Thank you for trying Sticky AMP!!

সুরক্ষার নামে যেন নিয়ন্ত্রণ না হয়

‘অনলাইন স্বাধীনতা ও বাংলাদেশে ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগ’ শীর্ষক প্যানেল আলোচনায় বাঁ থেকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) এদেশীয় পরিচালক টুমো পোটিআইনেন, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, ওরাকলের এদেশীয় ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুবাবা দৌলা, যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার রবার্ট ডিকসন ও যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। আজ রোববার রাজধানীর ইএমকে সেন্টারে

ডিজিটাল অর্থনীতির বিকাশের যুগে নতুন মুদ্রা হয়ে উঠেছে উপাত্ত (ডেটা)। এখন উপাত্ত সুরক্ষা আইনের মাধ্যমে উপাত্তের সুরক্ষা দিতে গিয়ে তা যেন নিয়ন্ত্রণ না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখা জরুরি। আর সব মিলিয়ে উন্নয়ন ও নিরাপত্তা কোনোভাবেই গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের চেয়ে জরুরি হতে পারে না।

আজ রোববার ‘অনলাইন স্বাধীনতা এবং বাংলাদেশে ব্যবসা ও বিনিয়োগ’ শীর্ষক এক প্যানেল আলোচনায় বক্তারা এ অভিমত দেন। রাজধানীর ইএমকে সেন্টারে ওই আলোচনার আয়োজন করা হয়। ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের ফেসবুক পেজে তা সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।

ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেন, বিশ্বের সব জায়গাতেই সরকারকে অবশ্যই অনলাইন এবং এর সঙ্গে যুক্ত ব্যবহারকারীর তথ্য দায়িত্বশীলভাবে পরিচালনার পাশাপাশি লোকজনের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় সচেষ্ট থাকতে হবে। কাজটি জটিল। কারণ, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সুরক্ষা এবং নিরাপত্তার অপরিহার্যতার মতো বিষয়গুলোর মধ্যে ভারসাম্য রেখে কাজটি করতে হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীদের কাছে বাংলাদেশের বাজার খুবই আকর্ষণীয় বলে উল্লেখ করেন পিটার হাস। তিনি বলেন, ‘তাঁরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ এবং নিজেদের ব্যবসা সম্প্রসারণের বিষয়ে আগ্রহী। তবে একই সময়ে, আমরা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে এ আশঙ্কার কথা শুনতে পাই যে ডিজিটাল স্পেস নিয়ে প্রস্তাবিত নতুন আইন ও প্রবিধানগুলো তাঁদের জন্য এখানে ব্যবসা করা আরও কঠিন করে তুলবে।’

এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের ডিজিটাল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং ওভার-দ্য-টপ প্ল্যাটফর্মগুলোর জন্য প্রণীত প্রবিধানগুলোর পাশাপাশি উপাত্ত সুরক্ষা আইনের খসড়া নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের উদ্বেগ তুলে ধরেন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদারত্বকে আমরা গুরুত্ব দিই বলে উদ্বেগের বিষয়গুলো সরাসরি সরকারকে জানিয়েছি। তবে আমাদের উদ্বেগের বিষয়গুলো তুলে ধরার আগে এটা স্পষ্ট করতে চাই যে আমরা বাংলাদেশের নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়টির প্রতি শ্রদ্ধাশীল।’

মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, উপাত্ত সুরক্ষা আইনের খসড়ায় যদি ডেটা স্থানীয়করণের প্রয়োজনীয়তাকে কঠোরভাবে অনুসরণের শর্ত দিয়ে আইনে পরিণত করা হয়, তাহলে বর্তমানে বাংলাদেশে কাজ করছে, এমন কিছু মার্কিন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের বাজার ছেড়ে যেতে বাধ্য হতে পারে। একইভাবে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম পরিচালনার ক্ষেত্রে যদি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহারকারীদের তৈরি করা কনটেন্টের কারণে অপরাধের দায় নিয়ে ফৌজদারি আইনের মুখোমুখি হতে হয়, তাহলে তারা এখানে তাদের ব্যবসায় বিনিয়োগ করা থেকে বিরত থাকবে। তিনি বলেন, দুই হাজারের বেশি স্টার্টআপকে ব্যবসা ছেড়ে দিতে হতে পারে। এতে করে প্রতিদিন যে কয়েক কোটি বাংলাদেশি তাদের যে সেবা নিচ্ছেন, তাঁরা তা থেকে বঞ্চিত হবেন।

ব্যবসাকে আকর্ষণীয় করার জন্য উদ্ভাবনের সংস্কৃতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ আর এ জন্য অনলাইন উন্মুক্ত ও অবাধ হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। তিনি বলেন, ‘আমরা অনলাইন প্ল্যাটফর্মের যে খসড়া আইন দেখেছি, সেখানে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে এমন অনলাইন কনটেন্ট বা বিষয়বস্তুর সংজ্ঞার বিস্তৃত পরিসর নিয়ে আমাদের উদ্বেগ রয়েছে।’

মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, উপাত্ত সুরক্ষা আইনের সর্বশেষ খসড়ায় একটি স্বাধীন উপাত্ত তদারকি কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থা রাখা হয়নি এবং এ আইনে ফৌজদারি শাস্তি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অবস্থান তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘যদিও আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে প্রতিটি দেশ তাদের স্থানীয় প্রেক্ষাপটকে অবশ্যই বিবেচনায় রাখবে। কিন্তু আমরা বাংলাদেশসহ সব দেশকে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট আন্তর্জাতিক মানদণ্ডগুলো সমুন্নত রাখার আহ্বান জানাই।’

মার্কিন রাষ্ট্রদূতের মতে, শেষ পর্যন্ত উন্নয়ন ও নিরাপত্তা কোনোভাবেই গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ঊর্ধ্বে স্থান পেতে পারে না। এ মূল্যবোধগুলো আসলে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এবং একে অপরকে শক্তিশালী করে। তিনি এ বিষয়গুলো নিয়ে বাণিজ্যিক ও ব্যবসায়িক সংস্থা, নাগরিক সমাজ এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে পরামর্শ করার কথা বলেন।

ঢাকায় যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার রবার্ট ডিকসন বলেন, ডিজিটাল অর্থনীতির যে বিবর্তন হয়েছে, তাতে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে হলে নিষ্পেষণের সুযোগ নেই। ডেটা সুরক্ষা আইনের খসড়ায় ব্যক্তিগত গোপনীয়তার বিষয়ে উদ্বেগ রয়েছে। এতে করে আন্তর্জাতিক পক্ষগুলোর উদ্বেগ বাড়ার আশঙ্কা আছে। তাই মানবাধিকার সমুন্নত রেখে অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার স্বার্থে আন্তর্জাতিক মান অক্ষুণ্ন রেখে কাজটি করতে হবে। তবে বিভিন্ন পক্ষকে যুক্ত করে এ আইনের খসড়া নিয়ে যে আলোচনা তা আশাব্যঞ্জক।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, খসড়া আইনে বিভিন্ন ধারণা নিয়ে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে।

ব্যক্তিগত ডেটা বলতে কী বলা হচ্ছে, তা সুনির্দিষ্ট করা হয়নি। গোপনীয়তা এবং ব্যক্তির অধিকারের ক্ষেত্রেও ধারণাটা স্পষ্ট নয়। ডেটার স্থানীয়করণের ক্ষেত্রে ব্যবসার কোনো স্বচ্ছতা নেই এবং এর প্রভাবই স্পষ্ট নয়। আর এ ধরনের আইন কার্যকরের ক্ষেত্রে একটি স্বাধীন কমিশনের অপরিহার্যতা থাকলেও এখানে তা নেই। ফলে সামগ্রিকভাবে ডেটা সুরক্ষার নামে তা যেন নিয়ন্ত্রণ না হয়, এ আশঙ্কা রয়েছে। সামগ্রিকভাবে সরকারকে এখানে এতটা ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে যে এটা নজরদারির জন্য প্রয়োগ হতে পারে।

কম্পিউটার সফটওয়্যার নির্মাতা মার্কিন প্রতিষ্ঠান ওরাকলের এদেশীয় ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুবাবা দৌলা বলেন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কালে ডেটাকে নতুন মুদ্রা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রতিদিন যে ডেটা তৈরি হচ্ছে, তার মজুত অপ্রত্যাশিত হারে বেড়ে চলেছে। অনলাইনের স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলাটা ডিজিটাল অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ডেটা সুরক্ষা আইন যেন প্রতিবন্ধকতা তৈরি না করে, সে আহ্বান জানিয়ে রুবাবা দৌলা বলেন, আইসিটি রপ্তানি ২০০৮ সালের ২৫ মিলিয়ন থেকে ২০২১ সালে প্রায় দুই বিলিয়ন ডলার হয়েছে। চার গুণ হয়ে ২০২৫–এ ৪ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। এ প্রবৃদ্ধি কীভাবে হবে, যদি প্রতিবন্ধকতা দেওয়া হয়?
আলোচনায় অন্যান্যের মধ্যে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) এদেশীয় পরিচালক টুমো পোটিআইনেন অংশ নেন।