Thank you for trying Sticky AMP!!

তিন বাজপাখির গল্প 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে হিমালয়ী বাজ

এক যুগ আগের কথা। সহকর্মী জীবন চন্দ্র দাসসহ গাজীপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ফলের বাগানে ঘুরছি। হঠাৎ একটি শিকারি পাখিকে তিরবেগে উড়ে আসতে দেখলাম। পাখিটি আমাদের মাত্র মিটার কয়েক সামনে এসে আচমকা একটি উড়ন্ত লাল ঘুঘুর বুক বরাবর পায়ের ধারালো নখ বসিয়ে দিল। এমন দৃশ্যের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। ক্যামেরায় একটি ক্লিক করতে পারলেও ঘটনার আকস্মিকতায় হাত কেঁপে ছবিটি নষ্ট হলো। শিকার পায়ে গেঁথে পাখিটি দ্রুত উড়ে গেল। তবে আরও কিছু বিস্ময় অপেক্ষা করছিল! পাখিটি উড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আচমকা শত ডানা ঝাপটানির শব্দ শুনলাম। সামনের দিকে তাকাতেই দেখি আশপাশের গাছে বা মাটিতে থাকা সব ঘুঘু একসঙ্গে মাটিতে বুক ঠেকিয়ে শুয়ে পড়েছে। শিকারি পাখিটি দৃষ্টির অগোচরে যাওয়া পর্যন্ত ওরা এভাবেই থাকল। পরিস্থিতি শান্ত হলে যে যার মতো ফিরে গেল। এমন দৃশ্য জীবনে প্রথম দেখলাম! 

এতক্ষণ যে শিকারি পাখিটির গল্প বললাম, সে এক প্রজাতির বাজপাখি (বাজার্ড)। এ ছাড়া ওর আরও দুটি জাতভাই আছে, যারা সবাই পরিযায়ী শিকারি পাখি। এই তিন পাখি নিয়েই আজকের ফিচার। চিল-ইগল-শকুন ও অন্যান্য শিকারি পাখির মতো ওরাও অ্যাক্সিপিট্রিফরসেম বর্গের অ্যাক্সিপিট্রিডি গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। এখানে ওদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া হলো।

১. হিমালয়ী বাজ (হিমালয়ান বাজার্ড): এতক্ষণ যে পাখিটির দুর্দান্ত শিকারের রোমহর্ষ গল্প বললাম, সে-ই হিমালয়ী বাজ। বিরল পরিযায়ী পাখিটি অল্প কবারই মাত্র এ দেশে দেখা গেছে। পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Buteo refectus। একসময় ওকে কমন বাজার্ড-এর উপপ্রজাতি হিসেবে বিবেচনা করলেও জেনোমিক ও মলিকুলার গবেষণায় ওর স্বতন্ত্রতা প্রমাণিত হওয়ায় আলাদা প্রজাতি হিসেবে গণ্য করা হয়। হিমালয়ের আশপাশের দেশ, যেমন নেপাল, ভুটান, ভারত, পাকিস্তান ও দক্ষিণ তিব্বতের আবাসিক পাখিটি শীতে উত্তর-পূর্ব ভারত ও বাংলাদেশে পরিযায়ী হয়। কিছুটা জাপানি বাজের মতো দেখতে পাখিটি দৈর্ঘ্যে ৪৫ থেকে ৫৩ সেন্টিমিটার। 

২. জাপানি বাজ (জাপানিজ/ইস্টার্ন/কমন বাজার্ড): এটিই বাজপাখি নামে পরিচিত। রাজশাহীর পদ্মা নদীর চরে কালাজাং ও লোহারজং সারস পাখি খুঁজতে গিয়ে ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে চরের বালুতে পাখিটিকে বসে থাকতে দেখি। এরপর বিভিন্ন সময় রাজশাহী ও পঞ্চগড়ে দেখেছি। সর্বশেষ গত ফেব্রুয়ারিতে দেখলাম রাজশাহীর পদ্মায়। পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Buteo japonicus। ইউরোপ, রাশিয়া, মধ্য এশিয়া, মঙ্গোলিয়া, চীন ও জাপানের আবাসিক পাখিটি শীতে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে আসে। দেহের দৈর্ঘ্য ৪২ থেকে ৫৪ সেন্টিমিটার। ওজনে পুরুষ ৬৩০ থেকে ৮১০ গ্রাম ও স্ত্রী ৫১৫ থেকে ৯৭০ গ্রাম হয়।

রাজশাহীর পদ্মার চরের ওপর উড়ন্ত জাপানি বাজ

৩. প্রজাপতি বাজ (লং-লেগড বাজার্ড): রাজশাহীর পদ্মা নদীসংলগ্ন সিমলা পার্কে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরের সকালের মিষ্টি রোদে অদ্ভুতদর্শন খরমার ছবি তুলে দাঁড়িয়েছি মাত্র। এমন সময় মাথার ওপর দিয়ে একটি শিকারি পাখি প্রজাপতির মতো দুর্বলভাবে ‘ভি’ আকারে ডানা মেলে উড়ে এসে পাশের খড়ের স্তূপে বসল। অন্য দুটি বাজের চেয়ে লম্বা পায়ের এই পাখিই প্রজাপতি বাজ। অন্য নাম ইঁদুরমারা চিল বা চুহামারা (পশ্চিমবঙ্গ)। এ দেশের দুর্লভ পরিযায়ী পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Buteo rufinus। দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা ও মধ্য এশিয়ার আবাসিক পাখিটি শীতে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় পরিযায়ী হয়। দেহের দৈর্ঘ্য ৪৩ থেকে ৫৮ সেন্টিমিটার। ওজনে পুরুষ ৫৯০ থেকে ১,২৮১ গ্রাম ও স্ত্রী ৯৪৫ থেকে ১,৭৬০ গ্রাম। রাজশাহী ছাড়াও পাখিটিকে কক্সবাজারের সোনাদিয়ায় ও সর্বশেষ গত নভেম্বরে ঢাকার উত্তরায় দেখেছি।

রাজশাহী শহরের কাছে সিমলা পার্কে উড়ন্ত প্রজাপতি বাজ

শীতে ওরা দেশের বড় নদী ও উন্মুক্ত এলাকা বরাবর, আবাদি জমি, তৃণভূমি, জলাভূমি, পাহাড়ি এলাকা ইত্যাদিতে একাকী বা জোড়ায় বিচরণ করে। আকাশে উড়ে উড়ে অথবা মাটিতে বা গাছের ওপর বসে খাবারের সন্ধান করে। ভূমিতে থাকা ইঁদুর, সাপসহ সরীসৃপ, পাখি, অমেরুদণ্ডী প্রাণী ইত্যাদির ওপর হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে পায়ের ধারালো নখ দিয়ে শিকার করে।

যদিও হিমালয়ী বাজের প্রজননসংক্রান্ত তথ্য কম, তবু মার্চ থেকে জুন ওদের প্রজননকাল। আবাস এলাকার গাছের ডাল, পাহাড়ের চূড়া বা ঢালে ডালপালা, কাঠিকুটি ও পাতা দিয়ে মাচানের মতো বাসা বানায়। দুই থেকে তিনটি ধূসরাভ-সাদাটে ডিম পাড়ে, যা ৩৩ থেকে ৩৮ দিনে ফোটে। ছানারা ৪৩ থেকে ৬০ দিনে উড়তে শেখে। আয়ুষ্কাল কমবেশি ১০ বছর।