Thank you for trying Sticky AMP!!

সাকরাইন উৎসবের আগে অলিগলিতে রঙিন ঘুড়ির পসরা সাজিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা। ১৩ জানুয়ারি, শাঁখারীবাজার, পুরান ঢাকা  

সাকরাইন উৎসব: ঘুড়িতে রঙিন কুয়াশাঢাকা আকাশ

সূর্য উঠেছে ঠিকই। তবে তার দেখা মিলছে না। ঢাকার আকাশ ঢেকে রেখেছে ঘন কুয়াশা। বইছে কনকনে উত্তুরে হাওয়া। ঘড়িতে তখন বিকেল সাড়ে তিনটা। পুরান ঢাকার বাহাদুরশাহ পার্কের সামনে দাঁড়িয়ে পশ্চিম দিকে তাকিয়ে চোখে পড়ল ধূসর পটভূমিতে ভাসছে রংবেরঙের ঘুড়ি। লাল ইটের তৈরি পুরোনো দিনের গোলাকার পানির ট্যাংকের ওপর দিয়ে লক্ষ্মীবাজারের দিকে আকাশজুড়ে যেন বর্ণালি ছড়িয়ে দিয়েছে উড়তে থাকা ঘুড়ির ঝাঁক।

পৌষের শেষ দিন গতকাল রোববার সকাল থেকেই পুরান ঢাকায় শুরু হয়েছিল ঐতিহ্যবাহী ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব। স্থানীয় বাসিন্দারা পৌষের শেষ দিনের এই ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসবকে বলেন ‘সাকরাইন’। আঞ্চলিক উচ্চারণে ‘স’–এর স্থান অধিকার করেছে ‘হ’। জনসাধারণ্যে তাই বহুল উচ্চারিত ‘হাকরাইন’ নামের উৎসবে শামিল আবালবৃদ্ধবনিতা ঘুড়ি-লাটাই হাতে করে বাড়ির ছাদে উঠে রঙিন করে তোলেন ঢাকার আকাশ।

সংস্কৃত ‘সংক্রান্তি’ শব্দের অর্থ ‘শেষ’ অর্থাৎ ‘পৌষসংক্রান্তি’ হলো পৌষের শেষ দিন। সূর্য তার অক্ষ পরিক্রমায় মকর রাশির অংশে প্রবেশ করে বলে এটি ‘মকরসংক্রান্তি’ নামেও পরিচিত। এ সময় থেকেই সূর্যের দক্ষিণায়ন (কর্কট থেকে ধনু পর্যন্ত) শেষে হয়ে শুরু হয় উত্তরায়ণ (মকর থেকে মিথুন পর্যন্ত)। মকরসংক্রান্তি মূলত একটি প্রাচীন ভারতীয় সৌর উৎসব। এখনো ভারতের বহু রাজ্যে বিভিন্ন নামে এই উৎসব উদ্‌যাপিত হয়। বৈদিক বিধানে এই সময় আধ্যাত্মিক সাধনার জন্য পুণ্যময়। মকরসংক্রান্তিতে সূর্য, বিষ্ণু ও ধনদেবী লক্ষ্মীর বিশেষ পূজা-অর্চনা হয়। আর পাপমুক্তির জন্য পুণ্যস্নানেরও রীতি রয়েছে এই তিথিতে। গঙ্গা, যমুনা, গোদাবরী, কৃষ্ণা ও কাবেরী এই পঞ্চনদীর পুণ্যস্রোতে স্নানে সর্ব পাপ নাশ হয় বলে ধর্মীয় বিশ্বাস। এ ছাড়া মকরসংক্রান্তিতে বিভিন্ন অঞ্চলে গ্রামীণ মেলা ও বাড়িতে পিঠাপুলির আয়োজন করা হয়।

ঢাকায় পৌষসংক্রান্তিতে ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসবের সঙ্গে অবশ্য কোনো ধর্মীয় আচারের সংশ্লিষ্টতা নেই। অনেক কাল আগে থেকে এই উৎসব চলে আসছে। হতে পারে সেটি নবাবি জমানা অথবা তারও আগে মোগল আমল। ঢাকাবিশারদ ঐতিহাসিক মুনতাসীর মামুন প্রথম আলোকে বললেন, ‘সাকরাইন উৎসব কবে থেকে শুরু, নিশ্চিত করে তেমন তথ্য পাওয়া যায় না। আমার ধারণা, ২০০ থেকে ২৫০ বছর হতে পারে। এই উৎসব ঢাকার নতুন অংশে হয় না। সে কারণে ঢাকার স্বতঃস্ফূর্ত উৎসব বলা যায় না। তবে ঐতিহ্যের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে থাকায় উৎসবটি চালু থাকা প্রয়োজন।’ তবে তিনি মনে করেন, যুগ ও জনরুচির পরিবর্তনের কথা বলে এই নির্মল বিনোদনের উৎসবটিতে ধুমধাড়াক্কা ধরনের কোনো কিছু সংযোজন করা অনুচিত হবে।

বাংলা একাডেমি বাংলা দিনপঞ্জিকা সংস্কার করায় বেশ কয়েক বছর থেকেই ঢাকায় সাকরাইনের আয়োজন হচ্ছে দুই দিন। জানুয়ারির ১৪ ও ১৫ তারিখে। প্রথম দিনের উৎসব হয় প্রধানত সূত্রাপুর, কলতাবাজার, গেন্ডারিয়া, ধোলাইখাল, লক্ষ্মীবাজার, ফরিদাবাদ, লালবাগ এসব এলাকায়। আর লোকনাথ পঞ্জিকা অনুসারে দ্বিতীয় দিনে সংক্রান্তির উৎসব হয় শাঁখারী বাজার, তাঁতীবাজার, গোয়ালনগর, রাজার দেউড়ি এই মহল্লাগুলোতে।

সাকরাইন উপলক্ষে পুরান ঢাকার শাঁখারী বাজার, তাঁতীবাজার, লক্ষ্মীবাজার এলাকায় ঘুড়ি, লাটাই, সুতা বিক্রির ধুম পড়েছিল সপ্তাহখানেক ধরে। হরেক রকমের ঘুড়ি, বিচিত্র তাদের নাম আর রঙের বাহার। কোনোটির নাম চোকদার, কোনোটির মাসদার, আরও আছে পানদার, গয়েল, চারদুয়ার, লম্বালেজা প্রভৃতি। সুতারও আছে—রক, ড্রাগন, ডাবল ড্রাগন, টাইগার, মাঞ্জা থেকে সম্রাট অবধি হরেক ধরনের।

ঐতিহ্যবাহী সাকরাইন উৎসবে এটাই পুরান ঢাকার চিরচেনা রূপ

শাঁখারী বাজারের শঙ্খশ্রী দোকানের মালিক পাপন দত্ত, জয়গুরু ভান্ডারের অমলেশ নন্দীসহ বেশ কিছু ঘুড়ির দোকানি জানালেন, এবার ঘুড়ির সুতার দাম একটু বেশি। গতবার সর্বনিম্ন দাম ছিল ৫ টাকা। এবার দাম ১০ টাকা। এক কাউন্ট (৯০০ মিটার) সুতার সর্বনিম্ন দাম ছিল ২০০ টাকা, এবার তা ৩০০ টাকা। ছোট লাটাইয়ের দাম এবার ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা, গত বছর যা ১০০ টাকাতেই পাওয়া গেছে। দাম বাড়লেও বেচাকেনা কমেনি। উৎসব আছে আগের মতোই রঙিন।

পুরান ঢাকায় কাইট কিং, এক্সটিসি, গোল্ডেন কাইটার এমন নামে মহল্লাভিত্তিক ঘুড়ি ওড়ানোর বেশ কিছু সংগঠনও আছে, যারা মহল্লার ছাদে ছাদে উৎসবের আয়োজন করে থাকে। লক্ষ্মীবাজার এলাকার এমনি একটি সংগঠন ‘মাঞ্জা’র সাধারণ সম্পাদক আরমান হোসেন জানালেন, এ বছর থেকে সাকরাইন উৎসবের আয়োজনে বেশ কিছু আইন চালু করা হয়েছে। সাধারণত সারা দিন ছাদে ঘুড়ি ওড়ানো আর কাটাকাটি খেলার পর রাতে গান-বাজনা, পিঠাপুলির আয়োজন করা হয়। সম্প্রতি রাতের এই আয়োজনে আতশবাজি ও উচ্চশব্দে ডিজে পার্টির আয়োজন করা হচ্ছে। অনেকে ফেসবুকের মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবেও এসব অনুষ্ঠান করছে। অনেক ক্ষেত্রে উচ্ছৃঙ্খলতার অপ্রিয় ঘটনা ঘটে।

আরমান হোসেন জানালেন, এসব কারণে এবার ডিপিডিসি থেকে বিদ্যুৎ বিভাগের অনুমোদন, দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অনুমোদন ও পুলিশের অনুমোদন নেওয়ার কথা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁরা লিখিত আবেদন করেছেন। লক্ষ্মীবাজার এলাকায় তাঁরা ১৮টি কেন্দ্রে সাকরাইন উৎসবের আয়োজন করছেন। এতে বহিরাগতদের প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না।

ঘুড়ি ওড়ানোর এই উৎসবে রয়েছে প্রতিবেশীদের আমন্ত্রণ জানানোর রীতি। তাতে নিবিড় হয় সামাজিক সম্প্রীতির বন্ধন। উচ্ছৃঙ্খলতা নয়, সম্প্রীতিটাই জরুরি।