Thank you for trying Sticky AMP!!

বেঁচে থাকুক স্মৃতিচিহ্নটুকু

নার্সারির শেষ স্মৃতিচিহ্ন পামগাছগুলো

ঈশ্বরচন্দ্র গুহ, যাঁকে অনায়াসেই একজন কিংবদন্তিতুল্য বৃক্ষপ্রেমীর অভিধায় অভিষিক্ত করা যায়। প্রায় ১৩০ বছর আগে যিনি জামালপুর শহরের বোসপাড়ায় অভাবনীয় এক উদ্ভিদচর্চায় মেতে উঠেছিলেন। ব্যয় করেছিলেন নিজের উপার্জিত সব অর্থসম্পদ। জীবনসায়াহ্নে যা হয়ে উঠেছিল এক করুণ উপাখ্যানের মতোই।

তাঁর রোপণ করা মাত্র পাঁচটি রয়্যাল পাম এখন জরাজীর্ণ অবস্থায় বেঁচে আছে। ২০০৭ সালে আমার দেখা ছয়টি পাম তখন আরও অনেক সতেজ ছিল। তখনো বেঁচে ছিল ‘লম্বা’ গাছ নামে পরিচিত একমাত্র গর্জনগাছটিও।

এখন আর সে গাছ নেই। এই গাছগুলো মূলত জামালপুর জেলা শহরে ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে ঈশ্বরচন্দ্র গুহ প্রতিষ্ঠিত ‘চৈতন্য নার্সারি ও ফোরটাঙ্কস গার্ডেন’-এর দুর্লভ সংগ্রহের অমূল্য স্মৃতি।

ঈশ্বরচন্দ্র গুহর প্রতিকৃতি।

৪৫ বিঘা পরিসরের এই উদ্যান ও নার্সারি অনেক আগেই বিলুপ্ত হয়েছে। একই সঙ্গে বিস্মৃত হয়েছেন ঈশ্বরচন্দ্র গুহও। কিন্তু মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা এই গাছগুলো তাঁকে এখনো পুরোপুরি মুছে ফেলতে দেয়নি। শহরের কিছু বৃক্ষপ্রেমী মানুষ এখনো স্বপ্ন দেখেন চৈতন্য নার্সারির বেদখল জায়গাগুলো উদ্ধার করে সেখানে ফিরিয়ে আনা হবে গুহর সেই উদ্যান ধারাকে।

কিন্তু খোদ সরকারি সংস্থার দখলে থাকা এই গাছগুলো কীভাবে পরিচর্যার মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখা যাবে, এই উত্তর অবশ্য তাঁদের জানা নেই। তবে স্থানীয় প্রশাসন উদ্যোগী হয়ে কাজটি করতে পারে। সরকারি অফিস অন্যত্র সরিয়ে তাঁর স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে পামগাছগুলো সংরক্ষণ করা যেতে পারে। তাহলে ছোট পরিসরে হলেও তাঁর স্মৃতি ও কর্মের প্রতি সুবিচার করা হবে।

প্রায় দেড় দশক আগে প্রথম আলোর ‘অন্য আলো’য় দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ উদ্যান নিয়ে লিখতে গিয়ে এই অমূল্য উদ্যানের খোঁজ পাই। চৈতন্য নার্সারি এবং ঈশ্বরচন্দ্র গুহ কেন এতটা তাৎপর্যপূর্ণ? কর্মপরিধির দিক থেকে আমাদের উদ্যানধারায় এমন কৃতিত্বপূর্ণ ও বহুধা বিস্তৃত উদ্যানচর্চা দ্বিতীয়টি নেই। গুহ ছিলেন একাধারে উদ্যানশিল্পী, গবেষক, লেখক ও কৃষিবিদ।

তাঁর কর্মপরিধি তখনকার সময় তো বটেই, বর্তমান যুগেও বিস্ময়কর। দেশের উদ্যান ও কৃষিকে সম্মানজনক স্তরে উত্তরণে তিনি অবসর মুহূর্তটুকু ব্যয় করেছিলেন দেশ-বিদেশের ফুল-ফলের চারা উৎপাদনের পরীক্ষা–নিরীক্ষায়। নার্সারি ও উদ্যানকে সমৃদ্ধ করতে মরু অঞ্চল থেকে শুরু করে মেরু অঞ্চলসহ সব মহাদেশের ফুল, ফল, লতাপাতা আলংকারিক বৃক্ষ ও অর্থকরী উদ্ভিদ এবং বীজ নিয়ে আসেন তিনি। এই মহাযজ্ঞে তখন তাঁর বিনিয়োগ দাঁড়ায় দুই লাখ টাকার কাছাকাছি। এখান থেকে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি হতো প্রায় ৪ হাজার ৬৮৮ ধরনের চারা।

চৈতন্য নার্সারির প্রধান আকর্ষণ ছিল মূলত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে নির্মিত বাংলাদেশের প্রথম উদ্যান ফোরটাঙ্কস গার্ডেন। এখানকার যাবতীয় সংগ্রহ বিভিন্ন পর্যায়ে বিভক্ত ছিল। ফলোদ্যান, জলোদ্যান, বিভিন্ন দেশ থেকে সংগৃহীত আলংকারিক বৃক্ষ, গ্রিনহাউসে সংরক্ষিত শীতপ্রধান অঞ্চলের গাছ, ৭০০ প্রজাতির গোলাপ, আঁকাবাঁকা পথ, কৃত্রিম পাহাড়, আমাজান লিলি, অর্থকরী ও ঔষধি উদ্ভিদ ইত্যাদির সমন্বয়ে শৈল্পিক হয়ে ওঠে ফোরটাঙ্কস গার্ডেন।

২০০৭ সালে তোলা রয়্যাল পামের ছবি।

গ্রিনহাউসে ছিল নানান জাতের ফার্ন, অর্কিড, অ্যাজালিয়া ও হিমালয়ী বিচিত্র লতাগুল্ম। বিভিন্ন ধরনের পতঙ্গভুক গাছপালা এ বাগানের বাড়তি আকর্ষণ হয়ে ওঠে। দেশ-বিদেশের দুষ্প্রাপ্য অর্কিডে সমৃদ্ধ ছিল অর্কিড বাগান। নার্সারির ক্যাটালগে ২৮৮ প্রকার অর্কিডের সন্ধান পাওয়া যায়।

সর্বসাধারণের সুবিধার্থে ১৩২২ বঙ্গাব্দে ঢাকার তাঁতীবাজারে চৈতন্য নার্সারির একটি শাখা খোলা হয়। জানা যায়, ঢাকার কার্জন হল এবং বাহাদুর শাহ পার্কের রয়্যাল পামগুলো চৈতন্য নার্সারি থেকে সংগ্রহ করা। চৈতন্য নার্সারি শুধু এখানেই নয়, এর খ্যাতি ও কার্যক্রম ছিল বিশ্বজোড়া। বিদেশ থেকে এখানে যেমন বীজ, চারা ও উদ্যান উপকরণ আসত, তেমনি বিভিন্ন দেশে পাঠানও হতো। নার্সারিতে ব্যবহৃত টেলিগ্রাফিক ঠিকানা BOTANICHEN, JAMALPORE—আন্তর্জাতিক এই যোগাযোগের উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

মাত্র সোয়া শ বছর পর ঈশ্বরচন্দ্র গুহর স্মৃতি রক্ষার্থে ৪৫ বিঘার পরিবর্তে ৪৫ ফিট জায়গাও এখন আর বরাদ্দ নেই। অথচ একসময় কত জমজমাট ছিল তাঁর উদ্যান আঙিনা। তাঁর প্রিয় নার্সারিটির বুক চিরে চলে গেছে শহরের ব্যস্ততম প্রধান সড়ক। চারপাশে অসংখ্য ঘরবাড়ি, পথঘাট, স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মন্দির, দোকানপাট, ব্যস্ত মানুষের মিছিল। এসবের আড়ালেই ঘুমিয়ে আছে চিরায়ত বাংলার বর্ণাঢ্য এক উদ্যান-ঐতিহ্যের করুণ উপাখ্যান।

  • মোকারম হোসেন, প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক