Thank you for trying Sticky AMP!!

রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার সুরক্ষার দায়িত্ব বাংলাদেশের ওপর চাপানো চলবে না

এম এ মান্নান, তৌহিদ হোসেন, মোহাম্মদ মিজানুর রহমান, শামীম হায়দার পটোয়ারী, সু জেন হ্রি ও এমা ব্রিগহাম

মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের ঢলের পাঁচ বছর পার হয়ে গেলেও প্রত্যাবাসনের কোনো অগ্রগতি নেই। মিয়ানমারের এসব লোকজনের মানবিক সহায়তায় আন্তর্জাতিক তহবিলও কমছে। এমন এক প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তাসহ সব ধরনের মানবাধিকার রক্ষার দায়িত্ব বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দেওয়া চলবে না। এর পাশাপাশি প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখতে হবে। কারণ, চাপ ছাড়া এ সমস্যার সমাধান হবে না।

‘আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার ও বাংলাদেশের বাস্তবতা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা এসব কথা বলেন। গতকাল বুধবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে নিজেদের কার্যালয়ে বৈঠকটির আয়োজন করে প্রথম আলো। এতে সহযোগিতা করেছে আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা অক্সফাম।

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রী প্রশংসা পাচ্ছেন। আমরাও পাচ্ছি। সংকটে থাকলেও আমরা তাদের বিষয়ে আমাদের দায়িত্ব পালন করছি। প্রত্যাবাসন না হলেও তাদের স্থানীয়ভাবে অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি বিয়েশাদির মাধ্যমে ঘটছে। রোহিঙ্গারা ভয়ে মিয়ানমারে ফিরে যাবে না। এ নিয়ে আমরা খুব একটা সমস্যায় আছি। আমরা সমব্যথী হয়ে তাদের পাশে থাকব। সমস্যাটি চোখের সামনে থাকলে সামনে এগিয়ে যেতে পারব।’

সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যাটি মিয়ানমারের তৈরি। কাজেই সমাধানটাও মিয়ানমারের কাছ থেকেই আসতে হবে। মিয়ানমারের এ সমস্যা সমাধানের কোনো ইচ্ছাই নেই। তারা একভাবে তাদের সমস্যার সমাধান করে ফেলেছে। সবাইকে প্রায় বের করে দিয়েছে। যত দিন পর্যন্ত তাদের বাধ্য করা না হয়, তারা এদের ফেরত নেবে না। বাংলাদেশ তাদের বাধ্য করতে পারে না। যাদের শক্তি আছে, তাদের ইচ্ছা নেই। বা তাদের কোনো উদ্যোগ নেই।

মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, অধিকার অন্য কেউ কাউকে দেয়নি। আপনার অধিকার আপনাকে সংগ্রাম করে আদায় করতে হবে। এই ইস্যুতে রোহিঙ্গারা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। কোনো ধরনের কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। মিয়ানমারে অসংখ্য বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন আছে। সেখানেও তারা কিছু করতে পারেনি।আত্মহত্যার চিন্তার আগে তাদের ঠিক করা উচিত আমার ওপরে যারা এই সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়েছে, আমরা তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করব। এটা তারা করেনি।

তৌহিদ হোসেন বলেন, অন্তর্ভুক্তিকরণ বিপুল সংখ্যায় হবে না। শান্তিপূর্ণভাবে হবে না। বাংলাদেশকে এ জন্য তৈরি থাকতে হবে।

আইন মন্ত্রণালয়–সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী এমপি বলেন, ‘আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে, একটা বড় মাপের যুদ্ধ ছাড়া আমরা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন করতে পারব না। সেই যুদ্ধটা কি আমরা করতে পারব। সেই শক্তি কি আমাদের আছে। পারলে তো আমরা তাদের ঠেকিয়ে দিতাম। অনেকে অনুরোধে ঢেঁকি গেলে। আর আমরা মানবতার কারণে রাইস মিল গিলেছে। এই বাস্তবতা মেনে নিয়েই আমাদের কৌশল ঠিক করতে হবে। আমরা অবশ্যই তহবিলের জন্য অনুরোধ জানাব। তহবিল কমে গেলে কী করব? আমরা কি জোর করে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে পারব?’

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারপারসন অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, ‘তিনটি উপায় আছে সমস্যা সমাধানের। স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসন, তৃতীয় দেশে তাদের অন্তর্ভুক্তিকরণ এবং বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিকরণ। অদূর ভবিষ্যতে আমরা স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসনের কোনো সম্ভাবনা দেখি না। তৃতীয় দেশে রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্তিকরণের যে বিকল্প, তাতে ৭২ জনকে নিয়ে বড় করে দেখানো হচ্ছে। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের সঙ্গে অন্তর্ভুক্তিকরণের প্রক্রিয়া এখনই শুরু হয়ে গেছে। আমরা কি এটা বন্ধ করে দিতে পারি? তাহলে তা হবে মানবাধিকার হরণ।’

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার সুরক্ষার কথা বলে বাংলাদেশের ঘাড়ে সবকিছু চাপানোর একটা চেষ্টা আমরা দেখি। মিয়ানমারে যেখানে তাদের ডিহিউম্যানাইজ করা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় মদদে গণহত্যা হয়েছে, তখন তো তাদের কাছে ভালো কিছু আশা করি না। রোহিঙ্গাদের জন্য যৌথ সাড়াদান পরিকল্পনা বা জেআরপিতে এ বছর এসেছে মাত্র ৪৮ শতাংশ। জেআরপির তহবিল পেলে তাদের খাবারের বিষয়টি নিশ্চিত হবে। এটা কিন্তু মানবাধিকার।’

মিজানুর রহমান বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্তিকরণ বিষয়টি চলছে। বিয়ে হচ্ছে। শিবিরের বাইরে তারা যাচ্ছে। আমরা তো মিয়ানমার নই যে তাদের গলায় দড়ি দিয়ে আটকে রাখব। আমরা অন্তর্ভুক্তিকরণ চাই না। এমনকি তৃতীয় দেশে পাঠানোও কোনো সমাধান নয়। আমাদের একমাত্র লক্ষ্য প্রত্যাবাসন।’

একশনএইড বাংলাদেশের এদেশীয় পরিচালক ফারাহ কবির বলেন, গাম্বিয়া আইসিজেতে গণহত্যার মামলা করেছে। বাংলাদেশ সাধ্যমতো সহায়তা করেছে। প্রথমবারের মতো আইসিসিতে রোহিঙ্গাদের বিষয়টি গেছে। রাতারাতি এ সমস্যার কোনো সমাধান হবে না। প্রত্যাবাসন, তৃতীয় দেশে যাবে কি না, এটা কি রোহিঙ্গাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে। প্রবাসী রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, ইউরোপ, জাপান, মধ্যপ্রাচ্য কিংবা আসিয়ানের দেশ কোথাও তাদের স্বাগত জানানো হয় না।

ফারাহ কবিরের মতে, যখনই হোক না কেন, রোহিঙ্গাদের লড়াইটা নিজেদেরই করতে হবে। বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সব পক্ষকে সবাইকে চাপ দিয়ে যেতে হবে।

ইউনিসেফের ভারপ্রাপ্ত প্রতিনিধি এমা ব্রিগহাম বলেন, ‘বাংলাদেশ অভূতপূর্ব ভূমিকা পালন করেছে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে। ভয়াবহ এক চ্যালেঞ্জিং প্রেক্ষাপটে যে কাজ করতে হচ্ছে, সেটা সম্প্রতি কক্সবাজার সফর করে বুঝেছি। পাঁচ লাখ শিশু স্কুলে যেতে চায়, কিন্তু এখানে চ্যালেঞ্জ আছে। তবে মিয়ানমারের পাঠ্যক্রমে রোহিঙ্গা শিশুদের পড়াশোনার যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তাতে আমরা বাংলাদেশের সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞ।’

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার উপপ্রতিনিধি সু জেন হ্রি বলেন, ‘আমাদের এই সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে মিয়ানমারে। প্রত্যাবাসনটা নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও স্বেচ্ছামূলক হতে হবে। কিন্তু বর্তমানে যে পরিস্থিতি সেখানে রয়েছে, তাতে সংকট তৈরি হয়েছে।’

প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের এদেশীয় পরিচালক কবিতা বোস বলেন, ‘কক্সবাজারের শিবিরের পরিস্থিতি বেলুনের মতো। শিবিরের পাশে একজন রোহিঙ্গা নারীর প্রজননক্ষমতা ৩ দশমিক ৯ এর বিপরীতে ৬ দশমিক ৩। এভাবে চলতে থাকলে রোহিঙ্গার সংখ্যা দ্রুত দ্বিগুণ হয়ে যাবে। তার মানে কি বেলুন ফেটে যাবে। তাহলে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে কোনোভাবেই শান্ত রাখতে পারব না। ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হলে বিভিন্ন সংগঠন অর্থায়নের জন্য ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিপুল মিলিয়ন ডলার উঠিয়েছে। আমরা এক মিলিয়ন ডলার ওঠাতে পারিনি।’

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য তানিয়া হক বলেন, ‘রোহিঙ্গারা সংকটের এবং বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট থেকে দেখলে সেই সময়টায় এত বড় একটা নতুন চ্যালেঞ্জ শুধু একা সরকারের পক্ষে কখনো সম্ভব নয়। আস্থার জায়গা পাচ্ছে না। দীর্ঘমেয়াদি টেকসই সমাধানের জন্য দৃশ্যমান চাপ সৃষ্টি প্রয়োজন। পুরো বিষয়টি রাজনৈতিক বলে সিদ্ধান্তটি রাজনৈতিক হলেও বাস্তবায়ন মানবিক। নিরাপদ প্রত্যাবাসন ছাড়া কোনো বিকল্প দেখি না।’

অক্সফাম বাংলাদেশের এদেশীয় পরিচালক আশীষ ডাম্বলে গোলটেবিল বৈঠকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।

অক্সফাম বাংলাদেশের উপদেষ্টা টনি মাইকেল গোমেজ বলেন, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি বড় উদাহরণ। রোহিঙ্গার সংখ্যা এখন সাড়ে ৭ বা ৮ লাখ থেকে তা ১২ থেকে ১৩ লাখ। অর্থাৎ, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে দুটো ভুটানকে আমরা টেনে নিয়ে চলেছি।

গোলটেবিল বৈঠকে আলোচনার সূত্রপাত করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। আলোচনা সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।