Thank you for trying Sticky AMP!!

দালালের খপ্পরে আটকা পড়েন পাকিস্তানে, ৩৫ বছর পর বাবা–ছেলের প্রথম দেখা

দুই ছেলে ও স্ত্রীর সঙ্গে আবদুল জব্বার

বরিশালের বাকেরগঞ্জের দুধল গ্রামের আবদুল জব্বারের রাইস মিল (ধান ভাঙানোর যন্ত্র) ছিল। সেই রাইস মিল বিক্রি করে সব টাকা তুলে দেন দালালের হাতে। স্বপ্ন ছিল ইরান যাবেন। দালাল ভারত ও পাকিস্তান হয়ে তাঁকে ইরানে পাঠানোর চেষ্টা করেন। তবে পাকিস্তানে গিয়ে আটকা পড়েন তিনি। বৈধ কাগজপত্র না থাকায় জেল খাটেন। ৩৫ বছর কাটান অমানবিক জীবন।

১৯৮৮ সালে আবদুল জব্বার যখন ইরান যাওয়ার জন্য দেশ ছেড়েছিলেন, তখন বড় ছেলে আউয়াল আকনের বয়স ছিল মাত্র তিন বছর, মেয়ে নূপুর ছিল দুই বছরের। আর ছোট ছেলে কামাল হোসেন তখনো জন্মায়নি; এর তিন মাস পর সে পৃথিবীতে আসে। সেই কামাল বড় হয়ে বাবাকে দেশে ফেরানোর জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন। অবশেষে গত শুক্রবার (২০ অক্টোবর) দেশে ফেরেন আবদুল জব্বার। সাড়ে তিন দশক পর দেখা বাবা ও ছেলের।

আজ রোববার মুঠোফোনে আবদুল জব্বার ও কামাল হোসেনের সঙ্গে কথা হয়। দীর্ঘ সময় পাকিস্তানে থাকার কারণে আবদুল জব্বার উর্দু ভাষায় কথা বলতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে বাংলায় কথা শুরু করলেও একটু পর পরই উর্দু চলে আসছিল তাঁর মুখে।

কামাল জানালেন, বেশি আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়লে বা অনেকক্ষণ কথা বলতে গেলে তাঁর বাবা বাংলায় আর কথা বলতে পারছেন না।

বড় ভাই আবদুল রশীদকে লেখা আবদুল জব্বারের সেই চিঠি

কামাল তাঁর বাবাকে দেশে ফেরাতে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির সহায়তা নিয়েছেন। ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির মাধ্যমে দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি চালাচালির পর দেশে ফিরতে পারেন আবদুল জব্বার।

কামাল বললেন, ‘চলতি বছরের জানুয়ারি মাস থেকে বাবাকে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। ফিরলেন ২০ অক্টোবর। বাবা দেশে ফিরবেন, বাবাকে দেখব—এ অস্থিরতায় শেষ দিকে আর দিন পারই হতে চাচ্ছিল না! জন্মের ৩৫ বছর পর বাবাকে প্রথম দেখলাম। সে অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না!’

কামাল জানালেন, তাঁর বাবা দেশ ছাড়ার পর থেকে মা রাশেদা বেগম অনেক কষ্টে তাঁদের দুই ভাই ও এক বোনকে বড় করেছেন। বোনের বিয়ে দিয়েছেন।

কামাল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে স্নাতকোত্তর করেছেন। সাভারের নবীনগরে বাসা ভাড়া করে সেখানেই মাকে নিয়ে থাকেন। সেখানে শিক্ষার্থীদের কোচিং করান। বড় ভাই আউয়াল গাজীপুরে কাজ করছেন। আবদুল জব্বার দেশে ফেরার পর নবীনগরে আছেন।

কামাল বললেন, ‘বাবা দেশ ছাড়ার তিন মাস পর আমি পৃথিবীতে আসি। বাবার স্পর্শ পর্যন্ত পাইনি! তিন সন্তান নিয়ে মা আমার দুঃখের সাগরে হাবুডুবু খান। প্রথমে বাসার আসবাবপত্র বিক্রি করে দেন। মা মানুষের বাসায় কাজ করে এক কেজি চাল পেতেন। তা দিয়ে সংসার চলত। নিরুপায় হয়ে মা বড় ভাইকে স্থানীয় এক লোকের কাছে পেটে-ভাতে চুক্তিতে কাজে দেন। ভাইয়ের বয়স তখন মাত্র ৯–১০ বছর বয়স। কাজে ভুল হলেই ওই লোক ভাইকে মারধর করতেন। ভাইয়ের পড়াশোনা হলো না। কত কষ্ট যে ভাই আমার করেছে, তা ভাষায় প্রকাশ অসম্ভব! একদিন অনেক মারধর করার পর ভাই পালাল। পরে বরিশালের রহমতপুরের একটা হোটেল পেটে-ভাতে কাজ করত।’

ছোট ছেলে কামালের সঙ্গে আবদুল জব্বার

নিজের প্রসঙ্গে কামাল জানান, বড় ভাই যে বাসা থেকে পালিয়ে যান, সেই বাসায় তাঁকেও রান্নার কাজসহ মাছ চাষ, গরু লালন-পালন, কলার বাগানে কাজ, সবজি চাষসহ কত কাজ যে করতে হয়েছে, তার হিসাব নেই! কাজে সামান্য ভুল হলে তিনিও মার খেতেন। একদিন ডিম ভাজি করতে বেশি তেল দিয়েছেন, এ অভিযোগে তাঁকে লাথি মারলে কয়েক ফুট দূরে গিয়ে পড়েছিলেন। তখন ‘মা’ বলে একটা চিৎকার দিয়েছিলেন!

কামাল বলেন, ‘আকাশে প্লেন যেত যখন, অনেক মানুষ দৌড়ে বের হতো দেখার জন্য। আমিও যেতাম, কিন্তু লোকজন আমায় নিয়ে উপহাস করে বলত তোর বাবা যাচ্ছে প্লেনে করে!’

ওই লোকের বাড়ি থেকে কামালও পালাতে বাধ্য হন। মায়ের এক খালার বাড়িতে আশ্রয় নেন। সেখানে দিনের বেলা কাজ করে রাতে পড়াশোনা করতেন। স্কুলে ভর্তির প্রথম দিকে ফেল করলেও পরে আস্তে আস্তে ভালো ফল করতে থাকেন। ২০০২ সালে মায়ের কাছে ফিরে এসে গ্রামের স্কুলে ভর্তি হন। অন্যের বাড়িতে জায়গির থেকে, শিক্ষার্থী পড়িয়ে নিজের পড়াশোনার খরচ জোগাতেন। ২০০৯ সালে এসএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ–৫ পান। তখন পত্রিকায় কামালের ছবি ছাপা হয়েছিল।

কামাল জানালেন, পাঁচ বছর আগে মায়ের ক্যানসার ধরা পড়ে। কোনো রকমে মায়ের চিকিৎসা চলছে। বললেন, ‘ভেবেছিলাম বাবা হয়তো বেঁচে নেই। এখন প্রায় ৭০ বছর বয়সী বাবাকে কাছে পেয়ে পৃথিবীটা অনেক সুন্দর হয়ে গেছে। বাবাও শারীরিকভাবে খুব অসুস্থ।’

আবদুল জব্বার বিদেশ যাওয়ার পর ছয় মাসের মাথায় পরিবারকে জানাতে পেরেছিলেন, তিনি খুব বিপদের মধ্যে আছেন। এরপর ১৫ বা ২০ বছর আগে একবার করাচি থেকে উর্দুতে একটি চিঠি এসেছিল, কিন্তু সে চিঠি কেউ পড়তে পারেননি। এরপর সব যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। কোনোভাবেই দেশে ফিরতে পারছিলেন না আবদুল জব্বার।

কামাল জানালেন, তাঁর চাচা আবদুল রশীদ মারা গেছেন, এ খবর বাবা জানতেন না। গত ৮ জানুয়ারি বাবা অন্য একজনকে দিয়ে বাংলায় চিঠি লিখিয়ে চাচার ঠিকানায় পাঠান। সেই চিঠিতে থাকা একটি মঠোফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করেন কামাল। তবে সেই নম্বরে কল ঢুকছিল না। এরপর কামাল পাকিস্তানের ইংরেজি ডন পত্রিকার ফেসবুক পেজে এ চিঠির কথা উল্লেখ করে লেখেন, কেউ তাঁকে সহায়তা করতে পারবেন কি না। তখন এক পাকিস্তানি চিকিৎসক সহায়তায় এগিয়ে আসেন। বাংলাদেশে পাঠানো চিঠিতে টেলিফোন নম্বরে একটি শূন্য বেশি ছিল বলে কামাল যোগাযোগ করতে পারছিলেন না। এরপর ওই চিকিৎসক আবদুল জব্বারের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতে সার্বিকভাবে সহায়তা করেন।

কামাল বলেন, ‘ব্র্যাকের সহায়তায় ২৫ বছর পর সৌদিপ্রবাসী আবুল কাশেমের সন্ধান পেয়েছেন তাঁর সন্তানেরা—এমন একটি ভিডিও দেখেছিলাম। তাই ব্র্যাকের কাছে বাবাকে ফিরিয়ে আনার জন্য সহায়তা চাই। ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির রায়হান কবির নামের একজন যোগাযোগ করেন। এরপর তো বাবাকে ফেরত পেলাম। যাঁরা বাবাকে দেশে ফিরতে সহায়তা করেছেন, সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।’

আবদুল জব্বারকে দেওয়া ভিসা

ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক (মাইগ্রেশন অ্যান্ড ইয়ুথ প্ল্যাটফরম) শরিফুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, আবদুল জব্বার মানব পাচারের শিকার হয়েছিলেন ৩৫ বছর আগে। তাঁর বিষয়টি অন্য অভিবাসনকর্মীদের মতো নয়। বৈধ কাগজ ছিল না। তাঁকে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয় ব্র্যাক। এরপর দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, দূতাবাস, পুলিশ, নানান যাচাই–বাছাই শেষে সবার সহায়তায় আবদুল জব্বার দেশে ফিরতে পেরেছেন।

শরিফুল হাসান বললেন, ২৫ বছর পর দেশে ফিরতে পারা আবুল কাশেম বা ৩৫ বছর পর দেশে ফেরা আবদুল জব্বারদের জীবনের গল্পগুলো সিনেমার গল্পগুলোকেও যেন হার মানায়।

জীবন থেকে ৩৫টি বছর হারিয়ে যাওয়ার কথা বলার সময় আবদুল জব্বারের কণ্ঠ থেকে আক্ষেপ ঝরে পড়ছিল। যে ছেলেকে আগে কখনো চোখেই দেখেননি, সেই কামাল এবং বড় ছেলে আউয়ালের কথা উল্লেখ করে গর্বভরে বললেন, এই ছেলেরাই তাঁকে দেখে রাখবেন। এখন আর তাঁর কোনো চিন্তা নেই।