Thank you for trying Sticky AMP!!

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর চালানো গণহত্যা

গণহত্যার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকেও ক্ষমা চাইতে হবে

একাত্তরে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন কেবল গণহত্যার প্রতি নীরব সমর্থনই জানায়নি, যে অস্ত্র দিয়ে বাঙালি নিধন হয়েছিল, তার অধিকাংশ এসেছিল এই দুই দেশ থেকে।

ডিসেম্বর মাস এলেই আমরা ক্যালেন্ডারের তারিখ মিলিয়ে একাত্তরের গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়ার দাবি তুলি। সারা বছর এ নিয়ে কোনো কথা নেই, কোনো মহলে কোনো জোরদার দাবি নেই। এটা যেন একটা ‘রুটিন ফর্মালিটি’। তা হলেও এই দাবি মোটেই অপ্রাসঙ্গিক নয়। একাত্তরের সেই খাণ্ডবদাহন যাতে ভুলে না যাই, সে জন্য সারা বছরের মধ্যে অন্তত এই একবার পাকিস্তান ও তার দোসরদের কাঠগড়ায় তোলার দাবি তোলার প্রয়োজনীয়তা আছে। আমাদের স্মৃতি বড় দুর্বল, অযত্নে সেখানে সহজেই ধুলা জমে। বছরে একবার হলেও সাফসুতরো করার এই আয়োজন গুরুত্বপূর্ণ।

ইয়াহিয়া খান

কিন্তু শুধু পাকিস্তান নয়, একাত্তরের গণহত্যায় হাত মেলানোর জন্য ইয়াহিয়া খানের দুই দোসর, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের কাছেও ক্ষমার দাবি তোলা উচিত। একাত্তরে তারা কেবল সে গণহত্যার প্রতি নীরব সমর্থনই জানায়নি, যে অস্ত্র দিয়ে বাঙালি নিধন হয়েছিল, তার অধিকাংশ এসেছিল এই দুই দেশ থেকে। ৫০ বছর পেরিয়ে গেছে, কিন্তু একবারের জন্যও বাংলাদেশের তরফ থেকে তাদের কাছে ক্ষমার দাবি তোলা হয়নি।

যুক্তরাষ্ট্র ছিল পাকিস্তানের পাশে

গত বছর বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ৫০ বছর উদ্‌যাপিত হয়েছে। এই উদ্‌যাপনের ডামাডোলে আমরা ভুলে গেছি যে আমাদের দুই দেশের সম্পর্কের বয়স ৫০ নয়, ৫১। বস্তুত এই দুই দেশের সম্পর্কের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বছর ১৯৭১ সালকে এই সম্পর্কের ইতিহাসে হিসাবের মধ্যে ধরাই হয় না। আমরা কী করে ভুলে যাই, মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় যুক্তরাষ্ট্র ঢাল হয়ে পাকিস্তানের পাশে দাঁড়িয়েছিল। মার্কিন কংগ্রেসের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও সে দেশ থেকে অস্ত্র এসেছে, অর্থ এসেছে। কংগ্রেসের নজরদারি এড়াতে প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও তাঁর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার ইরান ও জর্ডানের মাধ্যমে বোমারু বিমান পাঠানোর আয়োজন করেছিলেন। নিক্সন বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঠেকাতে পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকি দিতেও দ্বিধা করেননি। সপ্তম নৌবহর পাঠিয়ে আমাদের চূড়ান্ত শিক্ষা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন তিনি।

হেনরি কিসিঞ্জার

পর্দার অন্তরালে নিক্সন-কিসিঞ্জারের গোপন ষড়যন্ত্রের কথা এখন সবিস্তার প্রকাশিত হয়েছে। মার্কিন গবেষকদের হাতে তাঁরা দুজনেই নিন্দিত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গ্যারি ব্যাস। তাঁর ব্লাড টেলিগ্রাম সেই ষড়যন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণিক গ্রন্থ। অধ্যাপক গ্যারি ব্যাস নথিপত্র থেকে উদ্ধৃতি দিয়েই বলেছেন, নিক্সন-কিসিঞ্জার উভয়েই জানতেন, বাংলাদেশে ভয়াবহ গণহত্যা চলছে। লাখ লাখ মানুষ হতাহত হয়েছে, সিআইএ এবং স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে তাঁদের সে কথা জানানো হয়েছিল। ঢাকায় যা হচ্ছে, তা গণহত্যা ভিন্ন অন্য কিছু নয়, এ কথা মার্কিন কূটনীতিকেরাই তাঁদের জানিয়েছিলেন। তাঁরা মুখ বুজে ছিলেন। শুধু তা–ই নয়, কিসিঞ্জার এ নিয়ে টুঁ–শব্দটি না করতে সরকারি কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন, প্রেসিডেন্ট নিক্সন এই মুহূর্তে এমন কিছুই করতে চান না, যাতে ইয়াহিয়া খান চটে যান।

২০১৩ সালে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ব্লাড টেলিগ্রাম গ্রন্থের লেখক ব্যাস লিখেছিলেন, ‘একাত্তরের গণহত্যা ছিল নিক্সন-কিসিঞ্জারের অপরাধ, কিন্তু সে অপরাধের কথা আমরা ভুলে গেছি’।

আরেক দোসর চীন

একাত্তরে পাকিস্তানের অন্য দোসর ছিল চীন। এই সেই চীন, যে নিজেকে তৃতীয় বিশ্বের বন্ধু হিসেবে প্রমাণে ব্যস্ত। ঢাকায় গণহত্যা শুরুর পর মস্কো ও ওয়াশিংটন থেকে প্রতিক্রিয়া জানানো হলেও চীন তাৎক্ষণিক কোনো বক্তব্য দেয়নি। বস্তুত মুক্তিযুদ্ধের কোনো পর্যায়েই চীন বাংলাদেশে পাকিস্তানি গণহত্যার নিন্দা করেনি।

পুরোনো বন্ধুত্বের দাবিতে ইয়াহিয়া আশা করেছিলেন তিনি চীনকে নিজের পাশে পাবেন। প্রয়োজনে ভারত সীমান্ত বরাবর অস্ত্র ও সৈন্য দিয়ে চীনা সরকার তাঁকে মদদ জোগাবে। ভারতকে কড়া ভাষায় নিন্দা করলেও চীন দুই দেশের সীমান্ত বরাবর কোনো সৈন্য পাঠায়নি, মূল কারণ তার ভয় ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের তরফ থেকে পাল্টা আঘাত আসতে পারে। সৈন্য পাঠানো ছাড়া নিজের গা বাঁচিয়ে আর যা যা সম্ভব, সবই চীন করেছে। ১৯৭১-৭২ সালে চীন পাকিস্তানকে ‘উপহার’ হিসেবে যেসব ভারী অস্ত্রশস্ত্র পাঠায়, তার মধ্যে ছিল ২৫৫টি ট্যাংক, এক স্কোয়াড্রন ইল-২৮ বিমান ও ২০০ সামরিক প্রশিক্ষক। ১৯৭২ সালে বিভক্ত পাকিস্তানের দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথমবারের মতো চীন বেড়াতে এসে ভুট্টো একাত্তরে তাঁর দেশকে সর্বাত্মক সাহায্য দেওয়ার জন্য চীনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলেন।

চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই

চীনা নেতারা বাংলাদেশে গণহত্যা বিষয়ে কোনো উদ্বেগ প্রকাশ না করলেও মাওপন্থীদের ব্যাপারে খোঁজখবর ঠিকই রাখতেন। ১৯৭১ সালের নভেম্বরে অস্ত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে পিকিং আসেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। ইয়াহিয়ার বাঙালি উপদেষ্টা জি ডব্লিউ চৌধুরী সেই সাক্ষাতের কথা স্মরণ করে লিখেছেন, চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ-এন লাই ভুট্টোর কাছে অভিযোগ করেছিলেন, পাকিস্তানি সেনা হামলায় ৬৪ জন পিকিংপন্থী রাজনীতিবিদ-কর্মী নিহত হয়েছেন। একই সফরের সময় চৌ-এন লাইয়ের উপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী চি পেং ফি পাকিস্তানি অতিথিদের এই বলে আশ্বস্ত করেন যে পূর্ব পাকিস্তানে যারা সামরিক তৎপরতায় লিপ্ত, তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী ছাড়া আর কেউ নয়।

পরবর্তী সময়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশ প্রশ্নে বিতর্কে চীন ঠিক এই যুক্তিই অনুসরণ করে। চীনা রাষ্ট্রদূত হুয়াং হুয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে ১৯৩১ সালে অধিকৃত চীনের মানচুকো প্রদেশে জাপান স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। জাতিসংঘে বাংলাদেশ প্রশ্নে বিতর্কের সময় বাংলাদেশের পক্ষে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বক্তব্য পেশের অনুরোধ জানিয়েছিলেন। পিকিং ও ওয়াশিংটন সে অনুরোধে আপত্তি জানিয়েছিল।

বাংলাদেশ প্রশ্নে চীনের এই অনমনীয় অবস্থান স্বাধীনতার পরও অব্যাহত থাকে। শুধু যে দেশটির আপত্তির কারণে বাংলাদেশ ১৯৭৪ সালের আগপর্যন্ত বিশ্ব সংস্থার সদস্যপদ লাভে ব্যর্থ হয়, সে হলো চীন। জাতিসংঘে সদস্যপদ প্রাপ্তির পদ চীন তার প্রথম ভেটো প্রয়োগ করে ২৫ আগস্ট ১৯৭২, আর সেটি ছিল বাংলাদেশের সদস্যপদের প্রস্তাব।

বিলম্বিত হলেও ক্ষমা চাইতে হবে

ইতিমধ্যে ৫১ বছর কেটে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র বা চীন কেউই আমাদের কাছে একাত্তরের গণহত্যায় তাদের ভূমিকার জন্য ক্ষমা চায়নি, এমনকি আনুষ্ঠানিক দুঃখ প্রকাশ পর্যন্ত করেনি। সময়ের ব্যবধান এই অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনায় কোনো অন্তরায় হতে পারে না। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিলম্বিত ক্ষমা প্রার্থনা কোনো অভূতপূর্ব ঘটনাও নয়।

যুক্তরাষ্ট্র বহুবার নিজ কৃতকর্মের অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছে। এমনকি ১০০ বছর আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্যও। ১৮৯৩ সালে মার্কিন নৌসেনাদের অংশগ্রহণে হাওয়াইয়ের স্বাধীন শাসককে উৎখাত করা হয়। ঠিক ১০০ বছর পর, ১৯৯৩ সালে মার্কিন কংগ্রেস ও সিনেট এক যৌথ প্রস্তাবে সেই সামরিক হস্তক্ষেপের জন্য হাওয়াইয়ের জনগণের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র চর সন্দেহে এ দেশের সোয়া লাখ জাপানি বংশোদ্ভূত আমেরিকানকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পাঠিয়েছিল। ১৯৮৮ সালে প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান সেই গভীর লজ্জাজনক ঘটনার জন্য প্রত্যেক জাপানি-আমেরিকানের কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন, এবং কারাবন্দী ব্যক্তিদের পরিবারপ্রতি ২০ হাজার ডলার ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেছিলেন। গত শতকের তিরিশের দশকে সরকারি ব্যবস্থাপনায় এ দেশের কৃষ্ণকায়দের না জানিয়ে তাদের ওপর সিফিলিস রোগ নিয়ে একটি গোপন গবেষণা চালানো হয়। ১৯৯৭ সালে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন আনুষ্ঠানিকভাবে এই অবৈধ ও অনৈতিক কাজের জন্য ক্ষমা চান।

বিল ক্লিনটন ১৯৯৯ সালে আরও একবার ক্ষমা চেয়েছিলেন। গুয়াতেমালার তিন দশকের বেশি স্থায়ী গৃহযুদ্ধে মার্কিন সরকার সে দেশের সামরিক নেতৃত্বের প্রতি শুধু সমর্থনই দেয়নি, ব্যাপক সামরিক সাহায্যও দিয়েছিল। এই দীর্ঘ গৃহযুদ্ধে গুয়াতেমালার প্রায় দুই লাখ মানুষের মৃত্যু হয়, যা সর্বার্থেই ছিল গণহত্যা বা জেনোসাইড। সেই গণহত্যায় মার্কিন ভূমিকার জন্য ক্লিনটন গুয়াতেমালায় এসে প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছিলেন। সে সময় তিনি বলেছিলেন, ‘আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, গুয়াতেমালার সামরিক বাহিনী বা গোয়েন্দা ইউনিটসমূহ যারা এ দেশে দীর্ঘদিন ব্যাপক ও নৃশংস অত্যাচারে লিপ্ত ছিল, তাদের প্রতি মার্কিন সমর্থন ছিল ভুল।’ তিনি বলেছিলেন, ‘ভবিষ্যতে একই রকম ভুল যেন না হয়, আমাদের তা নিশ্চিত করতে হবে।’

১৯৭১ সালে মার্কিন ভূমিকার জন্য সে দেশের কোনো প্রেসিডেন্ট বা রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি কখনোই অনুরূপ ভাষায় ভুল স্বীকার করেননি। বরং উল্টো জাতীয় স্বার্থের দোহাই দিয়ে তার পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। কয়েক বছর আগেও নিক্সনের নিকটতম সহচর হেনরি কিসিঞ্জার বলেছেন, একাত্তরে পাকিস্তানের পক্ষে মার্কিন অবস্থান ভূরাজনৈতিক স্বার্থের বিবেচনায় সঠিক ছিল। ২০১৬ সালে নিউইয়র্কার পত্রিকার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি স্বীকার করেন, বাঙালিদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা দমনে ইয়াহিয়া চূড়ান্ত সহিংসতা প্রদর্শন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করেন। তিনি এ–ও বলেন, ‘কিন্তু (সে সময়) এই সহিংসতার নিন্দা করার অর্থ দাঁড়াত চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের সম্ভাবনার সমাপ্তি।’

সেই সাক্ষাৎকারে কিসিঞ্জার এমন দাবিও করেন, একাত্তরে তাঁদের অনুসৃত নীতির সাফল্যের কারণেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। এমন নির্জলা মিথ্যা কথা একমাত্র কিসিঞ্জারের মতো চালবাজ রাজনীতিকের পক্ষেই সম্ভব। ব্রিটিশ লেখক ক্রিস্টোফার হিচেন্স কোনো রাখঢাক ছাড়াই বলেছিলেন, একাত্তরে গণহত্যা সমর্থনের জন্য একা ইয়াহিয়া ও পাকিস্তানি জেনারেলদের নয়, কিসিঞ্জারেরও বিচার হওয়া উচিত।

এ কথা ঠিক, কোনো কোনো মার্কিন রাজনীতিক, যেমন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি এই গণহত্যায় মার্কিন ভূমিকার নিন্দা করেছেন। গত বছর প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক নিবন্ধে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল মিলার কেনেডির বলা সে কথা স্মরণ করেছিলেন, কিন্তু ক্ষমা প্রার্থনার কোনো ইঙ্গিত দেননি। কিসিঞ্জার-নিক্সনের ভূমিকার নিন্দা করে লম্বা প্রবন্ধ লিখেছেন শ্রীলঙ্কায় যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত ক্রিস্টোফার ভ্যান হলেন। তিনিও ক্ষমা প্রার্থনার প্রয়োজনীয়তা দেখেননি। এ বছরের অক্টোবরে মার্কিন কংগ্রেসে ১৯৭১-এর গণহত্যাকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য একটি খসড়া প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছে। তাতেও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার জন্য কোনো দুঃখ প্রকাশ বা ক্ষমা প্রার্থনা করা হয়নি, বরং পাকিস্তানকে ক্ষমা প্রার্থনার আহ্বান জানানো হয়েছে।

কেন ক্ষমা প্রার্থনার দাবি

গত অর্ধশতকে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের সম্পর্কের অনেক চড়াই-উতরাই গেছে। এই দুই দেশের ক্ষমতাসীন মহলই মনে করে, তাদের সম্পর্ক এখন এমন একপর্যায়ে দাঁড়িয়েছে, যা পরস্পরের জন্য লাভজনক। তারা উভয়েই এই সম্পর্কের উত্তরোত্তর উন্নতি চায়। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লেখা চিঠিতে এমন কথাও বলেছেন, শুধু আগামী ৫০ বছর নয়, তারপরও তাঁদের সুসম্পর্ক অব্যাহত থাকবে।

চীনের সঙ্গেও আমাদের সম্পর্কের পরিবর্তন হয়েছে। এই পরিবর্তনের সূচনা ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর। বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রায় পাঁচ বছর পর, ১০ অক্টোবর ১৯৭৫ দেশটিকে চীন কূটনৈতিকভাবে স্বীকৃতি জানায়। জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে যে নতুন সামরিক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে, চীন তাকে সাগ্রহে স্বাগত জানায়। আরেক সামরিক শাসক, জেনারেল এরশাদের আমলে সে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। এর পরের তিরিশ বছর আমরা এই দুই দেশকে বাণিজ্যিক ও সামরিক ক্ষেত্রে পরস্পরের কাছে অংশীদার হয়ে উঠতে দেখি। বাংলাদেশে এই সময়ে একাধিক নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আরোহণ করলেও কেউই চীনের কাছে ক্ষমার দাবি তোলেনি।

চীন নিজে কিন্তু জাপানি ঔপনিবেশিকদের হাতে সাড়ে চার কোটি চীনা হত্যার জন্য এখনো মাঝেমধ্যে ক্ষমার দাবি তুলে থাকে। যত দিন এই গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিক ক্ষমা ও ক্ষতিপূরণ না আসছে, তত দিন এই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে না, এ কথা চীনা নেতারা নানাভাবে বুঝিয়েছেন।

তাহলে সেই একই কথা আমাদের বেলায় নয় কেন?

যুক্তরাষ্ট্র ও চীন—এই দুই দেশই এখন বাংলাদেশের নিকট–বন্ধু, উন্নয়নের অংশীদার। কিন্তু এ কথা কী করে ভুলে যাই, এই দুই দেশের হাতে একাত্তরের গণহত্যার রক্তচিহ্ন এখনো মুছে যায়নি। সে গণহত্যায় সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ক্ষমা প্রার্থনা না চাওয়া পর্যন্ত আমাদের বুকে ঘৃণার দগদগে যে ঘা রয়েছে, তা কখনোই মিটবে না।