Thank you for trying Sticky AMP!!

পদ্মা সেতুর ব্যয় বাড়ছে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা

পদ্মা সেতুতে ব্যয় বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে ভ্যাট-কর ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধি এবং বাড়তি কাজ।

  • মোট ব্যয় সাড়ে ৩২ হাজার কোটি

  • প্রকল্প প্রস্তাব চূড়ান্ত সংশোধনের উদ্যোগ।

  • নদীশাসনের জন্য এক বছর সময় বৃদ্ধির প্রস্তাব।

  • উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে খরচ প্রায় ৮৯ কোটি টাকা।

পদ্মা সেতু

পদ্মা সেতু চালু হয়েছে মাস পাঁচেক আগেই। এই সেতু দিয়ে যানবাহন চলাচল করছে। টোল বাবদ প্রতিদিন গড়ে দুই কোটি টাকা আয় হচ্ছে। তবে পদ্মা সেতু প্রকল্প এখনো চলমান। নদীশাসনের কাজ শেষ হয়নি। এ পরিস্থিতিতে আরেক দফা প্রকল্পের ব্যয় বাড়ছে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা।

বর্তমানে পদ্মা সেতু প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা আছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। নতুন করে সংশোধনের পর তা বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ৩২ হাজার ৬৩৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যয় বাড়ছে ২ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা। ২০০৭ সালে প্রথম প্রকল্পটির অনুমোদনের সময় ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকা।

সেতু বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, ব্যয় বৃদ্ধির পেছনে কারণ হচ্ছে—কিছু কাজ বেড়ে যাওয়া, ঠিকাদারের আয়ের ওপর কর ও পণ্যের ভ্যাট বৃদ্ধি, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, নদীভাঙন, ফেরিঘাট স্থানান্তর, সময়মতো কাজ শেষ না হওয়ায় পরামর্শকের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি, সেতুর জন্য যন্ত্রপাতি ক্রয় ও নকশায় কিছু সংশোধন। এর বাইরে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জন্য খরচ হয়েছে প্রায় ৮৯ কোটি টাকা।

কোন কোন কারণে প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানো দরকার, এর একটা তালিকা করেছে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। সূত্র বলছে, বাড়তি যে ব্যয় ধরা হয়েছে, এর বেশির ভাগ আগেই খরচ হয়ে গেছে। এখন প্রকল্প সংশোধনের মাধ্যমে তা আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ করা হচ্ছে। কিছু কাজ ভবিষ্যতে করা হবে। এর ব্যয়ও যুক্ত করে প্রকল্প প্রস্তাব চূড়ান্ত সংশোধন করা হবে।

পদ্মা সেতু প্রকল্পের মেয়াদ আগামী জুন পর্যন্ত। তবে নির্মাণকাজের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে গত জুনে। এখন চলছে ঠিকাদারের দেনা-পাওনা বুঝিয়ে দেওয়া এবং ছোটখাটো মেরামতকাল বা ডিফেক্ট লায়াবিলিটি পিরিয়ড (ডিএলপি)। তবে নদীশাসনের কাজ নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন না হওয়ায় তা (ডিএলপি) আরও এক বছর বাড়ানো হচ্ছে। এ বিষয়ে প্রকল্পের একটি সংশোধনী প্রস্তাব তৈরি করেছে সেতু বিভাগ। এটি অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হবে।

এ বিষয়ে সেতু বিভাগের সচিব মো. মনজুর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্প সংশোধনের প্রস্তাব তাঁর কাছে এসেছে। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে হলে পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন তিনি।

প্রকল্প পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম মোট কত টাকা ব্যয় বাড়তে পারে, তা জানিয়েছেন। তবে বিস্তারিত জানাতে রাজি হননি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্পের কোনো কোনো কাজে টাকা বেঁচে গেছে। কিছু কাজে বাড়তি খরচ করতে হয়েছে। তবে বাড়তি ব্যয়ের একটা বড় অংশ সরকার ভ্যাট-কর হিসেবে পেয়েছে। এটা আইন পরিবর্তনের কারণে দিতে হয়েছে।

সেতু উদ্বোধনে ৮৯ কোটি টাকা

সরকার পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সারা দেশের মানুষকে নিয়ে উদ্‌যাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। এ জন্য জাতীয়ভাবে প্রকল্প এলাকায় মাওয়া ও জাজিরায় মূল উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়। এর বাইরে প্রতিটি জেলায়ও বড় পর্দায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখানো ও আতশবাজি ফাটানোসহ নানা কর্মসূচি ছিল। পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে এই উদ্‌যাপনের ব্যয়ের পুরোটা বহন করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ভেন্যু তৈরি, সাজসজ্জা ও অনুষ্ঠানের পেছনে খরচ হয়েছে প্রায় ৩০ কোটি টাকা। এই কাজটি করেছে ইভেন্ট টাচ নামে একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান। সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের বড় অনুষ্ঠানগুলো এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে দেখা যায়। চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু টানেলের একটি টিউবের কাজ শেষ হওয়ার পর গত শনিবার যে অনুষ্ঠান হয়, সেটিও ইভেন্ট টাচ করেছে। এর আগে ঢাকা-আশুলিয়া উড়ালসড়কের নির্মাণকাজের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান তাদের মাধ্যমে করা হয়।

প্রকল্পসংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির বাইরে বাকি টাকার বড় অংশই খরচ হয়েছে জেলা পর্যায়ে। একেক জেলা একেক রকম বরাদ্দ পেয়েছে। বেশির ভাগ জেলা ১০-১৫ লাখ টাকা করে বরাদ্দ পেয়েছে। সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ ছিল মাদারীপুর জেলায়, দুই কোটি টাকার বেশি। ওই জেলায় তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠান হয়। এর বাইরে তুলনামূলকভাবে বেশি বরাদ্দ পেয়েছে পদ্মা সেতুর দুই পাড়ের জেলাগুলো এবং ঢাকা জেলা।

পদ্মা সেতু চালু উপলক্ষে সংবাদপত্রে ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হয়। এতে দুই কোটি টাকার মতো খরচ হয়েছে। এ ছাড়া স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশসহ অন্যান্য খাতে কিছু ব্যয় হয়েছে।

পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের আগে সিলেট অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো পদ্মা সেতু উদ্বোধনে বিপুল ব্যয় না করে বন্যার্তদের সহায়তার কথা সরকারকে জোর দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল। সে সময় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ব্যয় নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছিল।

সেতু বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, পদ্মা সেতুর মতো এত জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনের মাধ্যমে কোনো সেতুর উদ্বোধন বাংলাদেশে হয়নি। বেশির ভাগ টাকা খরচ হয়েছে সাজসজ্জা আর আয়োজনে।

বড় তিন ব্যয় যে কারণে

সেতু বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, সবচেয়ে বেশি ব্যয় বাড়ছে সরকারের ভ্যাট ও কর বৃদ্ধির কারণে। বিদেশি ঠিকাদারের ভ্যাট ও কর দেওয়া হয় প্রকল্প থেকে। সরকার বিদেশি ঠিকাদারের কেনা পণ্যের ভ্যাট ও তাদের আয়ের ওপর কর সাড়ে ৪ শতাংশ বৃদ্ধি করেছে। এর ফলে প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে ৬৮৭ কোটি টাকা। মূল সেতু ও নদীশাসনের কাজ করেছে চীনের ঠিকাদার। ব্যবহৃত মালামালের বড় অংশই চীনের।

ঠিকাদার, পরামর্শক ও বিদেশি পণ্য কেনার খরচ ডলারে পরিশোধ করতে হয়েছে। ২০১৪ সালের শেষ দিকে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরুর সময় ডলারের দর ছিল ৭৮ টাকার কিছু বেশি।

নির্মাণকাজের তদারক করছে দক্ষিণ কোরিয়ার কোরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে করপোরেশন। তাদের পরামর্শকদের প্রায় সবাই বিদেশি। ২০১৪ সালের নভেম্বরে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করা হয়। ২০১৮ সালে কাজ শেষ হয়ে যাবে, ধরে নিয়ে তাদের মেয়াদ ধরা হয় ২০১৯ সালের নভেম্বর পর্যন্ত। কিন্তু সময়মতো কাজ শেষ না হওয়ায় পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে এখনো টানতে হচ্ছে। এতে ব্যয় বাড়ছে প্রায় পৌনে ৬০০ কোটি টাকার মতো।

পদ্মা সেতুর ভাটিতে ৪০০ কেভি বিদ্যুতের লাইন যাচ্ছে। এর ভিত্তি তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে। এই কাজে শুরুতে যে ব্যয় ধরা হয়েছিল, তা থেকে আরও প্রায় ৪০০ কোটি টাকার মতো বাড়তি খরচ করতে হয়েছে।

পদ্মা সেতু চালুর পর সেতুতে নানা যন্ত্র বসানো, অপটিক ফাইবার কেবল বসানো, সেতুর পাশে সড়ক সম্প্রসারণ, টোল প্লাজার কাছে বাস বে নির্মাণ, ট্রাকের জন্য আলাদা লেন তৈরি—এসব কাজ প্রকল্প থেকে করা হচ্ছে। এতে ২১৫ কোটি টাকার মতো বাড়তি ব্যয় হবে।

নদীশাসনের কাজে ৮০০ কেজি ওজনের জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে। প্রকল্প কর্তৃপক্ষের দাবি, শুরুতে যে আকারের ব্যাগ ফেলার কথা ছিল, পরে এর আকার বাড়াতে হয়েছে। এই কাজে প্রায় ১৩০ কোটি টাকা বাড়তি খরচ করতে হয়েছে।

ঠিকাদারের মালামাল দিয়ে জাদুঘর

পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি দিয়ে একটি জাদুঘর করার নির্দেশনা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেতু বিভাগ এরপর জাদুঘরে রাখার জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে কিছু মালামাল কিনে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্প অফিস, স্টিলের স্প্যান যেখানে জোড়া লাগানো হয়েছে সেখানকার স্থাপনা, স্প্যানের রং করার কারখানা রয়েছে। এগুলো রেখে দেওয়ার বিনিময়ে ঠিকাদারকে প্রায় ৭০ কোটি টাকা দিতে হবে।

সেতু বিভাগের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তাদের ব্যবহারের পর বেঁচে যাওয়া মালামাল লোহা-লক্কড় হিসেবে বিক্রি করে দেয়। সম্ভবত পদ্মা সেতুর মালামালই প্রথম সরকার কিনে রাখতে চাইছে।

ফেরি চালু রাখতে বিপুল খরচ

পদ্মা সেতু প্রকল্পের নির্মাণকাজের জন্য মাওয়া ও কাঁঠালবাড়িতে ফেরিঘাট স্থানান্তর করতে হয়েছে। মাওয়ায় ফেরিঘাট ভাঙনের মুখে পড়েছে। সেটাও মেরামত করতে হয়েছে। এসব কাজে পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে প্রায় সাড়ে ৩০০ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে।

শিমুলিয়া-মাঝিকান্দি পথে ফেরি চলাচলের পথ ঠিক রাখতে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) খননযন্ত্র নিয়মিত ড্রেজিং করে থাকে। এর বাইরে পদ্মা সেতু থেকেও ড্রেজিং, নদীর তলদেশে জিও ব্যাগ-পাথর ফেলা হয়। নদীতে সমীক্ষা করার জন্য কেনা হয় নৌযান। সব মিলিয়ে এই খাতে ৬০ কোটি টাকার বেশি খরচ করা হয়েছে। অবশ্য এরপরও পদ্মা সেতু নির্মাণের সময় প্রায়ই ফেরি চলাচল বন্ধ থাকত।

প্রকল্প কর্তৃপক্ষ বলছে, ২০১৫ সালে বন্যায় মাওয়া প্রান্তে নদীর তলদেশে মাটি সরে গিয়ে বিপুল গর্তের সৃষ্টি হয়। একই ঘটনা ঘটে ২০১৭, ২০১৯ ও ২০২১ সালে। এই গর্ত ভরাটে শ খানেক কোটি টাকা বাড়তি খরচ হয়েছে।

এ ছাড়া করোনা মহামারির সময় দুই পাড়ে নির্মাণ করা হয় দুটি অস্থায়ী হাসপাতাল। এ কাজে ব্যয় হয়েছে প্রায় চার কোটি টাকা। সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, করোনার সময় যে ধরনের সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে, সে তুলনায় খরচ বেশি হয়নি।

সেতুর পাইল বসাতে গিয়ে মাটির নিচে নরম মাটি পাওয়া যায়। এ জন্য নকশা সংশোধন করে পাইলের গভীরতা বাড়াতে হয়। এ কাজে ৫০ কোটি টাকার কাছাকাছি বাড়তি খরচ হয়েছে।

এ ছাড়া ২০২০ সালে বন্যায় মাওয়ায় পদ্মা সেতুর নির্মাণমাঠের একাংশ ভেসে যায়। এ সময় সেতুর জন্য তৈরি করা ১২৬টি কংক্রিট স্ল্যাব ও ১৯২টি রেলওয়ের স্ল্যাব (স্ট্রিঞ্জার) স্রোতের সঙ্গে ভেসে যায়। সেগুলো পরে তৈরি করতে হয়, যা ব্যয়ের সঙ্গে যোগ হয়েছে। এ ছাড়া টুকটাক অবকাঠামো নির্মাণ, পদ্মা সেতু জাদুঘরের নকশা প্রণয়ন ও তা যাচাই করতে বাড়তি খরচ হয়েছে, যা এখন চূড়ান্ত সংশোধনে যুক্ত হচ্ছে।

পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য আইনুন নিশাত প্রথম আলোকে বলেন, বড় প্রকল্পে নানা ধরনের ব্যয় থাকে, যা আগে থেকে ধারণা করা যায় না। প্রকল্পের কাজ চলমান। মাঝপথে কারিগরি নানা জটিলতা এসেছে। এ কারণে ব্যয় বাড়তেই পারে। তবে প্রতিটি ব্যয় যেন যৌক্তিক হয়, সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের।