Thank you for trying Sticky AMP!!

বটিয়াঘাটার ‘আবহাওয়াবিদেরা’

মোবাইলের অ্যাপে আবহাওয়া পর্যালোচনা করছেন প্রশিক্ষিত সদস্যরা। গতকাল খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার সাচিবুনিয়ায়

খুলনার বটিয়াঘাটার উত্তর রাঙ্গেমারী গ্রামের রতন কুমার মণ্ডলের আছে এক একর জমি। প্রতিবছর বর্ষায় ওই জমিতে তিনি আমনের আবাদ করেন। কিন্তু এ বছর আগে থেকেই জানতেন, বৃষ্টি কম হবে। তাই আর আবাদ করেননি। সেখানে লাগিয়েছিলেন কম বৃষ্টিতে উৎপাদন ভালো হয় এমন জাতের সবজির চারা। এখন সেই জমি প্রস্তুত করছেন বোরো ধান লাগানোর জন্য। আগেভাগে আবহাওয়ার খবর জেনে এভাবে চাষাবাদ করায় তাঁর খরচ কমে গেছে, লাভও পেয়েছেন ভালো।

উপজেলার জলমা ইউনিয়নের ঝড়ভাঙ্গা গ্রামের সুজিত গোলদার ঘুম থেকে জেগেই দেখেন, আকাশের মুখ ভার। যেকোনো সময়ে বৃষ্টি নামবে। খানিকটা ভড়কে গেলেন সুজিত। কারণ, সেদিনই তাঁর ছেলের আশীর্বাদের অনুষ্ঠান। বাড়িভর্তি মানুষ, ব্যাপক আয়োজন। এ অবস্থায় বৃষ্টি হলে সব বরবাদ হয়ে যাবে।

আবহাওয়ার উন্নতি না দেখে সুজিত ছোটেন পাশের কাকলি গোলদারের বাড়ি। কাকলির কাছে জানতে চান, আবহাওয়া এমন কেন? বৃষ্টি হবে কি না? আকাশ মেঘলা থাকলেও বৃষ্টি হবে না বলে সুজিতকে আশ্বস্ত করেন কাকলি। যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন সুজিত। এরপর নিশ্চিন্তে আয়োজন চলতে থাকে তাঁর বাড়িতে।

অনাবৃষ্টি, খরা, অতিবৃষ্টি, ঝড়সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপকূলীয় এলাকার কৃষিকে বিপর্যস্ত করে তুলছে।
জীবনানন্দ রায়, বটিয়াঘাটা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয়ের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা
মোবাইলের অ্যাপের মাধ্যমে কী করে আবহাওয়া দেখা যায়, তা বুঝিয়ে দিচ্ছেন পিকসা প্রকল্পের এক কর্মী। গতকাল খুলনার বটিয়াঘাটার সাচিবুনিয়ায়

রতন ও সুজিতের মতো আগেভাগে আবহাওয়ার খবর জেনে চাষাবাদসহ নানা আয়োজনের প্রস্তুতি নেন বটিয়াঘাটার অনেক মানুষ। তাঁদের এ কাজ সহজ করে দিয়েছেন ‘গ্রামের আবহাওয়াবিদেরা’।

পেশায় আবহাওয়াবিদ না হলেও আবহাওয়ার বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহার করে সর্বশেষ তথ্য জেনে রাখেন তাঁরা। ঝড়ভাঙ্গা ও পাশের সাচিবুনিয়া গ্রামে এমন শতাধিক নারী-পুরুষ রয়েছেন। পেশায় তাঁরা গৃহিণী ও কিষান-কিষানি। তাঁদের কাছ থেকে আবহাওয়ার তথ্য নিয়েই কৃষিকাজ, বাড়ির কাজ, ধর্মীয় অনুষ্ঠানসহ নানা কাজ করেন ওই দুই গ্রামসহ আশপাশের গ্রামের মানুষেরা।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আবহাওয়ার ব্যাপক পরিবর্তন হচ্ছে উল্লেখ করে বটিয়াঘাটা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয়ের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা জীবনানন্দ রায় প্রথম আলোকে বলেন, অনাবৃষ্টি, খরা, অতিবৃষ্টি, ঝড়সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপকূলীয় এলাকার কৃষিকে বিপর্যস্ত করে তুলছে।

এমন পরিস্থিতিতে আবহাওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চাষাবাদ না করার কোনো বিকল্প নেই। আর সেই কাজই করছেন ঝড়ভাঙ্গা ও সাচিবুনিয়া গ্রামের কৃষকেরা। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা তাঁদের খুব বেশি না থাকলেও আবহাওয়ার অদ্যোপান্ত তাঁদের মুখস্থ। আশপাশের বিভিন্ন গ্রামের মানুষ ওই আবহাওয়াবিদদের কাছে তথ্য জেনে চাষাবাদ করছেন।

শুরুর কথা

২০১৮ সালের শুরুর দিকে ঝড়ভাঙ্গা ও সাচিবুনিয়া গ্রামের ২৫ কিষান-কিষানিকে আবহাওয়ার তথ্য সম্পর্কে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয় বটিয়াঘাটা উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয়। লেখাপড়া কম জানলেও স্মার্টফোন ব্যবহার করতে পারেন এমন ব্যক্তিদের প্রাধান্য দেওয়া হয় সেখানে।

পার্টিসিপেটরি ইন্টিগ্রেটেড ক্লাইমেট সার্ভিস ফর অ্যাগ্রিকালচার (পিকসা) প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশের দুটি এলাকায় ওই প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়। এর মধ্যে বটিয়াঘাটার জলমা ইউনিয়নে একটি কেন্দ্র, আরেকটি আছে পটুয়াখালীতে। সপ্তাহে একটি করে ছয় সপ্তাহ ধরে তাঁদের ওই প্রশিক্ষণ চলে। প্রশিক্ষণে কীভাবে অ্যাপ দেখে আবহাওয়া সম্পর্কে জানা যায়, তার ধারণা দেওয়া হয়। মাত্র ছয় দিনের প্রশিক্ষণ খুব বেশি উপকারে আসেনি কৃষকদের।

সরকারি ওই প্রশিক্ষণের পর নেদারল্যান্ডসের অখেনেঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা প্রকল্পের আওতায় বাছাই করে ৩০ কৃষককে (নারীসহ) নিয়ে গড়ে তোলা হয় আবহাওয়া স্কুল। ওই স্কুলে আরও ২০ দিন প্রশিক্ষণ পান কৃষকেরা। এর পরই মূলত আবহাওয়ার বিস্তারিত তথ্য সম্পর্কে জানতে পারছেন তাঁরা। পরে সাচিবুনিয়া স্কুল ভিটার মোড় এলাকায় এলাকাবাসী গড়ে তুলেছেন ‘ওয়াটার অ্যাপস জলবায়ু ক্লাব ও কৃষি ক্লিনিক’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান।

প্রশিক্ষণ পাওয়ার পর অ্যাপের তথ্যের সঙ্গে প্রতিদিনের আবহাওয়া মেলানোর চেষ্টা করতেন কৃষকেরা। দুই-একদিন ছাড়া মিলেও যেত প্রায়ই। নিজেদের প্রতি আস্থা বাড়তে শুরু করে, বিশ্বাস করতে শুরু করেন, অ্যাপের তথ্যও। পরে ওই দুই গ্রামের প্রায় ৭৫ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বামিস পোর্টাল ছাড়াও আরও কয়েকটি আবহাওয়া বিষয়ক ওয়েবসাইট ও অ্যাপ ব্যবহার করে ৭ দিন, ১৪ দিন ও ৩ মাসের আবহাওয়ার তথ্য সম্পর্কে জানতে পারেন তাঁরা।

টিপ্পনী উপেক্ষা করে এগিয়ে চলা

কাকলি গোলদার, লিপিকা গোলদার, মিলন রায়েরা প্রশিক্ষণ পাওয়ার পর যখন নিজেদের অর্জিত জ্ঞান প্রচার শুরু করলেন, তখন বাধে বিপত্তি। এলাকার বেশির ভাগ মানুষই তাঁদের ‘পাগল’ বলে সম্বোধন করতে থাকেন। কেউ কেউ টিপ্পনী কেটে বলতেন, ‘এরা ভগবান হয়ে গেছে, আগে থেকে ঝড়-বৃষ্টির তথ্য বলে দিচ্ছে।’

ওই প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন ঝড়ভাঙ্গা গ্রামের হ্যাপি গোলদারও। তিনি বলেন, ‘নানা কটুকথা শুনে মন ভেঙে যেত। কিন্তু দমে যাইনি। বিশেষ করে অ্যাপের সঙ্গে আবহাওয়ার যেন আরও বেশি নির্ভুল তথ্য পাওয়া যায় সেই চেষ্টা করতাম। কারও কাছে দিনের আবহাওয়া কেমন থাকবে জানানোর পর শঙ্কায় থাকতাম, যদি না মেলে তখন আরও বেশি কটুকথা শুনতে হবে। কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই দেখা যেত আবহাওয়া মিলে যাচ্ছে।’

বদলে যাওয়া কৃষি

সাচিবুনিয়া গ্রামের পাশের রাঙ্গেমারী গ্রামের সমীরণ রায় বলেন, তাঁর খেতে আধা পাকা ধান ছিল। প্রায় ১০ দিন আগেই গ্রামের ওই আবহাওয়াবিদদের কাছ থেকে জানতে পারেন, বড় একটি ঝড় আসছে। ঝড় আসার দুই দিন আগেই খেত থেকে সেই ধান কেটে ফেলেন তিনি। যদি ধান কেটে না নেওয়া হতো তাহলে বাতাসের তাণ্ডবে তা ঝরে পড়ত অথবা গাছ নুয়ে মাটির সঙ্গে মিশে যেত।

ওই দুই গ্রামের অন্তত ১০ জন কৃষক জানান, জমিতে কীটনাশক বা সার দেওয়ার পর বৃষ্টি হলে তা ধুয়ে যায়। এতে সার বা কীটনাশক কোনো কাজে আসে না। পরবর্তী সময়ে আবার দিতে হয়। এ কারণে এখন তাঁরা আবহাওয়ার তথ্য নিয়েই এসব কাজ করেন।

বটিয়াঘাটা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম বলেন, ওই ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামকে কেন্দ্র করে কয়েকটি মেসেঞ্জার গ্রুপ খোলা হয়েছে। ওই গ্রুপে অন্যান্য কৃষককেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সেখানে আবহাওয়ার অ্যাপের তথ্যগুলো দেওয়া হয়। তা দেখেই কৃষকেরা বুঝতে পারেন, কোন দিন আবহাওয়া কেমন থাকবে। এতে ওই এলাকার কৃষিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। এখন পুরো উপজেলায় এটি ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।