Thank you for trying Sticky AMP!!

দিন দিন ছোট হচ্ছে কর্ণফুলী

উচ্ছেদ বন্ধ। এখনো রয়েছে হাজারের বেশি অবৈধ দখলদার। তিন যুগে ৫০৬ মিটার ছোট হয়েছে কর্ণফুলী।

কর্ণফুলী নদীর জায়গায় তৈরি হচ্ছে কর্ণফুলী ড্রাই ডক। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন বলছে, এই ড্রাই ডক গড়ে উঠেছে অবৈধভাবে। গত মঙ্গলবার দুপুরে কর্ণফুলী উপজেলার বদলপুরা এলাকায়

ঢাকঢোল পিটিয়ে কর্ণফুলীতে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ শুরু হয়েছিল চার বছর আগে। অর্ধেক উচ্ছেদের পর মাঝপথে তা বন্ধ হয়ে যায়। এখন পুরোনো অবৈধ স্থাপনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন সরকারি-বেসরকারি দখলদার। ক্রমাগত দখল, ভরাট ও ইজারা প্রক্রিয়ার কারণে ৩৬ বছরে নদীটির প্রশস্ততা কমেছে অর্ধেকের বেশি।

কেবল শাহ আমানত সেতুসংলগ্ন কর্ণফুলীর উত্তর তীরে ফিশারিঘাট মাছ বাজার এলাকায় নদীর প্রশস্ততা কমে এখন হয়েছে ৪৪৬ মিটার। ১৯৮৫ সালের হিসাবে প্রশস্ততা কমেছে ৫০৬ মিটার। বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নদীর জায়গা ইজারা নিয়ে এই মাছ বাজার গড়ে তোলা হয় ২০১৫ সালে। কর্ণফুলী ঘিরে এই বাজারসহ এক হাজারের বেশি অবৈধ স্থাপনা রয়েছে।

নদী রক্ষায় পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে আইনজীবী মনজিল মোরশেদ ২০১০ সালে হাইকোর্টে একটি রিট করেছিলেন। এরপর ২০১৬ সালে হাইকোর্ট কর্ণফুলীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশ দেন। তখন স্থাপনা ছিল ২ হাজার ১১২টি।

কর্ণফুলী তীরে মাছ বাজার ও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ জন্য বার বার তাগাদ দিচ্ছে নদী কমিশন।গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় চট্টগ্রাম নগরের ফিরিঙ্গি বাজার নতুন ফিশারী ঘাটে

২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে নদীর সদরঘাট থেকে বারিক বিল্ডিং পর্যন্ত উচ্ছেদ কার্যক্রম চালিয়েছিল জেলা প্রশাসন। বারিক বিল্ডিং থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত উচ্ছেদ চালানোর দায়িত্ব ছিল বন্দর কর্তৃপক্ষের। দুই পক্ষ মিলে হাজারখানেক স্থাপনা উচ্ছেদ করে।

কিন্তু দুই কর্তৃপক্ষই তাদের উচ্ছেদ কার্যক্রম শেষ করেনি। এসব স্থাপনার মধ্যে ফিশারিঘাটের মাছবাজারটি মাথাব্যথার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজামান প্রথম আলোকে বলেন, মামলাসহ নানা কারণে আমাদের উচ্ছেদ কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে মাছবাজার নিয়ে ব্যবসায়ীরা আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন। আদালত বলেছেন, পুনর্বাসন করে তাদের উচ্ছেদ করতে।

ভারতের মিজোরামের লুংলেই পাহাড়ে জন্ম নেওয়া কর্ণফুলী নদীটি অর্থনৈতিক দিক থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। উৎসমুখ থেকে অন্তত ২০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে রাঙামাটির বরকল উপজেলার টেগারমুখ এলাকায় বাংলাদেশে ঢুকেছে কর্ণফুলী। উৎসমুখ থেকে শুরু করে পতেঙ্গায় বঙ্গোপসাগরে মিলিত হওয়া পর্যন্ত নদীটির পথে পথে বাঙালি, ত্রিপুরা, মারমা, চাকমা, তঞ্চ্যাঙ্গাসহ নানা জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। পতেঙ্গার মোহনার আগে দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর এই নদীর তীরে অবস্থিত। এ বন্দরে প্রতিবছর তিন হাজারের বেশি জাহাজ আসা-যাওয়া করে। কিন্তু দখলের কারণে দিন দিন ছোট হচ্ছে নদীটি।

যতটা কমেছে নদীর প্রশস্ততা

কর্ণফুলী তীরে মাছ বাজার ও অবৈধ স্থাপনা

ফিশারিঘাট এলাকায় ২০১৫ সালে বাংলাদেশ জাতীয় মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেড চট্টগ্রামকে ৩ দশমিক ৯৭ একর ভূমি ইজারা দেয় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। এটা মূলত জেগে ওঠা চর। অবৈধ স্থাপনার তালিকায় থাকা এই বাজার উচ্ছেদে জেলা প্রশাসন নানা তৎপরতা শুরু করেছিল।

২০২১ সালের ২৮ ডিসেম্বর এ-সংক্রান্ত একটা আপিল শুনানি বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়। অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) প্রকাশ কান্তি চৌধুরী ওই শুনানির পর্যালোচনায় উল্লেখ করেন, জাতীয় মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেডের স্থাপনাসংলগ্ন স্থানে কর্ণফুলী নদীর দুই তীরের প্রশস্ততা কমেছে। গুগল মানচিত্র পর্যালোচনা করে ওই এলাকার বিভিন্ন সময়ের নদীর ক্রমহ্রাসমান প্রশস্ততা তুলে ধরা হয় পর্যালোচনায়।

এতে দেখা যায়, ১৯৮৫ সালে ওই জায়গায় নদীর প্রশস্ততা ছিল ৯৫২ দশমিক ২৮ মিটার। ২০০০ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৯৩১ দশমিক ১২ মিটার। ২০১০ সালে দাঁড়ায় ৬১৫ মিটার। ২০১৫ সালে প্রশস্ততা ছিল ৫৪৮ মিটার। ২০২১ সালে হয় ৪৪৬ মিটার।

ওই শুনানিতে ফিশারিঘাটের অংশটি ১ নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত দাবি করে জেলা প্রশাসন। তবে বন্দর কর্তৃপক্ষ বন্দর অর্ডিন্যান্স ১৯৭৬ অনুসারে জায়গাটি তাদের দাবি করে ইজারা দেয়।

এরপর গত বছরের নভেম্বরে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী নদীর অবৈধ স্থাপনা পরিদর্শন করে জেলা প্রশাসনকে উচ্ছেদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ সময় তিনি বলেন, নদীর জায়গায় ফিশারিঘাট মাছবাজার গড়ে উঠেছে।

এ বিষয়ে ফিশারিঘাট পরিচালনা কমিটি সোনালি যান্ত্রিক মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক আমিনুল হক বাবুল সরকার বলেন, উচ্ছেদে আদালত নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন।

আরও সহস্রাধিক দখলদার

উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নতুন করে স্থাপনাও গড়ে ওঠে নদীতে। পতেঙ্গা মাঝের বস্তি এলাকায় নতুন নতুন স্থাপনা নির্মাণের অভিযোগ রয়েছে। এর আগে ২০২১ সালে পতেঙ্গার লালদিয়ার চরে উচ্ছেদ অভিযান চালায় বন্দর। এরপর আর কোনো উচ্ছেদ অভিযান করা হয়নি।

ফিরিঙ্গি বাজার থেকে বাকলিয়া পর্যন্ত উচ্ছেদ অভিযানও করেনি জেলা প্রশাসন। সব মিলিয়ে এক হাজারের মতো স্থাপনা এখনো রয়ে গেছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, ফিশারিঘাট মাছবাজারের পাশেই রয়েছে ভেড়া মার্কেট বস্তি। সেখানে বিভিন্ন ব্যক্তি দখল করে অস্থায়ী ঘর করে তা ভাড়া দিয়েছেন। নদীর উত্তর পাড়ে বাকলিয়া, খেতচর, নোমান কলেজ এলাকায়ও বস্তি, দোকানপাট, কারখানা, গ্যারেজ ইত্যাদি গড়ে উঠেছে।

আবার বর্তমান ফিশারিঘাটের পাশে ফিরিঙ্গি বাজার এলাকায় নদীর চর জেগে ওঠা ১২ একর জায়গা নিয়েও জেলা প্রশাসনের সঙ্গে বিরোধ চলছে বন্দরের। জেলা প্রশাসন ওই এলাকায় খেলার মাঠ ও পার্ক করতে চায়। এ নিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ আদালতের দ্বারস্থ হয় ১২ জুলাই। পরে আদালত জেলা প্রশাসনকে জমির আকার-প্রকার পরিবর্তনে নিষেধাজ্ঞা দেন। সর্বশেষ নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে।

এ বিষয়ে ডিসি আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, ‘এটা নিয়ে বন্দরের সঙ্গে আমাদের কথাবার্তা চলছে।’

নদীর সার্বিক দখল ও উচ্ছেদ কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাইলে বন্দরের সহকারী ব্যবস্থাপক (এস্টেট) মুহাম্মদ শিহাব উদ্দিন বলেন, উচ্ছেদ করা হয়েছে, আরও হবে। এ নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বক্তব্য দেবে।