Thank you for trying Sticky AMP!!

জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার ভদ্রাকালী গ্রামে পুরুষ নীল-কপালি লালগির্দি

অতি বিরল পাখিটির দেখা

চৌদ্দ বছর আগের কথা। বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানার পুরোনো কড়ইগাছের খোঁড়লে বসবাস করা টিয়া পাখির প্রজননসংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের জন্য ঘন ঘন চিড়িয়াখানায় যেতাম। ২০১০ সালের ২০ নভেম্বর টিয়া পাখির বাসা ও প্রজননের ছবি তোলা শেষে পাশের চিড়িয়াখানায় গেলাম। কবুতর ও মুনিয়া পাখির খাঁচা পেরিয়ে ফুলের বাগানের সামনে চলে এলাম।

এরপর বিশ্রাম নেওয়ার জন্য রঙ্গনগাছের পাশে বসলাম। দুই মিনিটও পার হয়নি, হঠাৎ রঙ্গনগাছের সামনের পেঁপেগাছে ছোট্ট একটি অপরিচিত পাখি এসে বসল। দ্রুত ওটির দিকে ক্যামেরা তাক করলাম। মাত্র দুটি ক্লিক করার সুযোগ দিয়ে পাখিটি উড়াল দিল। আরেকবার আসে কিনা দেখার জন্য কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম; কিন্তু এলো না।

বাসায় ফিরে যতগুলো ফিল্ডগাইড ও বই ছিল, সব নিয়ে বসলাম; কিন্তু পাখিটিকে সঠিকভাবে শনাক্ত করতে পারলাম না। শেষে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অনুজসম মনিরুল খানকে ছবিটি পাঠালাম। তিনি এটিকে অপ্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রী পাখি হিসেবে শনাক্ত করলেন।

সূত্রমতে, ১৯৮৪ সালে সোনারগাঁয়ে এই প্রজাতির পাখি প্রথম শনাক্ত হয়। এরপর বহুদিন আর খোঁজ নেই। কাজেই আমার ছবিটিই হয়তো এদেশে তোলা এই প্রজাতির পাখির প্রথম ছবি। এরপর ২০১৬ সালে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড ও পরে মৌলভীবাজারের আদমপুরে একই প্রজাতির পাখির দেখা মেলে।

বহু বছর পর জয়পুরহাটের আক্কেলপুরে আবারও পাখিটির দেখা মিলল। গত ৭ ফেব্রুয়ারি পক্ষী আলোকচিত্রী ও ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আনিস শেখের ফেসবুক পোস্টে চোখ আটকে গেল। নীলচে মাথা-বুক-পিঠ, বাদামি কমলা পেট আর নীল কপালের চমৎকার একটি পুরুষ পাখি। পোস্টে কমেন্টও করলাম। সপ্তাহখানেক পরে পাখিটির ছবি তুলতে রাজশাহীতে গেলাম। সেখান থেকে সমমনা কয়েকজনকে নিয়ে প্রথমবারের মতো জয়পুরহাটের ট্রেনে চড়লাম। আক্কেলপুর স্টেশনে নামতেই তরুণ বন্য প্রাণিবিষয়ক আলোকচিত্রী আহনাফ আল সাদমান আমাদের নিয়ে গেলেন পাশের ভদ্রাকালী গ্রামের হাঁড়িপুকুরে। ওখানেই সে অতি বিরল পাখিটির খোঁজ পেয়েছেন। দেশের উত্তর–পশ্চিমাঞ্চলে এটিই পাখিটির প্রথম রেকর্ড। স্পটে পৌঁছানোর পাঁচ মিনিটের মধ্যে পাখিটির দেখা পেলাম। প্রায় দুই ঘণ্টা মন ভরে ছবি তুললাম, ধারণ করলাম ভিডিও চিত্র।

বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানার পেঁপেগাছে স্ত্রী নীল-কপালি লালগির্দি।

এতক্ষণ যে পাখির গল্প বললাম, সেটি এদেশের অতি বিরল পরিযায়ী পাখি নীল কপালি লালগির্দি বা নীল-লালগির্দি (ব্লু-ফ্রন্টেড রেডস্টার্ট। পশ্চিমবঙ্গে বলে নীলমাথা লালগির্দি। ভবঘুরে পাখিটি কালেভদ্রে এদেশে আসে। মাসসিক্যাপিডি গোত্রের গির্দিটির বৈজ্ঞানিক নাম Phoenicurus frontalis। এটি মূলত হিমালয়ের আবাসিক পাখি।

নীল-লাল গির্দি চড়ুই আকারের পাখি। লম্বায় ১৫ সেন্টিমিটার ও ওজনে ১৭ গ্রাম। পুরুষ পাখির কপাল উজ্জ্বল নীল আর মাথা ও পিঠ গাঢ় নীল। গলা, বুক ও ডানা গাঢ় নীল। ডানার পালক-ঢাকনির কিনারা কালচে। দেহের নিচের দিকটা কমলা বাদামি। কোমর ও পেট কমলা লাল। লেজের কিনারা কালচে।

অন্যদিকে স্ত্রী পাখির পালক ধূসর বাদামি। দেহের নিচের অংশ জলপাই বাদামি বা কমলা বাদামি। কোমর কমলা লাল; পেট ও লেজের নিচে কমলা রঙের আভা। চোখের চারপাশ সাদা বলয়। ঠোঁট, পা, পায়ের পাতা ও নখ কালো। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির দেহের ওপরের অংশ গাঢ় বাদামির মধে৵ ঘিয়ে হলুদের ঘন ছোপ। গলা ও বুক কালচে বাদামি পালকে ভরা। ডানার পালক-ঢাকনির কিনারা সাদা বা হালকা কমলা।

পরিযায়ী পাখিটি শীতে চারণভূমি, ঝোপঝাড়, মাঠ ও খোলা বনে চরে বেড়ায়। পোকাখোর হলেও রসাল ফল ও বীজ পছন্দ। একাকী বিচরণ করলেও প্রজননের পর ও পরিযায়নের সময় ছোট দলেও দেখা যায়। সাধারণত ‘টিক’ বা ‘প্রিট’ শব্দে ডাকে। তবে ভয় পেলে ‘ইটিট-ইটিট-ইটিট’ বা ‘টট-টট-টট’ স্বরে বিরামহীনভাবে ডাকতে থাকে।

মে থেকে আগস্ট প্রজননকাল। এ সময় নিজ আবাস এলাকা হিমালয়ের আশপাশ ও মধ্য চীনের জমির আইল, পাথরের ফাঁক বা গাছের খোঁড়লে শিকড়, চুল, পালক, মস, শেওলা ইত্যাদি দিয়ে বাটি আকারের ছোট্ট বাসা গড়ে। ডিম পাড়ে তিন থেকে ছয়টি। রং হালকা গোলাপি ধূসর বা হালকা হলদে, যার ওপর রয়েছে কিছু হালকা লালচে দাগ। ডিম ফোটে প্রায় ১২ দিনে। ছানা ১২ থেকে ১৭ দিনে বড় হয় ও বাসা ছাড়ে। তবে ওড়া শিখতে আরও প্রায় ১২ দিন লাগে। আয়ুষ্কাল প্রায় পাঁচ বছর।

  • আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি, বন্য প্রাণী প্রজনন চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ