Thank you for trying Sticky AMP!!

ঈদের সাদা পোলাও

অপি করিমের পরিবার: বড় বোন, মা, ছোট ভাই, বাবা ও অপি করিম

আমার ছোটবেলা কেটেছে পুরান ঢাকায়, বেচারাম দেউড়িতে। তখন কিছু ঈদ করতাম এইখানে, কিছু কুমিল্লায় নানুবাড়িতে! পুরান ঢাকার ওই দোতলা বাড়ির সিঁড়ি, চাপকল, আব্বার ছাদবাগান, ছাগল পোষা, আমাদের প্রাইভেট রিকশা, দাদির শাড়ি আর হাতে আমের মোরব্বা বানানোর জন্য কাঁটা চামচ—ওই বাড়িকেন্দ্রিক জীবনযাপনের অনেকটা মনে থাকলেও কোনো এক বিচিত্র কারণে ওখানকার ঈদের স্মৃতি খোঁজা ব্ল্যাকহোলে নিজেকে হাতড়ানোর মতোই মনে হলো! কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্য, যে ঈদগুলো কুমিল্লায় করতাম, সেগুলোর স্মৃতিতে ঘন পর্দা থাকলেও তা দেখলাম অর্ধস্বচ্ছ, কখনো কখনো বেশ স্বচ্ছ! যুক্তিবিজ্ঞানে এর শক্তিশালী ব্যাখ্যা আছে নিশ্চয়ই! আমি আমার সাধারণ ব্যাখ্যাটা দিই।

নানা-নানুর ১০ ছেলেমেয়ে। একদম ছোট চারজন বাদে আম্মার অন্য সব ভাইবোন তাঁদের ছেলেমেয়ে নিয়ে ঈদের চার-পাঁচ দিন আগেই কুমিল্লায় চলে আসতেন। খালাতো-মামাতো ভাইবোনদের মধ্যে বয়সের অনেক পার্থক্য না থাকলেও অলিখিত বয়সভিত্তিক দল আপনা–আপনি তৈরি হয়ে যেত। চারটা দল। আমি তৃতীয় দলে।

২০২৪ সালে এসে বোধ করি কুমিল্লার ঈদ মগজে ও মনে থাকার মূল কারণগুলো হলো অবাধ স্বাধীনতা, নিরন্তর খেলাধুলা, পড়তে বসার শূন্য চাপ, আম্মার শিথিল শাসন এবং প্রধানত নানুর প্রশ্রয়, প্রতি পরিবারের জন্য কুলাভরা আমসত্ত্ব আর দুধের টিনভর্তি মুড়ির মোয়া। এ ছাড়া প্রতিবার নতুন কিছুর সঙ্গে পরিচয়—কটকটিওয়ালা, সবুজ উঠানে সাপ ধরা পড়া, ডোবায় কচ্ছপ, পুকুরে মাছের বুদ্‌বুদের পিছু পিছু দৌড়ানো, জোনাকি, ভাঁটফুল! আমি তখন সকাল সন্ধ্যা ধারাবাহিক নাটকের পারুলি চরিত্রের জন্য একটু-আধটু পরিচিত। কত আর হবে বয়স? আড়াই কি তিন বা চার! কাজল মামা বাদে নানুবাড়িতে বাড়তি সোহাগ না পেলেও আশপাশের বাড়ির অনেকের বিশেষ স্নেহের ছিলাম।

কোরবানির ঈদের চেয়ে সব সময় আমার রোজার ঈদই ভালো লাগত। আবার ঈদের দিনের চেয়ে বেশি আনন্দের ছিল রমজান মাসের শেষের দিনগুলো। সাহ্‌রির একদম শেষ সময়ে নানা একটা গামলায় আম-কলা-দুধভাত নিয়ে বসতেন। আমরা বয়সানুক্রমে একে একে এসে একনলা করে খেতাম। বয়স যাদের কম, রোজা রাখতে দেওয়া হতো না তাদের। কিন্তু রোজা রাখি কি না রাখি, যত দিন কুমিল্লায় ঈদ করেছি, সাহ্‌রিতে ওই দুধভাত খাওয়ার জন্য ঘুম থেকে উঠতে কোনো দিন কাউকে বলতে হয়নি।

আরেকটু বড় হয়ে চলে যাই মোহাম্মদপুরে। ওই বিল্ডিংয়ে চারতলায় বড় খালা, তিনতলায় বড় মামা, দোতলায় আমরা। পরে নানা-নানুও ছোট খালা আর ছোট মামাকে নিয়ে নিচতলায় চলে এলেন। এই সময়ের রোজা আর ঈদগুলো শহরের, কিন্তু অন্য রকম। বিকেলে ছাদে খেলতাম ফুটবল। খেলে ঘেমে পিপাসায় নিচে নেমেই কতবার যে ভুল করে পানি খেয়ে ফেলেছি, তার হিসাব নেই।

সবাই একসঙ্গে ইফতার করতাম। ৪০টা প্লেট সাজানো হতো বড় খালার বাসায় চারতলায়। ড্রাইভার, গৃহকর্মী—সবাই একসঙ্গে। ছোটরা বসতাম মাটিতে আর বড়রা খাবার টেবিলে। প্লেট আমরা ভাইবোনেরা একসঙ্গে সাজাতাম। বড়দের সাহায্য করতাম ছোটরা। কোনো দিন কিন্তু অধিক সন্ন্যাসীতে গাঁজন নষ্ট হয়নি। নিয়ম করে একেক দিন একেকজনের ওপর একেক দায়িত্ব পড়ত। আমার ভাগে কেন জানি সব সময় বেগুনি বিতরণের পর গোনার দায়িত্ব পড়ত। বেগুন ভালোবাসি, তাই হয়তো ওখান থেকে বেগুনের প্রতি ভালো লাগা তৈরি হয়েছে। কী জানি! তবে যেদিন যেদিন আমাদের বাসায় ইফতার হতো আর আব্বা পুরান ঢাকা থেকে ইফতারি নিয়ে আসত, ওই দিনগুলো মনে হতো আসল রোজার দিন।

অপি করিম

আমরা সবাই ছিলাম পড়ালেখায় চরম ফাঁকিবাজ! ইচ্ছা করে আস্তে আস্তে ইফতার করতাম। স্যার এসে বসে থাকতেন। আমরা যখন বাসায় নামতাম, স্যারের তখন চলে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। আর যদি চলে যেতেন রাগ করে, তাহলে ঈদ কাকে বলে, কত প্রকার ও কী কী, তা বুঝিয়ে ছাড়তেন! এরপর আম্মার ভূমিকাটা আর না-ই বলি!

ঈদের কাপড় নিয়ে সবার অনেক লুকোচুরির গল্প থাকে। আমাদের বাড়িতে সেটা হওয়ার কোনো উপায়ই ছিল না। কারণ, আমাদের সবার জামা একই কাপড় দিয়ে তৈরি হতো। কারও কামিজ, কারও ফ্রক, কারওবা শার্ট। কোথাও বের হলে লাইন ধরে সব একরকম। খালা–ভাগনে–ভাগনি–ছেলে–মেয়েনির্বিশেষে সবাই এক। সালামি নিতে গিয়ে এমনও শুনতে হয়েছে যে তোমাকে না একবার দিলাম। দোষ কী, সবার যে একই পোশাক! কবে যে এই প্রচলন বন্ধ হলো, মনে নেই। আমার কিন্তু ভালোই লাগত।

সবচেয়ে ভালো লাগত সালামি পেলে। ২০, ১৫, ১০, ৫ টাকা—সালামি হতো এভাবে বয়সভিত্তিক। সালামির আলাদা ব্যাগ থাকত। আমি আমার সব টাকা আম্মাকে দিয়ে দিতাম। ঈদের দুই দিন পর সালামির টাকা জমিয়ে সব ভাইবোন রিকশায় চড়ে ধানমন্ডি যেতাম চায়নিজ খেতে। ওই দিন আমাদের অভিভাবক ছাড়া বাইরে বের হওয়ার অনুমতি দেওয়া হতো। ওই দিন সবাই মুক্ত পাখি—আনন্দ, আহা, আসল ঈদ! তবে আমার আম্মার জন্য মন খারাপ লাগত। আম্মা ছাড়া ভয়ও লাগত।

আরেকটা সময় মন আমার ভীষণ খারাপ হতো। আমাদের মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের বাসার ঠিক উল্টো দিকেই কবরস্থান। আমরা রোজার চাঁদ বা ঈদের চাঁদ দেখতে ছাদে যেতাম সবাই মিলে। চাঁদ দেখলেই নাকি ইচ্ছাপূরণের জন্য দোয়া করতে হয়। আমি বরাবরই ফাঁকিবাজ। পরীক্ষার ফলাফলের জন্যই দোয়া করতাম, যদিও কোনো দিনই আমি ওই চিকন চাঁদ দেখতে পাইনি।

কিন্তু তাতে কী! দোয়া তো মিস করা যায় না! তারপর কবরস্থানের ওই পাশে গিয়ে দাঁড়াতাম। রোজা শুরু হওয়ার আগের দিন নাকি আত্মারা ছাড়া পায় এক মাসের জন্য। আর ঈদের আগের দিন খুব মন খারাপ করে। অপেক্ষা করে পরের বছরের রমজান মাস কবে আসবে। এসব কে বলেছিল মনে নেই। তবে ছোট বয়সে মনে দাগ কেটেছিল। তখনো আমি কাউকে হারাইনি। তবু কবরস্থানের দিকে তাকালে কেমন যেন মায়া লাগত।

এখন তো কতজনকে হারিয়েছি। আব্বাকেও। এখন ঈদের দিনের সাদা পোলাও দেখলে হু হু করে ওঠে বুকটা। আমার বাবাটা খুব পছন্দ করত। চলে যাওয়ার আগের দিনও খেতে চেয়েছিল আম্মার কাছে। ছেলেবেলার ঈদের সাদা পোলাও আর আব্বা মিশে গেল আমার জীবনে। সেই সঙ্গে ঈদসংখ্যা। আব্বা ঈদসংখ্যা এনে দিতেন। বানান করে ছোটদের গল্প-কবিতা পড়তে শুরু করা আমি কিশোর উপন্যাসে ডুব দিতে দিতে কখন যে বড় হয়ে গেছি।

ঈদের দিন ঘরের দরজা বন্ধ করে এখন শুধু ঘুমাই আর পড়ি। এখন কখন যে ঈদের শুরু আর শেষ হয়, বুঝতেই পারি না।

আচ্ছা, আমাদের সবারই কি ছোটবেলার ঈদগুলো অন্য রকম ছিল? নাকি আমরা বড় হয়ে ঈদকে ছেলেবেলার চোখ দিয়ে দেখতে ভুলে গেছি!

  •  অপি করিম: স্থপতি, অভিনয়শিল্পী