Thank you for trying Sticky AMP!!

পদ্মা এখন যেন পোষমানা এক নদী

পদ্মা নদী

এতকাল বাঙালির মানসপটে পদ্মা নদীর যে ছবি আঁকা ছিল, তা অনেকটাই ফিকে হয়ে যেতে বসেছে। পদ্মা সেতু যেন পদ্মা নদীকে বশ করেছে। এই ঈদে লাখ লাখ মানুষ পদ্মার ওপর দিয়ে যাওয়া-আসা করেছে। কারও বুক কাঁপেনি। কোটি কোটি মানুষ সেতু পার হবে। তারা দেখবে সেতুর নিচে বয়ে চলা পোষমানা এক নদী।

বাংলাদেশ নদীর দেশ। এখানে নদীর নাম উচ্চারণ করতেই শুরুতে আসে পদ্মা। ‘পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’ বা ‘এই পদ্মা-এই মেঘনা’। এভাবেই বলতে-গাইতে বাঙালি অভ্যস্ত। পদ্মাই প্রধান নদী। বাঙালির মগজে যে খরস্রোত, তা পদ্মার। যে উত্তাল ঢেউয়ের চিন্তায় মানুষ আন্দোলিত হয়, সে ঢেউ পদ্মার। ভাঙনের শব্দ এ দেশের মানুষকে শুনিয়েছে এই নদী। সবকিছু হারিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর যে ক্ষমতা বাঙালির ডিএনএতে আছে, তা এসেছে পদ্মার বুকে জেগে ওঠা চর থেকে।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ‘পদ্মানদীর মাঝি’ উপন্যাসে লিখেছেন: ‘গতিশীল জলতলে পদ্মার মাটির বুক কেহ কোনো দিন দেখে নাই, চিরকাল গোপন হইয়া আছে।’ এখন আর তা গোপন নেই। পদ্মা সেতুর বিজ্ঞানীরা সেই রহস্য উন্মোচন করেছেন। পদ্মার বুকে ঠুকে দিয়েছেন একের পর এক পিলার, পাইল। বুক ভেদ করে চলে গেছে বহু গভীরে।

পদ্মা সেতু

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় উপন্যাসটি লিখেছিলেন প্রায় ৯০ বছর আগে। তখনো পদ্মা বিখ্যাত ছিল ইলিশের কারণে, ঠিক আজও যেমন। তখনো পদ্মাপাড়ের জীবন ছিল অনিশ্চয়তায় ভরা, ঠিক আজও যেমন। পদ্মাপাড়ের মাঝি ও জেলেদের জীবনের বর্ণনায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন: ‘টিকিয়া থাকার নির্মম অনমনীয় প্রয়োজনে নিজেদের মধ্যে রেষারেষি কাড়াকাড়ি করিয়া তাহারা হয়রান হয়। জন্মের অভ্যর্থনা এখানে গম্ভীর, নিরুৎসব, বিষণ্ন। জীবনের স্বাদ এখানে ক্ষুধা ও পিপাসায়, কাম ও মমতায়, স্বার্থ ও সংকীর্ণতায়। আর দেশি মদে। তালের রস গাঁজিয়া যে মদ হয়, ক্ষুধার অন্ন পচিয়া যে মদ হয়। ঈশ্বর থাকেন ওই গ্রামে, ভদ্র পল্লিতে। এখানে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।’

নদী ভাঙে। পদ্মাও তার নিজের পাড় নিজে ভাঙে। নদীবিজ্ঞানীরা বলছেন, পদ্মার কোনো কোনো ভাঙন ২০ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়। দেশব্যাপী নদীর ভাঙন আছে। আবার গড়ে ওঠে কূল, জাগে চর। বাঙালি মানসগঠনে এই ভাঙনের প্রভাব আছে—এমন কথাই লিখেছেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। বাঙালি চেনার ক্ষেত্রে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও অমর্ত্য সেনের মধ্যে দূরবর্তী হলেও অন্তর্গত মিল আছে।

নদীকে চিনতে হলে ভাসতে হয় নদীতে। নদীতে ভেসে চলার অনাবিল আনন্দের এক অপূর্ব বর্ণনা আছে অমর্ত্য সেনের স্মৃতিকথায়। তাঁর স্মৃতিকথা ‘হোম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’-এর প্রথম খণ্ডের দ্বিতীয় অধ্যায় বাংলার নদ-নদী বিষয়ে লেখা। হিমালয়ের উচ্চ শিখরে মানস সরোবরে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের উৎপত্তি। উৎপত্তির পর থেকেই দুই নদীই সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে প্রবাহিত হয়েছে। হারিয়ে যাওয়া বন্ধুকে পাওয়ার যে আনন্দ, সেই আনন্দই গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র উপভোগ করেছে বাংলাদেশে। একে অপরকে আলিঙ্গন করেছে, আরিচা-গোয়ালন্দের কাছে।

গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের (যমুনা) মিলিত স্রোতোধারাই পদ্মা। এই মিলিত ধারার বর্ণনায় ‘নদী ও নারী’ উপন্যাসে হুমায়ুন কবির লিখেছেন, ‘সকালের আলোতে পদ্মার সে কী রূপ। দূরে বহু দূরে অন্য পাড়ের আভাস, মাঝে মাঝে যেন ডাঙ্গা জেগে উঠেছে, চরের কাছে জলের স্রোত সূর্যালোকে ঝসলে উঠছে। কী বিপুল মুক্তি, কী উদার বিস্তার। আকাশ দূরে পৃথিবীর উপর এসে নুয়ে পড়েছে—সেই আসমান এবং জমিনের মধ্য দিয়ে বিরাট জলের প্রবাহ, দিন নাই রাত্রি নাই উদ্দাম জলের ধারা কখনো সগর্জনে কখনো নিঃশব্দে বয়ে চলেছে।’

অমর্ত্য সেন তাঁর লেখায় ‘নদী ও নারী’ উপন্যাসের প্রসঙ্গ তুলেছেন। অর্থনীতি বাদ পড়লে তাঁর লেখা মাহাত্ম্য হারায়। এই দার্শনিক অর্থনীতিবিদ বলছেন, ষোড়শ শতকের শেষ দিকে পদ্মার জন্ম হওয়ার পর এটি গঙ্গার মূল ধারায় পরিণত হয় এবং হিমালয়ের পানির বড় অংশ পূর্ববঙ্গ দিয়ে প্রবাহিত হতে শুরু করে।

এই পরিবর্তন পূর্ববঙ্গের অর্থনীতিকে উপমহাদেশ তথা বৈশ্বিক বাজারের সঙ্গে যুক্ত করে। পূর্ববঙ্গে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেড়ে যায়। পূর্ববঙ্গ থেকে দ্রুত রাজস্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে। স্ফীত হতে থাকে মুঘল সম্রাটদের কোষাগার।

অর্থনীতির গুরুত্ব বিবেচনা করে সেই পদ্মার ওপর তৈরি হয়েছে সেতু। মানুষের মুখে মুখে এই সেতুর নাম। জিডিপিতে পদ্মা সেতুর অবদান নিয়ে সাধারণ মানুষের মাথাব্যথা নেই। মানুষ দেখছে, এই সেতু তাদের জীবনকে সহজ করে তুলেছে। পদ্মার ঢেউ যতই উত্তাল হোক, মানুষ তাকে আর ভয় করে না। পদ্মার কথা উঠলেই প্রথমে চোখের সামনে ভেসে উঠবে পদ্মা সেতু। পদ্মার কীর্তিনাশা চেহারা এ দেশের মানুষের মানসপট থেকে ধীরে ধীরে মুছে যেতে থাকবে।