Thank you for trying Sticky AMP!!

প্রথম পরিকল্পনা কমিশনে যত অভিজ্ঞতা

প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক নুরুল ইসলাম আর নেই। সুদীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি শিক্ষকতা করেছেন, জড়িত ছিলেন বহু ধরনের গবেষণায়। ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) একটি বিশেষ প্রকাশনায় তাঁর ইংরেজি এই আত্মস্মৃতি ছাপা হয়েছিল। ত্রৈমাসিক প্রতিচিন্তায় ২০১৮ সালের ১৭ মে সংখ্যায় এর অনুবাদ প্রকাশিত হয়। অনুবাদ করেছেন খলিলউল্লাহ্। আজ লেখাটির শেষ কিস্তি প্রকাশিত হলো—

নুরুল ইসলাম

আত্মস্মৃতি

তখন খাদ্যে ভর্তুকি সরকারি বিতরণব্যবস্থার মাধ্যমে দেশের চারটি বড় শহরের কেন্দ্রে সবাইকে দেওয়া হতো, যেখানে পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর সব কর্মী, নিম্ন আয়ের সরকারি কর্মচারী এবং দেশের সব শিল্পশ্রমিক অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।

ভর্তুকির সবচেয়ে বড় বোঝাটা ছিল শেষোক্ত দুই শ্রেণির জন্য, বিশেষ করে শিল্পশ্রমিকদের জন্য। তাঁরা ট্রেড ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন এবং ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ভর্তুকি কমানোর কোনো উদ্যোগ নিলে ট্রেড ইউনিয়নগুলো যদি তা মেনে না নিত এবং সামষ্টিক ব্যবস্থা গ্রহণ করত, তাহলে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হতে পারত।

ভর্তুকি-ব্যবস্থায় গলদ ছিল; কারণ, ভর্তুকির খাদ্য অন্যদের কাছে বিক্রি করা হতো এবং সরকারি বিতরণব্যবস্থার খরচও বেশি ছিল। সুতরাং ভর্তুকির পরিবর্তে শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি বাড়ালে কার্যকারিতা বাড়ত। এর ফলে বিনা বাধায় শ্রমিকেরা তাঁদের প্রয়োজনীয় খাদ্য অধিকার নিশ্চিত করতে পারতেন। এতে খাদ্য বিতরণের খরচ এড়িয়ে সরকারের সম্পদ রক্ষা পেত এবং ভর্তুকির জন্য যারা যোগ্য নয়, তাদের কাছে খাদ্য বিক্রি বন্ধ হতো।

Also Read: অর্থনীতিবিদ হিসেবে যে দুই শিক্ষা নিয়েছিলাম

শিল্পশ্রমিকেরা কয়েকটি যুক্তিতে এই প্রস্তাব নাকচ করে দেন। প্রথমত, খাদ্যে ভর্তুকি বন্ধের বিপরীতে প্রকৃত মজুরি বাড়িয়ে সামঞ্জস্যতা আনার ক্ষতিপূরক পদ্ধতিটি তাঁরা বুঝতে পারেননি। দ্বিতীয়ত, সব শিল্পমালিক যে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবেন, সে ব্যাপারে তাঁরা নিশ্চিত ছিলেন না এবং এতে মালিকদের সঙ্গে দর-কষাকষি করতে হতো।

যদি অবাধ্য মালিকেরা তা বাস্তবায়ন না করেন, তাহলে তাঁদের সঙ্গে শ্রমিকদের সংঘর্ষ বেধে যেতে পারত। তৃতীয়ত, তাঁরা নিশ্চিত ছিলেন না যে ভবিষ্যতে অন্য কোনো সরকার ক্ষমতায় এলে এই ক্ষতিপূরকপদ্ধতি অনুসরণ করবে কি না এবং যদি করেও তাহলে সেটা প্রয়োজনীয় মাত্রায় করবে কি না। বেশ কয়েক বছর ধরে নির্দিষ্ট পরিমাণের রেশন খাদ্যব্যবস্থা চলে আসায় সংশ্লিষ্ট সবাই এর সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠেছিল।

যেহেতু এই প্রস্তাব শিল্পশ্রমিকেরা বাতিল করে দিয়েছিলেন এবং বাস্তবায়ন করা যাচ্ছিল না, তাই নিম্ন আয়ের সরকারি কর্মচারীদের ক্ষেত্রেও তা আর প্রযোজ্য ছিল না। উপরিউক্ত দুটি উদাহরণে দেখা যায়, কীভাবে রাজনৈতিক অর্থনীতি বিবেচনা বা রাজনৈতিক বাস্তবায়নযোগ্যতার অভাবে পেশাগতভাবে সঠিক অর্থনৈতিক নীতি প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়।

Also Read: আমার অর্থনীতিবিদ হয়ে ওঠা

অর্থনৈতিক নীতিপত্র প্রণয়ন

সামষ্টিক অর্থনীতি এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য-তত্ত্ব ও নীতিতে বিশেষায়িত অর্থনীতিবিদ হিসেবে আমি ইনপুট-আউটপুট বিশ্লেষণনির্ভর সামষ্টিক অর্থনীতি মডেলে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতাম, যা বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো গ্রহণ করা হয়েছিল। এ ছাড়া সহকর্মী এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় আমি অর্থনৈতিক নীতিপত্র প্রণয়ন করার ব্যাপারে সুপরিচিত ছিলাম। যা হোক, পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান হিসেবে আমাকে মন্ত্রিপরিষদ এবং উন্নয়ন কর্মসূচি, অর্থনৈতিক নীতি অথবা সম্পদ বরাদ্দ বিষয়ে প্রভাব রয়েছে, এমন বিভিন্ন কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। যার ফলে আমাকে মন্ত্রিপরিষদের আলাপ-আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে হতো, যেখানে বিভিন্ন খাতভিত্তিক বিষয়ে আলোচনা হতো।

আলোচনার বিষয়গুলোর মধ্যে ছিল কৃষি খাতে স্বল্প উত্তোলন সেচ, গভীর নলকূপ এবং অগভীর নলকূপের মধ্যে বাছাইকরণ অথবা সার এবং সেচ প্রকল্পে বিনিয়োগের মধ্যে সঠিক ভারসাম্য রক্ষা, অথবা গ্রামীণ ঋণ এবং ইনপুটের জোগানের মধ্যে সম্পদের বরাদ্দ প্রদান। বিভিন্ন ধরনের মাটির পরিপোষক ও রাসায়নিক অথবা কৃষি সম্প্রসারণ ব্যবস্থার সঙ্গে আমাকে পরিচিত হতে হয়েছিল। প্রথমবারের মতো আমাকে প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চতর শিক্ষা স্তরের মধ্যে আন্তসম্পর্কের সঙ্গে পরিচিত হতে হয়েছিল, যেখানে এক স্তরের আউটপুট অন্য স্তরের ইনপুট। যেমন প্রত্যেক নিম্নস্তরের আউটপুট তার ওপরের স্তরের জন্য ইনপুট। বিভিন্ন স্তরের ইনপুট ও আউটপুটের মধ্যে সম্পদ বরাদ্দের জন্য সঠিক অনুপাতের ভারসাম্য নির্ণয় করা আমার শিক্ষার অংশ ছিল।

পরিবার পরিকল্পনা খাত ছিল আরেকটি উদাহরণ। পরিবারের নারী সদস্যদের কাজের চাপ বিষয়ে এবং নারীদের উদ্বুদ্ধ করার মাধ্যমে সর্বোচ্চ ফলাফল বের করে আনার আলোচনার কথা আমার মনে পড়ে। আমার এখনো সেই নীতির কথা মনে আছে যে কোনো সন্তানের জন্মের ঠিক আগে, জন্মের সময়ে বা জন্মের ঠিক পরে নারীরা পরিবার পরিকল্পনাবিষয়ক বার্তা গ্রহণের জন্য সবচেয়ে বেশি গ্রহণক্ষম থাকেন। প্রথমবারের মতো আমি বুঝেছিলাম পুষ্টি একটি বহুমাত্রিক বিষয়, যেখানে শিক্ষা, কৃষি, স্বাস্থ্য ইত্যাদি সবই আছে। পুষ্টির মাত্রা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মসূচি সমন্বয় ও একীভূত করার পদ্ধতি কী হবে, সে বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া ছিল আমার জন্য চ্যালেঞ্জ। প্রকৃতপক্ষে আমাদের পরামর্শে আমরা বলেছিলাম যে পরিকল্পনা কমিশনে পুষ্টি বিষয়ে বিভিন্ন খাতের সমন্বয়ের জন্য একটি আলাদা ইউনিট থাকা প্রয়োজন।

বিদেশি সাহায্য নিয়ে দর-কষাকষি

বিদেশি সাহায্য বিষয়ে দর-কষাকষি করা ছিল পরিকল্পনা কমিশনের দায়িত্ব। সাহায্যের পরিমাণ ও ধরন নিয়ে দর-কষাকষি করতে হতো। এটা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি ও পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রয়োজন ছিল। বিদেশি সাহায্যপ্রাপ্ত প্রকল্পগুলোর বিস্তারিত বিষয়ে কমিশনের সদস্যদের পাশাপাশি প্রাসঙ্গিক খাতের মন্ত্রণালয়গুলোর কর্মকর্তাদেরও দায়িত্ব ছিল। আমি সহযোগী নীতি এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিষয়ে যুক্ত ছিলাম। এটা ছিল বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কার্যক্ষেত্র। প্রকল্প সাহায্য ছাড়া অন্যান্য সাহায্য যেমন পণ্য সাহায্য এবং অন্যান্য কাঠামোগত সমন্বয়সাধন বা ব্যালান্স অব পেমেন্ট ঋণে অনেক বেশি নীতি উপাদান ছিল। বিনিময় হারের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ দর-কষাকষির কথা আমার মনে পড়ে।

বাহ্যিক লেনদেনের ভারসাম্যহীনতা মেটানোর পদ্ধতি হিসেবে পুঁজি নিয়ন্ত্রণ বা বাণিজ্য ও বিনিময় নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে দাতারা সব সময়ই নারাজ ছিল। স্বাধীনতার এক বছর পর থেকেই বিষয়টি নিয়ে দর-কষাকষি চলছিল, যা ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের ওপর বিশ্বব্যাংকের করা প্রতিবেদনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়। আমরা বিনিময় হার সমন্বয়সাধনের প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে সাধারণত একমত ছিলাম, কিন্তু মুদ্রা অবমূল্যায়নের মাত্রা ও এর সময় এবং ব্যালান্স অব পেমেন্ট সাহায্যের নিশ্চয়তা ও এই সাহায্যের পরিমাণ বিষয়ে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে মতপার্থক্য দেখা দেয়।

খুবই শক্ত এই দর-কষাকষিতে আমরা ঐকান্তিকভাবে প্রস্তুতিপর্বের কাজ করেছিলাম এবং এই কাজে আমরা অবশ্যই ভালো পেশাদারত্বের পরিচয় দিয়েছিলাম। সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে আমরা বিনিময় হার সমন্বয়ের পরিপূরক হিসেবে আর্থিক ও রাজস্ব নীতির ভূমিকা তুলে ধরেছিলাম। বস্তুত আমরা রাজস্ব ও আর্থিক খাতে ব্যবস্থা নিয়েছিলাম। যেমন দেশের ভেতরে মাত্রাধিক চাহিদা ও মুদ্রাস্ফীতির চাপ কমিয়ে ব্যালান্স অব পেমেন্টের ওপর চাপ কমানোর উদ্দেশ্যে কর বাড়ানো এবং সরকারি ব্যয় কমিয়ে এনেছিলাম।

মুদ্রা অবমূল্যায়ন নিয়ে আলোচনা

মুদ্রা অবমূল্যায়নের প্রাক্কালে এ বিষয়ে আমাদের প্রচেষ্টার স্বীকৃতিস্বরূপ কিছু সম্পদপ্রবাহ বা আর্থিক সহায়তা দিতে আমরা দাতাদের অনুরোধ করেছিলাম। আমরা বলেছিলাম, যেহেতু মুদ্রা অবমূল্যায়নের আশু প্রভাব হবে আমদানিমূল্যের বৃদ্ধি, তাই কিছু সাহায্যের প্রবাহ থাকলে আমরা আমদানি বৃদ্ধি করে এ ধরনের প্রভাব ঠেকাতে পারব। অধিকন্তু খাদ্য আমদানিমূল্য বৃদ্ধি এবং তার ফলে অভ্যন্তরীণ আমদানিমূল্য বৃদ্ধি বিষয়ে আমরা উদ্বিগ্ন ছিলাম। আমরা অবমূল্যায়ন করার আগে পরবর্তী ফসল উত্পাদন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চেয়েছিলাম।

কারণ, প্রত্যাশিত ভালো ফসল উত্পাদিত হলে মুদ্রা অবমূল্যায়নের কারণে আমদানি মূল্য উচ্চ হারে বৃদ্ধি পেলেও তার প্রভাব ঠেকানো যাবে। ইতিমধ্যে খাদ্য আমদানি মূল্য বাড়তে শুরু করেছিল এবং অভ্যন্তরীণ মূল্যে ঊর্ধ্বগামী চাপ ফেলছিল। এই পর্যায়ে অবমূল্যায়ন মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি করত। যেকোনো ধরনের সাহায্যের জন্য দাতারা অবমূল্যায়নকে পূর্বশর্ত বলে পীড়াপীড়ি করছিল এবং কোনো সাহায্যের প্রবাহ শুরু করার ক্ষেত্রে রাজস্ব ও আর্থিক পদক্ষেপকে তারা ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করছিল না। পরবর্তী ফসল উত্পাদন পর্যন্ত অবমূল্যায়ন না করার ব্যাপারটি আইএমএফ মেনে নিয়েছিল।

সৌভাগ্যক্রমে আইএমএফের বিনিময় বিধিনিষেধ অধিদপ্তরের উপপরিচালক, যিনি বিনিময় হার সমন্বয় আলোচনার প্রধান এবং এশিয়া বিভাগের পরিচালক হার্ভার্ডে থাকাবস্থা থেকেই আমার পরিচিত ছিলেন। হার্ভার্ডে তাঁরা আমার সিনিয়র ছিলেন। আলোচনার জন্য উপপরিচালক ঢাকায় এসেছিলেন এবং বিশ্বব্যাংকও তাঁদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, তবে আইএমএফের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত ছিল। মুদ্রা অবমূল্যায়ন করার সময়ের ব্যাপারটি মেনে নিলেও অন্য দুটি বিষয়ে তারা অনড় ছিল। অবশ্য অবমূল্যায়নের মাত্রার ব্যাপারে অনড় থাকার তেমন একটা সুযোগ তাদের ছিল না।

আইএমএফের কর্মকর্তারা একমত হয়েছিলেন যে অবমূল্যায়নের মাত্রার বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট গাণিতিক নমুনা ছিল না। বিনিময় হার পরিবর্তনের ক্ষেত্রে আমদানি-রপ্তানির চাহিদা-জোগান প্রতিক্রিয়ার আনুমানিক হিসাব এবং সহায়ক পদক্ষেপগুলোর সম্মিলিত চাহিদার প্রভাবের ওপর ভিত্তি করে এর মাত্রা নির্ধারণ করা হতো। তিনি আমাদের প্রায়োগিক যুক্তি মেনে নিয়ে বললেন যে নির্দিষ্ট অবমূল্যায়নের মাত্রা প্রসঙ্গে চুক্তির বিষয়টি তাদের ‘বিবেচনা’এবং আমদানি-রপ্তানি খাতের সাধারণ বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে করা হয়েছিল। শক্তিশালী দাতা ও দরিদ্র গ্রহীতার মধ্যে অসম সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে দাতার এই বিবেচনার ওজন অনেক।

ব্যক্তিগতভাবে তিনি আমাকে বললেন যে হয়তো হার্ভার্ডের সেমিনারে তিনি আমার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত হতেন, কিন্তু ঠিক সেটাই তিনি আইএমএফের কর্মকর্তা হিসেবে করতে পারতেন না। তিনি একজন ভারতীয় হলেও আদি বসতি ছিল বাংলাদেশে। তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার আকুল আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেন।

কিন্তু সেটা বিনিময় হার বিষয়ে কোনো আলোচনা করার জন্য নয়। তিনি শুধু প্রধানমন্ত্রীকে শ্রদ্ধা জানাতে চেয়েছিলেন, যিনি দুরূহ প্রতিকূলতা পেরিয়ে একটি স্বাধীন জাতির নির্মাতা হয়েছিলেন। আমি তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিয়ে যাই। প্রধানমন্ত্রীও তাঁকে যথারীতি মন্ত্রমুগ্ধ করেছিলেন। তিনি পরে আমাকে বলেছিলেন যে এই মিটিংয়ের প্রতিবেদন যখন তিনি তাঁর ওয়াশিংটন কার্যালয়ে পাঠান, ঊর্ধ্বতনদের চোখে আইএমএফের কর্মকর্তা হিসেবে তাঁর যোগ্যতা কয়েক ধাপ বেড়ে যায়।

যখন ১৯৭৪ সালের শেষে খাদ্য সাহায্যের প্রবাহ বৃদ্ধি পায় এবং ১৯৭৫ সালের শুরুতে ফসল উত্পাদন ভালো হয়, তখন বাংলাদেশ মুদ্রা অবমূল্যায়ন ঘটায়, যাতে অবমূল্যায়ন-পরবর্তী মুদ্রাস্ফীতি সহনীয় থাকে। তবে অবমূল্যায়নের বাইরেও আমদানি-রপ্তানির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ভিন্ন ভিন্ন আমদানি কর ও রপ্তানি প্রণোদনা চালু করতে হয়েছিল।

কমিশন থেকে এফএওতে

পরিকল্পনা কমিশনে থাকাকালে আমি একটি দেশের পূর্ণাঙ্গ ও সার্বিক অর্থনৈতিক নীতি বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করেছি এবং সামাজিক ও অর্থনীতির বাইরেও অন্যান্য বিষয়ে ভাসা-ভাসা জ্ঞান লাভ করেছিলাম। এফএওর সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিভাগের সহকারী মহাপরিচালক হিসেবে আমাকে শুধু একটি খাত নিয়েই কাজ করতে হয়েছিল যেমন খাদ্য ও কৃষি খাত, তবে এর বিভিন্ন উপখাতের ওপর বিস্তর কাজ করতে হয়েছিল।

এর মধ্যে ছিল খাদ্য ও কৃষি খাতের আন্তর্জাতিক দিক এবং জাতীয় খাদ্য ও কৃষিনীতির আন্তর্দেশীয় তুলনা। এ ছাড়া আমাকে আন্তর্জাতিক ও জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর সঙ্গে বিস্তর যৌথ আলোচনা ও সহযোগিতামূলক প্রকল্পে একসঙ্গে কাজ করতে হতো। অধিকন্তু আমাকে রোম শহরে এফএওর সদস্যরাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে কাজ করতে হতো।

১৯৭০-এর দশকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে কৃষির আন্তর্জাতিক দিক বিবেচনায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণাত্মক ও ধারণাগত যে বিষয়টির মুখোমুখি হতে হয়েছে তা হলো বিশ্ব খাদ্যনিরাপত্তা। আমি বৈশ্বিক খাদ্য ও কৃষিনীতি-বিষয়ক বিশ্লেষণে এবং কৃষিনীতি বিষয়ে আন্তর্দেশীয় তুলনায় যুক্ত ছিলাম, যেমন আউটপুট ও ইনপুটের জন্য বাজারে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ। এ ছাড়া আমি ও আমার সহকর্মীরা বিশ্ব খাদ্যনিরাপত্তার ধারণা তৈরি করি, যেখানে খাদ্যনিরাপত্তার সব গুরুত্বপূর্ণ দিককে অন্তর্ভুক্ত করেছিলাম।

এগুলো ছিল ক. ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য জোগানের নিশ্চয়তা; খ. খাদ্য জোগানের ক্ষেত্রে একটি বছরে সব মৌসুমে এবং আন্তমৌসুম ও আন্তবর্ষীয় আবহাওয়াকেন্দ্রিক বা নীতিকেন্দ্রিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বছরজুড়ে জোগানের স্থিতিশীলতা; এবং গ. স্বাস্থ্য ও পর্যাপ্ত পুষ্টি নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় মৌলিক খাদ্যে সব মানুষের অভিগম্যতা নিশ্চিত করা। খাদ্যনিরাপত্তার ওপরের সব কটি দিকেরই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিক ছিল। (সংক্ষিপ্ত)