Thank you for trying Sticky AMP!!

আমাদের বনের ঢোল

হবিগঞ্জের সাতছড়ি বনে ঢোলের ছবি ক্যামেরা ট্যাপিংয়ের মাধ্যমে তুলেছেন মুনতাসির আকাশ।

ভুলংটুলী মোন রাঙামাটির কাসালং বনের সবচেয়ে উঁচু পাহাড়। এই এলাকার চেয়ে গহিন পাহাড়ি বন আর এ দেশে টিকে নেই। এ বনাঞ্চলে মানুষের পদচারণ একেবারেই নেই। এমনকি আশপাশের স্থানীয় পাহাড়িরাও এ গহিন বনে যান না। মূলত বড় স্তন্যপায়ী প্রাণীর আক্রমণের ভয়েই এ এলাকা তাঁরা এড়িয়ে চলেন।

একবার এ এলাকায় এক কঠিন ভ্রমণযাত্রা করার পরিকল্পনা করলাম। সময়টা ছিল গত বছরের ২৩ জুলাই। সাত দিনের অভিযাত্রার এ পরিকল্পনা ছিল অনেকটা স্বপ্নের মতো। কাসালং বাজার থেকে শুকনো খাবার কিনে নদীপথে রওনা হলাম। বনের কাছাকাছি শেষ গ্রামটির নাম বোয়াছড়ি। এরপর আর কোনো জনমানব নেই। শুধুই গহিন অরণ্য। বৃষ্টি ও প্রচণ্ড গরমের সময় হওয়ায় গন্তব্যটা আরও কঠিন ছিল। যাত্রাপথে সকাল, বিকেল, দুপুর—বনের ভেতর যেদিকেই তাকাই হরেক রকম বুনো প্রাণীর দেখা পাই।

২৬ জুলাই আমরা দুসরী পর্যন্ত যাব বলে ঠিক করলাম। আগের রাতে অনেক বৃষ্টি হলো। রাতটি আমরা যাপন করলাম আভালংছড়াতে। সহকর্মীরা রাতের বেলা ঘুমাতে পারেননি বললেই চলে। ছোট্ট একটা কাঠের নৌকায় বসে বসে কাটিয়েছেন। ভাগ্যিস, আমি একটি মশারি টেন্ট নিয়ে গিয়েছিলাম! বৃষ্টির সময় পাহাড়ি ঢল নামে বিধায় ভয়ে ভয়ে সারা রাত টেন্টের ভেতর বসেই কাটিয়ে দিলাম।

পরদিন ভোরের আকাশটা একদম পরিষ্কার, খুব সকালেই পাহাড়ি পাথুরে ছড়া দিয়ে এগোতে থাকলাম। এ অঞ্চলটাতেই কদিন আগে একটি বুনো ভালুক স্থানীয় এক ব্যক্তিকে কামড়ে গুরুতর আহত করেছিল। এ এলাকার আশপাশেই এখনো বনগরু, বনছাগল আর চিতা বাঘ আছে বলে সব রকম তথ্য পাওয়া যায়। বোয়াছড়ির একজন জেলে জুন মাসেই একটি বাঘকে নদী পার হতে দেখেছেন বলে তথ্য দিলেন। এ ছাড়া এ এলাকায় বুনো হাতির একটি দলও আছে। সব মিলিয়ে একেবারেই বুনো পরিবেশ যাকে বলে।

দুসরী যেতে আমাদের প্রায় ১১টা বেজে গেল। এরপর ছড়ার পানি একেবারেই কম। নৌকা ঠেলে আর যাওয়া সম্ভব হলো না। ওইখানেই নৌকা নোঙর করে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করা হলো। প্রায় দুই ঘণ্টা এক জায়গায় বসে থাকলাম। বেশ কয়েক প্রজাতির পাখির ছবি তুললাম।

এর মধ্যে একটি পাখি ছিল গোল্ডেন ক্রেস্টেড ময়না। একটি প্রাণীর পায়ের ছাপ দেখতে পেলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম বুনো হরিণের পায়ের ছাপ। কিন্তু এক গবেষক সহকর্মী বললেন, এগুলো বুনো কুকুর বা ঢোলের পায়ের ছাপ। এর আগে ঢোলের এত ছাপ একসঙ্গে দেখিনি। মনে হলো, কাসালং বনটিতে বনের ঢোল বেশ ভালো অবস্থায় টিকে আছে।

আমাদের বনের ঢোল নিয়ে গবেষক কিংবা সাধারণ মানুষের আগ্রহ কম। হয়তো বুনো পরিবেশে এর দেখা পাওয়া যায় না বলেই প্রাণীটি সংরক্ষণের গুরুত্ব পায় না। অথচ এই প্রাণী দুই যুগ আগেও আমাদের প্রায় সব গহিন বনেই ছিল। সম্প্রতি তানিয়া জাকির ও মুনতাসির আকাশের একটি গবেষণাপত্রে হবিগঞ্জের সাতছড়ি বনে প্রাণীটি আছে বলে তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। বনটি থেকে বেশ কিছু ছবিও তুলেছেন তাঁরা।

ঢোল বিশ্বব্যাপী বিপন্ন একটি প্রাণী। সিঙ্গাপুর, কোরিয়া, মঙ্গোলিয়া, রাশিয়া, আফগানিস্তানসহ বেশ কটি দেশ থেকে ঢোল একেবারেই হারিয়ে গেছে। তবে গোটা পৃথিবীতে সর্বোচ্চ ২ হাজার ২১৫টি প্রাপ্তবয়স্ক ঢোল বুনো পরিবেশে টিকে আছে বলে আইইউসিএন একটি প্রকাশনায় তথ্য দিচ্ছে।

ভারতের আসাম ও ত্রিপুরা অঞ্চলের পাহাড়ি বনে এই প্রাণী এখনো বেশ দেখা যায়। আমাদের কাসালং ছাড়াও সাঙ্গু-মাতামুহুরী সংরক্ষিত বনেও ঢোল আছে বলে ধারণা করা হয়।

ঢোল একটি মাংসাশী প্রাণী। একটি প্রাকৃতিক বনে ঢোলের উপস্থিতি প্রমাণ করে ওই বন খুব ভালো অবস্থায় আছে। এ দেশের বনে ঢোলের প্রকৃত সংখ্যা জানা খুবই জরুরি। তাহলে সে অনুযায়ী প্রাণীটি সংরক্ষণে ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হবে।

সীমান্ত দীপু, বন্য প্রাণী গবেষক