ ইলিশ পাচ্ছেন, তা বিক্রি করে তাঁদের পরিবহন, শ্রমিক ও সাগরে দিনযাপনের খরচ উঠছে না। এসব জেলেদের বেশির ভাগই মহাজনদের কাছে থেকে ঋণ নিয়ে সাগরে যাওয়ার প্রস্তুতি নেন। লোকসান হওয়ায় তাঁরা আরও ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন।

গত কয়েক দিন ভোলার বিভিন্ন এলাকার জেলে ও মৎস্য বিভাগের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ১৫ বছরে যেমন জেলের সংখ্যা বেড়েছে, তেমনি ট্রলার ও সাগরগামী ট্রলার (ফিশিং বোট) বেড়েছে কয়েক গুণ। ১০ থেকে ১২ বছর আগেও ভোলার দৌলতখান ও চরফ্যাশন উপজেলার ১০০ থেকে ১২০টি ফিশিং বোট সাগরে মাছ ধরতে যেত। এখন ভোলার সাত উপজেলা থেকেই ফিশিং বোট ও বড় ট্রলার সাগরে মাছ ধরতে যায়। বেসরকারি হিসাবে যার সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন হাজার। উপকূলের অন্য জেলা থেকেও সাগর মোহনা ও সাগরে মাছ ধরতে ভিড় করছেন জেলেরা। এতসংখ্যক ট্রলারের কারণে ইলিশ নদীতে উঠতে পারছে না।
শুধু সাগরে নয়, নদীতে ইলিশের প্রবেশপথে ও সাগর মোহনার ডুবোচরে অসাধু জেলেরা বেহুন্দি, চরঘেরা, পিটানো, খরছি, জাম খরছি নামের অবৈধ জাল পাতছেন। এসব জাল অনেকটা বেড়ার মতো। তজুমদ্দিন উপজেলার সাগরগামী জেলে আবু সাঈদ মাঝি (৪৫) বলেন, সাগর মোহনার যেসব চ্যানেল বা লোঙ্গা দিয়ে ইলিশ নদীতে ওঠে, সেসব লোঙ্গায় জাম খরচি নামের অবৈধ জাল পেতে রাখেন প্রভাবশালী জেলেরা। এসব জালে ইলিশ বাধা পেয়ে আবার সাগরে ফেরত যায়। আর এসব অবৈধ জাল যেখানে পাতা হয়, সেখানে কিছুদিনের মধ্যেই চর পড়ে যায়।
জেলে ও মৎস্য কর্মকর্তারা বলছেন, উত্তরের ঢলের পানির সঙ্গে প্রচণ্ড পরিমাণ বর্জ্য ও পলি নামছে। ভাটার সময় তীব্র বেগে পানি নামছে। কিন্তু জোয়ারের সময় মনে হয়, সাগরের পানি উঠতে পারছে না, স্থির হয়ে আছে। এই বর্জ্যযুক্ত দূষিত পানির কারণে মাছও উঠছে না।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আজহারুল ইসলাম বলেন, ডুবোচর ও জেলের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো কারণ আছে কি না, তা জানতে গবেষণা প্রয়োজন।

ঋণগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ জেলে

আগামী ১৪ অক্টোবর থেকে মা ইলিশের প্রজননকাল শুরুর আগ পর্যন্ত ছিল ইলিশের ভরা মৌসুম। সাধারণত এই ভরা মৌসুমে যে আয় হয়, তা দিয়েই বছরের বাকি সময় চলতে হয় জেলেদের। কিন্তু নদীতে প্রত্যাশিত মাছ না পাওয়ায় সাধারণ জেলেদের অনেকেই ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। এমন কয়েকজন জেলে জানান, তাঁরা সাধারণত ঋণ নিয়েই মাছ ধরার বন্দোবস্ত করেন। মৌসুম শেষে ভালো আয় না হলে মহাজনের কাছ থেকে দাদন নেওয়া ছাড়া তাঁদের আর উপায় থাকে না।
গত বছর ছোট ট্রলারে তেঁতুলিয়া ও মেঘনা নদীতে পাঁচ লাখ টাকার মাছ পেয়েছিলেন (সব খরচ বাদ দিয়ে) লালমোহন উপজেলার চর শাহজালালের জেলে মো. নাছিম (৩৮)। সেই টাকার সঙ্গে দাদনের টাকা যোগ করে যৌথভাবে ১৬ লাখ টাকায় বানান একটি ফিশিং বোট। নদীতে বড় ইলিশ পাওয়া যাবে না, এটা জেনেই গত জুন মাস থেকে ১০টি ট্রিপ দিয়েছেন সাগরে। প্রতি ট্রিপেই সাগরে অন্তত এক সপ্তাহ করে থাকতে হয়েছে। এই সময়ে নৌকার জেলেদের জন্য বাজার করেছেন প্রায় ৭ লাখ টাকার। ৩ জুন থেকে ২৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মাছ পেয়েছেন ৪ লাখ টাকার। সাগরের ভাসানচর থেকে মুঠোফোনে নাছিম বলেন, ‘শুক্রবার রওনা করে শনিবার সকালে সাগরে এসে খেও দিয়েছি। দিন শেষে তিন খেও দিয়ে মাত্র ১৬ হালি মাছ পাওয়া গেছে। বেশি মাছ পেতে হলে সাগরের ২০০ থেকে ২৫০ হাত গভীরে জাল পাততে হয়। আবহাওয়া ভালো না থাকায় অত গভীরে যাওয়া যাচ্ছে না।’

চরফ্যাশন উপজেলার ঢালচরের জেলে মাহতাব ঘরামী ৬৪ দিনে ৩৮ হাজার টাকার মাছ ধরেছেন। খরচ না পোষানোর কারণে ১ লাখ ১৮ হাজার টাকার ঋণের বোঝা নিয়ে মৌসুম শেষ হওয়ার আগেই বাড়িতে চলে গেছেন। অথচ গত মৌসুমে (২০১৯) ৯২ দিনে তিনি ৫ লাখ ৫১ হাজার টাকার মাছ বিক্রি করেছিলেন।

আগামী ১৪ অক্টোবর থেকে মা ইলিশের প্রজননকাল শুরুর আগ পর্যন্ত ছিল ইলিশের ভরা মৌসুম। সাধারণত এই ভরা মৌসুমে যে আয় হয়, তা দিয়েই বছরের বাকি সময় চলতে হয় জেলেদের। কিন্তু নদীতে প্রত্যাশিত মাছ না পাওয়ায় সাধারণ জেলেদের অনেকেই ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন।

চাঁদপুর ইলিশ গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান আনিসুর রহমান বলেন, নদীতে ইলিশ কম পাওয়ার অনেক কারণ থাকতে পারে। তবে এখন পর্যন্ত অতিরিক্ত জেলে, ট্রলার ও ডুবোচরকেই অন্যতম কারণ মনে করছে মৎস্য বিভাগ। এর সমাধানের জন্য সবার আগে নদীতে ইলিশ প্রবেশের পথ তৈরি করতে হবে। তা না হলে দেশে ইলিশের ভবিষ্যৎ পরিস্থিতির পাশাপাশি জেলেদের সুদিনও বদলে যেতে পারে।