Thank you for trying Sticky AMP!!

অ্যাসিডে চোখ হারানো জেসমিনই এখন ঘুরে দাঁড়ানোর প্রেরণা

কেউ অ্যাসিডদগ্ধ হয়েছেন খবর পেলে ছুটে যান জেসমিন আক্তার

একসময় ভেবেছিলেন জীবন এখানেই থেমে গেছে। অ্যাসিডে পোড়া চোখ ব্যথায় টনটন করত। এর চেয়েও বেশি কাবু হয়ে পড়তেন মনের ব্যথায়। কালো চশমা পরে, ওড়নায় মুখ ঢেকে নিজেকে আড়ালে রাখার চেষ্টা করতেন। যেন অদৃশ্য হতে পারলেই বাঁচেন। আর সেই জেসমিন আক্তার এখন অ্যাসিডদগ্ধ অন্য মেয়ের কাঁধে হাত রেখে বলছেন, ‘জীবন থামিয়ে দেওয়া যাবে না।’

নিজের বলিষ্ঠ এই কণ্ঠ তৈরিতে অনেক বছর লেগেছে ৩৬-এ পা দেওয়া জেসমিনের। এ বছর তিনি সরকারি পুরস্কার ‘জয়িতা’য় ভূষিত হয়েছেন। ‘নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করেছেন যে নারী’—বিভাগে জয়িতা নির্বাচিত হন তিনি। প্রথম আলোকে জানালেন ২২ বছর ধরে চলা তাঁর লড়াইয়ের কথা।

অ্যাসিডে চোখ হারিয়ে দুঃসহ জীবন

জেসমিনের জন্ম বরিশাল শহরের হাটখোলা এলাকায়। আবদুল করিম খান ও ফাতেমা বেগম দম্পতির চার সন্তানের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। ভাইয়ের সঙ্গে এক ব্যক্তির বিরোধের জেরে তিনি ২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে অ্যাসিডদগ্ধ হন। তখন তাঁর বয়স ১৫ বছর। পরের বছরই মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল।

জেসমিন বলেন, বড় ভাই জসিম খান স্থানীয় মনসুর হাওলাদার নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে একটি মোটরসাইকেল কিনেছিলেন। কেনার পর মোটরসাইকেলটি চোরাই জানতে পেরে টাকা ফেরত চান। মনসুরের কাছ থেকে টাকা আনতে তাঁদের দোকানের কর্মচারী সোহেলকে পাঠানো হতো। কিন্তু সোহেল মনসুরের সঙ্গে যোগসাজশ করে মধ্যরাতে ঘুমন্ত অবস্থায় তাঁর (জেসমিন) ওপর অ্যাসিড ছুড়ে মারেন।

শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির হাত থেকে ‘জয়িতা’ পুরস্কার নিচ্ছেন জেসমিন আক্তার

অ্যাসিডে জেসমিন বাঁ চোখের দৃষ্টি হারান। মুখ, শরীর ও গলার বেশ কিছু অংশ পুড়ে যায়। বরিশালের শের-ই–বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাঁকে এক দিন পর ঢাকায় অ্যাসিড সারভাইভার্স ফাউন্ডেশনে (এএসএফ) স্থানান্তর করা হয়।

জেসমিনের অ্যাসিডদগ্ধ হওয়ার ঘটনায় ওই সময় বিভিন্ন সামাজিক ও নারী অধিকারবিষয়ক সংগঠন, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা লাগাতার বিক্ষোভ, মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করেন।

দীর্ঘ দুই বছর জেসমিনের চিকিৎসা চলে। তলপেট ও ঊরুর চামড়া কেটে মুখমণ্ডলে প্লাস্টিক সার্জারি করা হয়। তবে বাঁ চোখের দৃষ্টি আর ফেরানো সম্ভব হয়নি। এক বছরে ৬-৭টি অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে তাঁর দেহে।

এমন দুর্বিষহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়া জেসমিনের অভিযোগ, মামলায় প্রধান অভিযুক্তদের (ছয় আসামির চারজন) যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলেও উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে তাঁরা অল্প সাজা খেটে বেরিয়ে যান। সোহেল মামলার ১ নম্বর আসামি ছিলেন এবং তাঁর যাবজ্জীবন সাজা হয়। মামলায় তাঁর নাম প্যাদা মন্টু।

ঘুরে দাঁড়ানোর প্রেরণা ছড়িয়ে দেওয়াই ব্রত

অ্যাসিডে দগ্ধ জেসমিন থেমে যাননি। তিনি ২০০৩ সালে মাধ্যমিক এবং ২০০৫ সালে উচ্চমাধ্যমিক (এইচএসসি) পাস করেন। ২০০৬ সালে বিয়ে করেন। এরপরও পড়াশোনা চালিয়ে যান। বরিশাল কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক (অনার্স) ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।

২০০৭ সালে প্রথম আলো দুটি সেলাই মেশিন ও একটি এমব্রয়ডারি মেশিন দিয়ে সহযোগিতায় এগিয়ে আসে। সেই মেশিনে তাঁর বাসায় তাঁকেসহ ২৫-৩০ জন নারীকে বিনা মূল্যে সেলাই প্রশিক্ষণ দেন একজন প্রশিক্ষক। ওই বছরই তিনি গ্রামীণফোন ও প্রথম আলোর আয়োজনে ‘বিশাল বাংলার নেপথ্য নায়কেরা’ সম্মাননায় ভূষিত হন।

পুরস্কার পাওয়ার পর জেসমিন আক্তারকে অভিবাদন জানানো হয় একশনএইড কার্যালয়ে

২০১৭ সাল থেকে দুই বছর অ্যাসিডদগ্ধ নারীদের নিয়ে কার্যক্রম ‘সেতুবন্ধন গড়ি’ নেটওয়ার্কে চাকরি করেন জেসমিন। এখন নেটওয়ার্কের আওতায় স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে ঢাকা, বরিশাল, সাতক্ষীরা, সিরাজগঞ্জ, পটুয়াখালী, দিনাজপুর, পাবনা জেলার সভাপতি হিসেবে রয়েছেন তিনি।

জেসমিন জানান, স্বামী মাহফুজুর রহমানের সঙ্গে নিজের সঞ্চিত অর্থের প্রায় ছয় লাখ টাকা বিনিয়োগ করে হাটখোলায় লঞ্চঘাটের কাছাকাছি বেকারি ও কসমেটিকসের দোকান (মেসার্স লাবিবা মানাফ এন্টারপ্রাইজ) পরিচালনা করছেন। সংসারে হুমায়রা তাবাসসুম (১৪) এবং জারিফ মুনতাসির মানাফ (২) নামে দুই ছেলেমেয়ে রয়েছে।

জেসমিন বলেন, ‘ছোট সন্তানের জন্মের পর কাজের জায়গা সংকুচিত করতে হয়েছে। এরপরও কোথাও কেউ অ্যাসিডদগ্ধ হয়েছেন খবর পেলে ছুটে যাই। তাঁদের বলি, ‘মানুষের জীবনে অনেক ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় নিজেকে ঘরে আবদ্ধ করে ফেললে নিজেরই ক্ষতি। জীবন থামিয়ে দেওয়া যাবে না।’

এক কম বয়সী মেয়ের অ্যাসিডদগ্ধ হওয়ার ঘটনার কথা উল্লেখ করে জেসমিন বলেন, ‘আমি সেখানে যাওয়ার পর মেয়েটি আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়নি শুরুতে। পরে মেয়েটিকে বললাম, আমার দিকে তাকিয়ে দেখো, আমিও তোমার মতো।’

জেসমিন বলেন, তিনি এএসএফে বিনা মূল্যে চিকিৎসা পেয়েছিলেন। বছরের পর বছর কাউন্সেলিং পেয়েছেন ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য। একশনএইড, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, নারীপক্ষ, প্রথম আলোসহ অনেকে নিয়মিত বাড়িতে এসে খোঁজ নিয়েছে। এখন অ্যাসিডদগ্ধ হওয়ার ঘটনা কমলেও থেমে যায়নি। তবে সেভাবে সহযোগিতার হাত নিয়ে দাঁড়ায় না কেউ।

তিনি বলেন, ‘যাঁরা দগ্ধ হচ্ছেন, তাঁদের এই ব্যয়বহুল চিকিৎসা নিজেদের চালাতে হয়। দেখে খুব কষ্ট হয় আমার। নিজেকে দিয়ে বুঝি, একজন অ্যাসিডদগ্ধ মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য পাশে কারও থাকা কতটা জরুরি।’

‘জয়িতা’ জেসমিন

নিজের ঘুরে দাঁড়ানো ও আর সেই প্রেরণা ছড়িয়ে দেওয়ার স্বীকৃতি পাচ্ছেন জেসমিন। ‘জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ’ শীর্ষক কর্মসূচির আওতায় মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর এ বছর পাঁচটি শ্রেণি বিভাগে আটটি বিভাগের নির্বাচিত ৪০ জন জয়িতার মধ্য থেকে ৫ জনকে শ্রেষ্ঠ নির্বাচিত করে। শ্রেষ্ঠ জয়িতাদের একজন হিসেবে ৮ মার্চ জেসমিনের হাতে তুলে দেওয়া হয় পদক, সনদ, এক লাখ টাকা।

জেসমিন বলেন, ‘পুরস্কার পাব ভাবতেই পারিনি। আমার জীবনে এত আনন্দদায়ক ঘটনা ঘটবে আশা করিনি।’ এ পুরস্কার অ্যাসিডদগ্ধ নারীদের জন্য আরও কাজ করতে তাঁকে অনুপ্রেরণা জোগাবে বলে তিনি জানান।

‘জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ’ কর্মসূচির দায়িত্বে থাকা মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের উপপরিচালক (ম্যাজিস্ট্রেট, মহিলা সহায়তা কর্মসূচি ইত্যাদি) ফরিদা খানম প্রথম আলোকে বলেন, লড়াকু মনোভাবের নারী, যাঁরা যেকোনো প্রতিকূলতা ঠেলে সামনে এগিয়ে চলেন এবং জীবনযুদ্ধে জয়ী হন, তাঁদের ‘জয়িতা’ পুরস্কার দেওয়া হয়। জেসমিন আক্তার তেমনই একজন নারী হিসেবে এ পুরস্কার পেয়েছেন।