Thank you for trying Sticky AMP!!

মইনুল হোসেন চৌধুরী, ১৯৭১

ঢাকা দখলের অভিযান

৭ ডিসেম্বর আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চলে আসি এবং প্রতিরক্ষাব্যূহ রচনা করি। ভারতীয় বাহিনী এই সময়টাতে আশুগঞ্জে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। ১১ তারিখ পর্যন্ত আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও তার আশপাশে অবস্থান গ্রহণ করি। পাকিস্তানি বাহিনী তখন পাকিস্তানের ২৭ ব্রিগেডের জাঁদরেল ব্রিগেডিয়ার সাদউল্লাহ্​র নেতৃত্বে আশুগঞ্জ ও ভৈরববাজারে অবস্থান নেয়। সাদউল্লাহ্​কে আমি ব্যক্তিগতভাবে জানতাম। তাঁর সঙ্গে ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৪ ডিভিশনে একসঙ্গে চাকরি করেছি। তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে একজন অত্যন্ত সাহসী ও স্বনামধন্য অফিসার হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

আমরা ওই কদিন পুরো এলাকায় প্যাট্রলিং করি এবং আমাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসি। ৯ ডিসেম্বর দুপুরে ভারতের ১০ বিহার রেজিমেন্ট আশুগঞ্জে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালাই। ওই আক্রমণ পাকিস্তানিরা বেশ ভালোভাবে প্রতিহত করে। এই সংঘর্ষে ভারতীয় বাহিনীর বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। অনেক সৈন্য নিহত ও আহত হয়। ১০/১১ ডিসেম্বর রাতে পাকিস্তানি বাহিনী ভৈরব ব্রিজটি বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দেয় এবং আশুগঞ্জ থেকে মেঘনা অতিক্রম করে ভৈরবে গিয়ে অবস্থান নেয়। ভৈরবে তারা শক্ত ঘাঁটি গড়ে তোলে।

১২ তারিখ ভোরে ভারতীয় বিমানবাহিনী ভৈরবে পাকিস্তানি বাহিনী অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। বেশ কিছু হেলিকপ্টার ওই দিনই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তত্কালীন নিয়াজ স্টেডিয়ামে অবতরণ করে এবং ভারতীয় ১০ বিহার রেজিমেন্টের সৈন্যদের নরসিংদী নিয়ে যেতে থাকে।

আমাকে বলা হলো, আমি যেন নৌকাযোগে মেঘনা নদী পার হয়ে আমার পুরো রেজিমেন্ট নিয়ে ভৈরববাজার এড়িয়ে নরসিংদী পৌঁছানোর চেষ্টা করি। ওই দিনই বেলা ১১টায় আমরা নৌকা জোগাড় করে আরও দক্ষিণ-পশ্চিমে সরে গিয়ে পুরো রেজিমেন্ট নিয়ে মেঘনা নদী পাড়ি দিই। এ সময় পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের লক্ষ্য করে দূরপাল্লার কামান থেকে গোলা নিক্ষেপ করতে থাকে। দিনের বেলায় এই গোলাগুলির ভেতর দিয়ে আমরা নদী পার হই এবং মেঘনার পশ্চিম পাড়ে এসে উঠি। এরপর রেললাইন ধরে হেঁটে নরসিংদী পৌঁছাই। আমরা নরসিংদী রেলস্টেশনের আশপাশে অবস্থান নিই। ভারতীয় বাহিনী হেলিকপ্টারে এসে আগেই সেখানে অবস্থান গ্রহণ করে।

লম্বা পথ পাড়ি দেওয়ায় সৈন্যরা অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ওই রাতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা রাজিউদ্দীন রাজু আমাদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করেন। ১ ডিসেম্বরের পর এটাই ছিল আমাদের জন্য একটি পরিপূর্ণ এবং ভরপেট খাবার। তবে এর আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ভাত খাওয়ার সুযোগ হয়েছিল।

১৪ তারিখ দুপুরবেলা আমরা ঢাকার অদূরবর্তী ডেমরায় পৌঁছাই। আমার সঙ্গে নিয়মিত বাহিনী দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রায় ৮০০ সৈনিক ছিল।

১৩ তারিখ বিকেলে আমি লেফটেন্যান্ট সাঈদের নেতৃত্বে ঢাকার দিকে একটি টহল দল পাঠাই। টহল দল ফিরে এসে আমাকে জানায়, ঢাকা থেকে লোকজন গ্রামের দিকে চলে আসছে। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে বুঝতে পারি, পাকিস্তানি বাহিনী দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ঢাকায় এসে জড়ো হচ্ছে এবং ঢাকার চারদিকে অবস্থান গ্রহণ করছে।

ঘটনা বিশ্লেষণ করে আমি বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ি। বলতে গেলে পুরো রাতই আমার নিদ্রাহীনভাবে কাটে। আমার কেবলই মনে হচ্ছিল, ঢাকা দখলের জন্য বোধ হয় আমাদের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ করতে হবে।

শহরের ভেতরে এ ধরনের যুদ্ধ সম্পর্কে যাঁদের ধারণা আছে, তাঁরা হয়তো বুঝতে পারবেন, এ ধরনের যুদ্ধ কী রকম ভয়াবহ। এতে উভয় পক্ষই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয় এবং বেসামরিক নাগরিকেরাও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যুদ্ধের তীব্রতায় পুরো শহর পরিণত হতে পারে ধ্বংসস্তূপে।

মুক্তিযোদ্ধাদের ঢাকায় প্রবেশ, ডিসেম্বর ১৯৭১

সমগ্র নরসিংদী এলাকায় মিত্রবাহিনীর দুই ব্যাটালিয়ন ও আমার এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য মোতায়েন ছিল সে সময়। ৪ ডিসেম্বর ভারতের যুদ্ধ ঘোষণার পর থেকেই ঢাকা দখলের যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়, তারই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের সেনারা সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছিল। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার ও ভারতীয় সরকারে মতৈক্যের ভিত্তিতে সে সময় সিদ্ধান্ত হয় যে অপারেশন জ্যাকপট চলাকালীন এলাকায় দুই বাহিনীর মধ্যে যে অফিসার ওই এলাকায় সিনিয়র হবেন, তিনিই যৌথ বাহিনীর অধিনায়ক হবেন। মূলত প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভারতীয় বাহিনীর অফিসার সিনিয়র থাকায় তাঁরাই অধিনায়ক ছিলেন। এই প্রক্রিয়ায় ৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ও ভারতীয় যৌথ বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে ব্রিগেডিয়ার মিশ্র ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আমার সঙ্গে যোগ দেন।

১৩ ডিসেম্বর ব্রিগেডিয়ার মিশ্র আমাকে নরসিংদীতে অবস্থান করে সেখানকার প্রতিরক্ষাব্যবস্থা দেখতে বলেন। আমি তাঁর কথায় কোনো সাড়া না দিয়ে আমার ব্যাটালিয়ন নিয়ে রাতের বেলায় সম্মুখে অগ্রসর হতে থাকি। আমার মনে পড়ল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন বার্লিন দখলের জন্য মিত্রবাহিনীর প্রতিযোগিতার কথা। সেখানে কে আগে পৌঁছে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবে, তা নিয়েই রুশ ও অন্যান্য মিত্রবাহিনীর সৈন্যদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা হয়েছিল। তাই আমরা ঢাকার দিকে অগ্রসর হতে লাগলাম।

১৪ তারিখ দুপুরবেলা আমরা ঢাকার অদূরবর্তী ডেমরায় পৌঁছাই। আমার সঙ্গে নিয়মিত বাহিনী দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রায় ৮০০ সৈনিক ছিল। ৩ নং সেক্টরের কিছু মুক্তিযোদ্ধা, যারা আমাদের সঙ্গে রায়পুরায় যোগ দেয়, তারাও ডেমরায় সমবেত হয়। আমরা ডেমরা শিল্পাঞ্চলের পেছনে অবস্থান গ্রহণ করি। সেখানে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে আমাদের থেমে থেমে গোলাগুলি চলতে থাকে। তবে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান ছিল বেশ দুর্বল। ভারতীয় বাহিনীর একটি ব্যাটালিয়ন তখন আমাদের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থান নেয়। অন্য একটি ব্যাটালিয়ন নরসিংদীর পূর্ব দিকে টঙ্গী বরাবর অবস্থান নেয়।

১৫ তারিখ রাতে আমি সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট আনিসের নেতৃত্বে ২০–২৫ সদস্যের একটি ফাইটিং প্যাট্রল বাড্ডার দিকে পাঠাই। তারা সেখানে আধা ঘণ্টার মতো অবস্থান করে এবং ১০–১৫টি ৮১ মিলিমিটার মর্টারের গোলা ঢাকার দিকে, তথা গুলশানের দিকে লক্ষ্য করে ছোড়ে। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনী এর কোনো পাল্টা জবাব দেয়নি।

১৬ ডিসেম্বর সকালে মিত্রবাহিনীর সঙ্গে অবস্থানরত সাংবাদিকদের মাধ্যমে জানতে পারি, পাকিস্তান সেনাবাহিনী বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছে। একটু পরে সে খবরের সত্যতা সরকারিভাবে জানতে পারি। আমার সৈন্যরা পায়ে হেঁটে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও নরসিংদী হয়ে ডেমরা পৌঁছে এবং পথে পথে বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ করে স্বভাবতই ছিল ক্লান্ত ও দীর্ঘ পথযাত্রায় দুর্বল। তাই সকালে ডেমরার একটি বাড়িতে ভারী কামান ও গোলাবারুদ রেখে আমরা ডেমরার প্রধান সড়কে উঠি। আমাদের পরনে খাকি পোশাক। কারণ, যুদ্ধকালীন কোনো সৈন্য ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায় না থেকে বেসামরিক পোশাকে যুদ্ধবন্দী হলে জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী কোনো সুযোগ-সুবিধা পাবে না, বরং দুষ্কৃতকারী হিসেবে গণ্য হবে। তা ছাড়া শৃঙ্খলা এবং সার্বিক নিয়ন্ত্রণের জন্য নিয়মিত বাহিনীর পোশাক থাকা একান্ত আবশ্যক। যাহোক, ডেমরা থেকে আমরা খাকি পোশাকে ডান দিকের রাস্তা ধরে যাচ্ছিলাম। বাঁ দিকের রাস্তায় দেখি, অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনী। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন মেজর আমাকে জড়িয়ে ধরেন। তাঁর সঙ্গে আমি পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি থেকে পরিচিত। ভগ্ন-মনোরথ মেজর আমাকে বোঝাতে চাইছিলেন যে তাঁর রেজিমেন্ট সাধারণ জনগণের ওপর কোনোরূপ নির্যাতনমূলক আচরণ করেনি। কোনোরূপ প্রত্যুত্তর না করে আমি আমার পথে ঢাকার দিকে চলতে লাগলাম। একটু পরে দেখি, ভারতীয় বাহিনী ব্রিগেডিয়ার সাবেক সিং মেজর হায়দারকে (পরে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে নিহত) নিয়ে গাড়ি করে বেসামরিক পোশাকে ঢাকার দিকে যাচ্ছেন। এদিকে ওই দিনই এয়ার ভাইস মার্শাল আবদুল করিম খন্দকারও কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন মিত্রবাহিনীর সঙ্গে। ঢাকায় আত্মসমর্পণ ও অনুষ্ঠানের ছবিতেও তাঁদের দেখা যায়। উল্লেখ্য, ব্রিগেডিয়ার সাবেক সিং ১৯৮৪ সালের অমৃতসর স্বর্ণমন্দিরের সংঘর্ষে ভারতীয় বাহিনীর হাতে মন্দিরের ভেতরে নিহত হন। ভারতীয় সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি ছিলেন উগ্রপন্থী শিখনেতা সন্ত ভিন্দ্রানওয়ালের সামরিক উপদেষ্টা।

সন্ধ্যার দিকে আমরা ঢাকা পৌঁছাই। রাস্তার দুই পাশের বাড়ির ছাদে অসংখ্য কৌতূহলী জনতা আমাদের স্বাগত জানায়। অনেকে অবশ্য আমাদের খাকি পোশাকে দেখে অবাক হয়। কারণ, আমাদের এবং পাকিস্তানি বাহিনীর উভয়ের পোশাক ছিল খাকি। ফলে তারা কিছুটা ভীতসন্ত্রস্তও ছিল। যাহোক, আমাদের চিনতে তাদের কিছুটা সময় লাগে।

সূত্র: ‘ভেতর থেকে দেখা সেনাবাহিনীর এক দশক, ১৯৭১–৮১: এক জেনারেলের নীরব সাক্ষি’, প্রথম আলো, ১ ডিসেম্বর ১৯৯৯

মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী (অব.): সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা; মুক্তিযুদ্ধে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক