Thank you for trying Sticky AMP!!

রাজাকারের তালিকা আগামী নির্বাচনের আগে হচ্ছে না

জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) আইনের যে সংশোধনী গত বছরের আগস্টে সরকার জাতীয় সংসদে পাস করেছে, তাতে রাজাকারের তালিকা তৈরির ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে জামুকাকে। তবে ছয় মাস আগে আইনগত কর্তৃত্ব পাওয়ার পরও জামুকা রাজাকারের তালিকা তৈরির কাজটি এখনো শুরু করেনি। তারা তাকিয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির দিকে। এই সংসদীয় কমিটি আড়াই বছর আগে নিজ থেকে দায়িত্ব নিয়ে রাজাকারের তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেয়। এ জন্য একটি উপকমিটি কাজ করছে।

এই উপকমিটিও এখন বলছে, স্বাধীনতার এত বছর পর রাজাকারের তালিকা তৈরির কাজটি কঠিন। তাদের সময় লাগবে। অন্যদিকে রাজাকারের তালিকা করার আইনগত কর্তৃত্ব থাকা জামুকার চেয়ারম্যান ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক গত ফেব্রুয়ারি মাসে রাজশাহীতে এক অনুষ্ঠানে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, এ বছর রাজাকারের তালিকা হচ্ছে না। আগামী বছরের মার্চ মাসের মধ্যে এই তালিকা প্রকাশ করা হবে।

উল্লেখ্য, আইন অনুযায়ী, পদাধিকারবলে জামুকার চেয়ারম্যান মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী। গতকাল শুক্রবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি শাজাহান খানের নেতৃত্বে একটি উপকমিটি করে দেওয়া হয়েছে। এখন তাঁরাই বলতে পারবেন কত দূর অগ্রগতি হয়েছে, বল এখন আমার কোর্টে নেই। এ ছাড়া রাজাকারের তালিকা তৈরির ক্ষেত্র আগে বৈধতা ছিল না। সংসদে এখন আইন পাস হয়েছে। এখন অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে এই তালিকা তৈরির কাজটি করতে হবে, যাতে কোনো বিতর্ক না হয়। সে জন্যই বিলম্ব হচ্ছে।’

রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস বাহিনীসহ স্বাধীনতাবিরোধী ১০ হাজার ৭৮৯ জনের তালিকা (প্রথম পর্ব) ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে সরকার প্রকাশ করলেও তাতে নানা ভুল ও অসংগতি থাকায় শেষ পর্যন্ত তা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। সেই তালিকায় কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ব্যক্তির নামও ছিল। আবার কুখ্যাত অনেক রাজাকারের নাম তালিকায় ছিল না। এ নিয়ে সারা দেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়, জাতীয় সংসদেও প্রশ্ন ওঠে। পরে তালিকাটি স্থগিত করার পাশাপাশি নিজেদের ওয়েবসাইট থেকেও সরিয়ে ফেলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়।

রাজাকারের তালিকা নিয়ে বিতর্ক এবং তা প্রত্যাহার হওয়ায় নিজেরাই কাজটি করার উদ্যোগ নেয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। এ জন্য ২০২০ সালের ৯ আগস্ট সংসদীয় স্থায়ী কমিটি একটি সংসদীয় উপকমিটি গঠন করে। শাজাহান খানের নেতৃত্বাধীন ওই কমিটিতে ছিলেন রফিকুল ইসলাম, রাজিউদ্দিন আহমেদ, এ বি তাজুল ইসলাম, ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল ও মোসলেম উদ্দিন আহমেদ। কিন্তু এই কমিটি নিয়মিত বৈঠক করতে পারছিল না। আবার বৈঠক ডাকলেও কোরাম পূর্ণ হতো না। পরে ২০২২ সালের এপ্রিলে সংসদীয় কমিটির বৈঠকে আগের উপকমিটি বাতিল করে শাজাহান খানকে আহ্বায়ক রেখে নতুন কমিটি করে। নতুন উপকমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ ও আওয়ামী লীগের এ বি তাজুল ইসলাম।

রাজাকারের তালিকা তৈরির অগ্রগতি বিষয়ে জানতে চাইলে শাজাহান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা দেড় শর ওপরে উপজেলা থেকে রাজাকারের তালিকা পেয়েছি। পর্যায়ক্রমে দিলেও নানা ধরনের সমালোচনা হবে, একবারের দিলেও হবে, তাই আমরা বারবার বিতর্কের মুখে পড়তে চাই না, একবারে সারা দেশ থেকে পেলেই তালিকা প্রকাশ করব।’

কী প্রক্রিয়ায় রাজাকারদের তথ্য সংগ্রহ করেছেন, এমন প্রশ্নে শাজাহান খান বলেন, ‘জেলা প্রশাসক ও উপজেলা কমান্ডাররা সহযোগিতা করেছেন, এ ছাড়া আমরা নিজেরা ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন উপজেলা থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছি।’ তিনি বলেন, এটা খুব কঠিন কাজ। এমন ব্যক্তিদের নাম আসছে, যাঁরা অনেক বড় বড় অবস্থানে আছেন, এসব যাচাই-বাছাইয়ের প্রয়োজন আছে। এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারদের নির্বাচন হচ্ছে, তাঁদেরও মতামত নিতে হবে। তাই সাবধানে কাজটি করতে হচ্ছে, একটু সময় লাগবে।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণায় যুক্ত ব্যক্তিরা বলছেন, রাজাকারদের তালিকা তৈরির কাজটি জটিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার এত বছর পর রাজাকারের তালিকা করতে গিয়ে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে। তবে কাজটি করার সক্ষমতা সংসদীয় উপকমিটির কতটা রয়েছে, সে প্রশ্নও তুলেছেন তাঁরা। বিশেষ করে এ ধরনের কাজে তথ্য সংগ্রহ, যাচাই-বাছাইয়ের জন্য পেশাদার ও দক্ষ জনবল দরকার। যেটি মন্ত্রণালয় বা অন্য কোনো প্রশাসনিক কাঠামোতে রয়েছে। উপকমিটিকে সাচিবিক সহায়তা দেওয়ার মতো কাঠামো রয়েছে কি না, থাকলে সেটি যথেষ্ট কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। আবার সংসদ সদস্যদের এ ধরনের কাজ করার অভিজ্ঞতা নেই। কাজটি করার জন্য যে পরিমাণ সময় ও নিষ্ঠা দরকার, সেটি কতটা তাঁরা দিতে পারবেন, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। ফলে এই তালিকা তৈরির কাজটি কতটা দক্ষতা ও নির্ভুলতার সঙ্গে করা যাবে, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাবে।

অন্যদিকে রাজাকারের তালিকা তৈরির কাজটি করার আইনগত কর্তৃত্ব থাকার পরও তারা কেন সংসদীয় উপকমিটির তালিকার জন্য বসে আছে, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করা গবেষকেরা। তাঁরা বলছেন, এই কাজে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় উপকমিটিকে কতটা সহায়তা করছে, সেটিও স্পষ্ট নয়।

উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ২৮ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে মুক্তিযুদ্ধের সময় বেতন-ভাতা নেওয়া রাজাকারদের তালিকা জেলা প্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সংগ্রহের সুপারিশ করা হয়েছিল। পরে জেলা প্রশাসকদের চিঠি দিয়ে তালিকা চাওয়া হয়। সে সময় শুধু ১১টি জেলা থেকে প্রতিবেদন এসেছিল। এর মধ্যে চাঁদপুরে ৯ জন, মেহেরপুরে ১৬৯ জন, শরীয়তপুরে ৪৪ জন, বাগেরহাটে ১ জন ও নড়াইল থেকে ৫০ জন রাজাকারের তালিকা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। বাকি ছয়টি জেলার জেলা প্রশাসকেরা জানিয়েছিলেন, তাঁদের জেলার রেকর্ডরুমে রাজাকারদের নামের কোনো তালিকা তাঁরা পাননি।

বর্তমান সরকার বা সংসদীয় উপকমিটি রাজাকারের তালিকা করতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, যে প্রক্রিয়ায় রাজাকারের তালিকা করার উদ্যোগ নিয়েছে সংসদীয় উপকমিটি, তাতে এই তালিকা কখনো হবে বলে মনে হয় না। আমলানির্ভর বা রাজনীতিবিদনির্ভর কোনো কমিটি এ ধরনের তালিকা করতে পারবে না। এ ধরনের তালিকা তৈরি করতে হলে গবেষকদের নিয়ে কমিটি করা উচিত ছিল। এর আগে কয়েক জেলার আমলা বলে দিয়েছিলেন, তাঁদের জেলায় কোনো রাজাকার নেই। ওই সব রাজাকারের আত্মীয়স্বজন যেমন প্রশাসনে আছেন, তেমন ক্ষমতাসীন দলেও আছেন। তাই সরকার রাজাকারের তালিকা প্রণয়নে আন্তরিক নয় বলেই মনে হচ্ছে।