Thank you for trying Sticky AMP!!

রাজধানীর বেইলি রোডে গ্রিন কোজি কটেজ নামের ভবনটিতে গত ২৯ ফেব্রুয়ারি আগুনে ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে

দেশে রেস্তোরাঁর সংখ্যা কত, ব্যবসা কত টাকার, জানেন কি

  • রেস্তোরাঁয় কাজ করেন প্রায় ২০ লাখ ৭২ হাজার মানুষ। 

  • বছরে বেতন, মজুরি ও ভাতা ৩১ হাজার ৪২৯ কোটি টাকা। 

  • মোট কেনাবেচা প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা। 

রাজধানীর মোড়ে মোড়ে এখন রেস্তোরাঁ। জেলা ও উপজেলা শহরেও রেস্তোরাঁ বাড়ছে। বিনিয়োগ করছেন তরুণ উদ্যোক্তারা।

রেস্তোরাঁগুলোতে গ্রাহকও বাড়ছে। পরিবার নিয়ে, স্বজনদের নিয়ে, বন্ধুদের নিয়ে মানুষ রেস্তোরাঁয় খেতে যাচ্ছেন। ফলে রেস্তোরাঁগুলো দেশের অর্থনীতিতে বড় অঙ্কের মূল্য যোগ করছে, কর্মসংস্থান তৈরি করছে মানুষের।

এক দশকে রেস্তোরাঁ ৫৮% বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৩৬ হাজারে। নিরাপদ করতে সমন্বিত উদ্যোগের তাগিদ। 

সমস্যা হলো, অনেক রেস্তোরাঁ হয়েছে আবাসিক ভবনে। অনেক রেস্তোরাঁ হয়েছে অফিস হিসেবে ব্যবহারের অনুমোদন নেওয়া ভবনে। অনেক রেস্তোরাঁর নানা ধরনের সনদ ও অনুমোদনে ঘাটতি আছে। স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ ও মানসম্পন্ন খাবার সরবরাহের ক্ষেত্রেও ঘাটতি আছে অনেক রেস্তোরাঁয়।

রাজধানীর বেইলি রোডে গ্রিন কোজি কটেজ নামের ভবনটিতে গত ২৯ ফেব্রুয়ারি আগুনে ৪৬ জনের মৃত্যুর পর রেস্তোরাঁর অনুমোদন ও অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থার ঘাটতি সামনে আসে। ওই ভবনে আটটি রেস্তোরাঁ ছিল, কিন্তু ভবনটিতে রেস্তোরাঁ প্রতিষ্ঠার কোনো অনুমোদনই ছিল না।

আগুনে মারা যাওয়া ব্যক্তিরা কেউ পরিবার নিয়ে, কেউ স্বজনদের নিয়ে, কেউ বন্ধুদের সঙ্গে খেতে গিয়েছিলেন। কেউ কেউ ভবনে থাকা রেস্তোরাঁগুলোতে কাজ করে সংসার চালাতেন।

রেস্তোরাঁশিল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে কীভাবে পুরো ব্যবস্থা নিরাপদ করা যায়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
আদিল মুহাম্মদ খান, সভাপতি, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স

বেইলি রোডের আগুনের পর রাজধানীজুড়ে অভিযান শুরু করে সরকারের পাঁচ সংস্থা—রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ও উত্তর সিটি করপোরেশন, ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। সংস্থাগুলোর ‘বিচ্ছিন্ন’ অভিযানে রেস্তোরাঁ ভেঙে ফেলা, সিলগালা করে দেওয়া, কর্মীদের গ্রেপ্তার ও জরিমানার ঘটনা ঘটে। এর বাইরে সারা বছরই রেস্তোরাঁয় অভিযান চালায় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষসহ বিভিন্ন সংস্থা। রেস্তোরাঁর মালিকদের অভিযোগ, সারা বছর সংস্থাগুলোর অসাধু কর্মকর্তাদের ‘ম্যানেজ’ করেই তাঁদের চলতে হয়।

Also Read: ‘রেস্তোরাঁর অনুমতি কারা দিল, তাঁদের গ্রেপ্তার করুন’

নগর–পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতিরা বলছেন, রেস্তোরাঁয় উদ্যোক্তাদের কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে। এতে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। রেস্তোরাঁগুলোকে নিয়মের মধ্যে আনা দরকার। কিন্তু বিচ্ছিন্ন অভিযানে কোনো সমাধান আসবে না।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি আদিল মুহাম্মদ খান প্রথম আলোকে বলেন, এক দিনে সব অনিয়ম বন্ধ করা যাবে না। রেস্তোরাঁশিল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে কীভাবে পুরো ব্যবস্থা নিরাপদ করা যায়, তা নিশ্চিত করতে হবে।

রেস্তোরাঁগুলো বছরে কত টাকার কেনাবেচা করে, তার হিসাবও উঠে এসেছে বিবিএসের জরিপে। বলা হয়েছে, এর পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা (গ্রস আউটপুট), যা এক দশক আগের তুলনায় তিন গুণের বেশি।

রেস্তোরাঁ কত

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ২০২১ সালে দেশের রেস্তোরাঁ খাত নিয়ে একটি জরিপ করে। মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) এ খাতের অবদান জানতে জরিপটি করা হয়।

জরিপের ফলাফল অনুযায়ী, ২০২১ সালে দেশে মোট হোটেল ও রেস্তোরাঁ ছিল ৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৭৪টি, যা ২০০৯-১০ অর্থবছরের চেয়ে ৫৮ শতাংশ বেশি। সরকারি সংস্থার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৮৫২টি। বাকি সব ব্যক্তি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন।

Also Read: রেস্তোরাঁয় ভরা ঢাকার এসব ভবন আসলে ‘টাইম বোমা’: স্থপতি ইকবাল হাবিব

বিগত এক দশকে বহু তরুণ রেস্তোরাঁ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে উদ্যোক্তা হয়েছেন। তাঁদের একজন ঢাকার প্রনীল শামসাদ জাদিদ। ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে তিনি চাকরি করতে যাননি। বন্ধুদের মতো বিদেশেও যাননি; বরং পরিবারের কাছ থেকে মূলধন নিয়ে রেস্তোরাঁ করেছেন। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় তিনটি ব্র্যান্ড নামের অধীনে তাঁর ১১টি রেস্তোরাঁ রয়েছে। বেইলি রোডে আগুনের পর অভিযানে তাঁর দুটি রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেওয়া হয়।

সন্তানেরা এখন বিভিন্ন এলাকার রেস্টুরেন্টগুলোতে যাওয়ার মধ্যেই বিনোদন পায়।
শরীফ আল নূর, চিকিৎসক

প্রনীল প্রথম আলোকে বলেন, ‘রেস্তোরাঁ করার সময় কেউ বলেনি এত অনুমোদন লাগবে। আমরা জানতাম ট্রেড লাইসেন্স হলেই হয়। এখন ১০-১১টি সনদের কথা বলা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, এখন যে আচরণ করা হচ্ছে, তা অমানবিক। মনে হচ্ছে দেশে না থেকে বিদেশে চলে গেলেই ভালো হতো।

বিনিয়োগ বাড়ায় রেস্তোরাঁয় কর্মসংস্থানও দ্বিগুণ হয়েছে। বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী, রেস্তোরাঁ খাতে যুক্ত ব্যক্তির সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ ৭২ হাজার। এক দশক আগে সংখ্যাটি ছিল ৯ লাখের মতো। শুধু পুরুষ নন, রেস্তোরাঁগুলোতে এক লাখের বেশি নারীও কাজ করেন। কর্মীরা রেস্তোরাঁগুলো থেকে বছরে ৩১ হাজার ৪২৯ কোটি টাকা পান বেতন, মজুরি ও অন্যান্য ভাতা পান। একেকজন কর্মী বছরে গড়ে পান ১ লাখ ৫২ হাজার টাকা।

বেইলি রোডে আগুনের পর পাঁচ সংস্থার শুরু হওয়া অভিযান এখন কিছুটা স্তিমিত। রাজউক সূত্রে জানা গেছে, তারা সমন্বিতভাবে অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করছে।

রাজধানীতে সাম্প্রতিক অভিযানে বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি রেস্তোরাঁয় ব্যবস্থাপক পদে চাকরি করতেন মো. উজ্জ্বল গাজী। বেতন ছিল মাসে ২৫ হাজার টাকা। তাঁর আয়েই পরিবার চলত। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘হঠাৎ চাকরিটি অনিশ্চয়তায় পড়েছে। ঈদের পর বিয়ে করার কথা ছিল। পরিস্থিতি দেখে বিয়েও পিছিয়ে দিয়েছি।’ তিনি বলেন, তাঁদের রেস্তোরাঁয় ২৫ জন কাজ করতেন। এখন সবাই অনিশ্চয়তায়। পবিত্র রমজান মাস চলছে, সামনে ঈদুল ফিতর। পরিবার নিয়ে সবাই বিপদে আছেন।

রেস্তোরাঁগুলো বছরে কত টাকার কেনাবেচা করে, তার হিসাবও উঠে এসেছে বিবিএসের জরিপে। বলা হয়েছে, এর পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা (গ্রস আউটপুট), যা এক দশক আগের তুলনায় তিন গুণের বেশি। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) রেস্তোরাঁগুলো প্রায় ৩৯ হাজার কোটি টাকা মূল্য সংযোজন করেছে।

বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান প্রথম আলোকে বলেন, রেস্তোরাঁ ব্যবসাকে একটা একক সংস্থার অধীনে নেওয়া এবং নিবন্ধন সহজ করা জরুরি। বিচ্ছিন্নভাবে অভিযান না চালিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ রেস্তোরাঁকে নিরাপদ করার উদ্যোগ নিতে হবে।

বেইলি রোডে আগুনের পর পাঁচ সংস্থার শুরু হওয়া অভিযান এখন কিছুটা স্তিমিত। রাজউক সূত্রে জানা গেছে, তারা সমন্বিতভাবে অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করছে।

সরকার পোশাক খাতের মতো রেস্তোরাঁ খাতকে নিরাপদ করতে সংস্কার করার উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানান রাজউকের প্রধান নগর–পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, চাহিদা আছে বলেই রেস্তোরাঁ ব্যবসার প্রসার হয়েছে। এর সঙ্গে অর্থনীতি, কর্মসংস্থানের বিষয় জড়িত। তাই এগুলোকে কীভাবে অগ্নিনিরাপদ করা যায়, সে বিষয়ে একটি নীতিমালা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করেই এই নীতিমালা বাস্তবায়ন করা হবে।

বৈচিত্র্যময় খাবার, বিনোদন, আড্ডা

রাজধানীতে গণপরিসরের বড় অভাব। কারও কারও ক্ষেত্রে রেস্তোরাঁয় খেতে যাওয়াই এখন বিনোদন। এই শ্রেণির মানুষের আয়ও বেড়েছে। তাঁরা নতুন নতুন খাবারের স্বাদও নিতে চান। রেস্তোরাঁগুলোও সেই বৈচিত্র্য নিয়ে এসেছে। চীনা, ভারতীয়, থাই, জাপানি, কোরীয়, আরবীয়, তুর্কি—নানা স্বাদের খাবার এখন ঢাকায়ই পাওয়া যায়। শিশুদের খেলার জন্য বড় রেস্তোরাঁগুলোতে এখন ‘কিডস জোন’ রাখা হচ্ছে। বড়দের জন্য কফিশপগুলো হয়ে ওঠে আড্ডার জায়গা।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ১০টি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়, যাঁদের ৫ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুসন্তান রয়েছে। অভিভাবকেরা বলছেন, তাঁদের শিশুসন্তানেরা মূলত ঘরবন্দী থাকে। খেলার মতো মাঠ নেই। তাই সাপ্তাহিক ও বিশেষ ছুটির দিনগুলোতে শিশুদের তাঁরা রেস্তোরাঁয় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন।

রাজধানীর শেখেরটেকের রফিক হাউজিংয়ের বাসিন্দা আহিয়ান তানজিম নূরের বাবা শরীফ আল নূর পেশায় চিকিৎসক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সন্তানেরা এখন বিভিন্ন এলাকার রেস্টুরেন্টগুলোতে যাওয়ার মধ্যেই বিনোদন পায়।

বেইলি রোডে আগুনের পর পাঁচ সংস্থার শুরু হওয়া অভিযান এখন কিছুটা স্তিমিত। রাজউক সূত্রে জানা গেছে, তারা সমন্বিতভাবে অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করছে।
বাপা সহসভাপতি ও স্থপতি ইকবাল হাবিব

করণীয় কী

রেস্তোরাঁর অগ্নিনিরাপত্তা সমস্যা যেমন রয়েছে, তেমনি রেস্তোরাঁ যেসব ভবনে অবস্থিত, সেই ভবন ও বিপণিবিতানেও ঘাটতি আছে। সবক্ষেত্রেই অগ্নিনিরাপত্তা জোরদার করা জরুরি।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সহসভাপতি ও স্থপতি ইকবাল হাবিব মনে করেন, আগামী তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে নগরে অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো চিহ্নিত করা এবং সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ভবন নির্মাণ অনুমোদন এবং ব্যবসায়িক লাইসেন্স অনুমোদনকারী সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষের সমন্বয়ে ‘টাস্কফোর্স’ গঠন করতে হবে। একই সঙ্গে চিহ্নিত ‘অতি বিপজ্জনক’ ও ‘বিপজ্জনক’ ভবনগুলোর হালনাগাদ তালিকা নিয়মিত ওয়েবসাইটের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ভবনের সামনে দৃশ্যমানভাবে প্রকাশ করতে হবে।