Thank you for trying Sticky AMP!!

অগ্নিনিরাপত্তা নিয়ে এখনো ‘হেলাফেলা’

বন্দরকেন্দ্রিক ২৪টি বেসরকারি কনটেইনার ডিপোর মধ্যে অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে মাত্র ৫টি।

বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণ

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের এক বছর পরও অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনা (ফায়ার সেফটি প্ল্যান) বাস্তবায়ন নিয়ে চলছে ‘হেলাফেলা’। চট্টগ্রাম বন্দরকেন্দ্রিক ২৪টি বেসরকারি কনটেইনার ডিপোর মধ্যে অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে মাত্র ৫টি। ফায়ার সার্ভিসের গত এপ্রিলের জরিপে উঠে এসেছে এই চিত্র। তাদের তথ্য অনুযায়ী, এখনো ৭৯ ভাগ ডিপো অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে।

মূলত গত বছরের ৪ জুন সীতকুণ্ডের কুমিরায় বিএম ডিপোতে আগুন থেকে বিস্ফোরণের পর বেরিয়ে আসে অগ্নিনিরাপত্তার ঘাটতির বিষয়টি। সেই দুর্ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের ১৩ কর্মীসহ ৫১ জনের প্রাণহানি ঘটে। আহত হন দেড় শতাধিক। অগ্নিনির্বাপণ করতে সময় লেগেছিল প্রায় চার দিন। বিএম ডিপোতে পর্যাপ্ত অগ্নিনিরাপত্তার ব্যবস্থা না থাকায় প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয় বলে জানায় ফায়ার সার্ভিস।

বিএম ডিপোর ঘটনা অসতর্কতার কারণে হয়েছে। নতুন করে বড় দুর্ঘটনা এড়াতে তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন জরুরি। হেলাফেলা করলে আরও বড় বিপদ ঘটবে।
সুমন বড়ুয়া, সহযোগী অধ্যাপক, ফলিত রসায়ন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

অগ্নিঝুঁকি কমাতে ডিপোগুলো কমবেশি কাজ করে যাচ্ছে বলে দাবি করেন বেসরকারি কনটেইনার ডিপোমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশনের (বিকডা) সভাপতি নুরুল কাইয়ুম খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিএম ডিপোর ঘটনা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। নিজেদের জন্যই ডিপোর অগ্নিনিরাপত্তা জরুরি।

এখন পাঁচটি ডিপোর ফায়ার লাইসেন্স রয়েছে। দুর্ঘটনার আগেও দুটি প্রতিষ্ঠানের ছিল। বাকিরা নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা বাস্তবায়নের মধ্যে রয়েছে। এটা বাস্তবায়নে দুই-তিন কোটি টাকা খরচ হয়। তা ছাড়া ডিপোর জন্য ২৫টি দপ্তরের সনদ নিতে হয়। ওয়ান-স্টপ ব্যবস্থাপনা যদি থাকে, তাহলে এ ক্ষেত্রে ডিপো পরিচালনাকারীদের জন্য সুবিধা হতো।’

কনটেইনার ডিপোতে আমদানি-রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনার ব্যবস্থাপনা করা হয়। দেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৯০ শতাংশ এসব ডিপোর মাধ্যমে কনটেইনারে ভরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে জাহাজে তুলে দেওয়া হয়। একইভাবে আমদানি পণ্যের ২৫ শতাংশ বন্দর থেকে ডিপোতে এনে খালাস করা হয়। 

পাঁচটি প্রতিষ্ঠান সেফটি প্ল্যানের লাইসেন্স নিয়েছে। বাকিরা আবেদন করেছে। কিছু কিছু কাজ চলছে। আবার অনেকে গড়িমসি করে। আমরা চাপে রেখেছি
ফায়ার সার্ভিস চট্টগ্রাম বিভাগের উপপরিচালক মো. আবদুল হালিম

অগ্নিনিরাপত্তার ব্যবস্থায় ঘাটতি

ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামের ২৪টি ডিপোর মালিকানা ১৯টি প্রতিষ্ঠানের। এর মধ্যে অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনা থাকা পাঁচটি ডিপো হলো ইপিজেডের কিউএনএস কনটেইনার সার্ভিসেস লিমিটেড, ভাটিয়ারীর পোর্ট লিংক লজিস্টিক সেন্টারের দুটি ডিপো, সোনাইছড়ির কেডিএস লজিস্টিক লিমিটেড ও দুর্ঘটনাকবলিত কুমিরার বিএম কনটেইনার ডিপো।

বাকিগুলোর মধ্যে ৯টি ডিপো অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনা জমা দিলেও এখনো অনুমোদিত হয়নি। বাকি ১০টির অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনা ফায়ার সার্ভিস থেকে অনুমোদন দেওয়া হলেও সে অনুযায়ী ফায়ার হাইড্রেন্ট, এক্সটিংগুইশার স্থাপনসহ অন্যান্য ব্যবস্থার বাস্তবায়ন এখনো হয়নি।

ফায়ার সার্ভিস চট্টগ্রাম বিভাগের উপপরিচালক মো. আবদুল হালিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পাঁচটি প্রতিষ্ঠান সেফটি প্ল্যানের লাইসেন্স নিয়েছে। বাকিরা আবেদন করেছে। কিছু কিছু কাজ চলছে। আবার অনেকে গড়িমসি করে। আমরা চাপে রেখেছি।’

সুপারিশের মধ্যে রাসায়নিক বা দাহ্য পদার্থের জন্য পৃথক শেড, নিয়মিত অগ্নিনিরাপত্তা মহড়া করা, রাসায়নিকের আগুন নেভানোর জন্য পৃথক ব্যবস্থা থাকা অন্যতম। তদন্ত কমিটির মতে, সুপারিশ বাস্তবায়নে ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি বন্দর কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে নিয়মিত তদারকি করা দরকার।

ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, অগ্নিনিরাপত্তায় প্রথমে কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তা উল্লেখ করে একটি পরিকল্পনা ফায়ার সার্ভিসে জমা দিতে হয় ডিপো কর্তৃপক্ষকে। ফায়ার সার্ভিস তাতে নতুন করে কিছু নির্দেশনা দেয়। ওই পরিকল্পনা অনুমোদিত হওয়ার পর সে অনুযায়ী বাস্তবায়ন করতে হয়। তারপর ফায়ার সেফটি লাইসেন্স পাওয়া যায়।

অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনা অনুযায়ী, কনটেইনার ডিপোতে নিজস্ব পানির উৎস বা জলাধার থাকতে হবে। এর পাশাপাশি থাকতে হবে ফায়ার হাইড্রেন্ট বা পানি সরবরাহের পদ্ধতি, রাসায়নিক আগুন নির্বাপণের জন্য ফোম-সংবলিত অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র, পর্যাপ্ত ফায়ার এক্সটিংগুইশার ও বহনযোগ্য অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। এ ছাড়া রাসায়নিক পণ্যের জন্য ডিপোতে পৃথক শেড রাখার শর্ত রয়েছে।

সরেজমিন দুটি ডিপো

ডিপোগুলোর অগ্নিনিরাপত্তার ব্যবস্থা দেখতে দুটি প্রতিষ্ঠানের সরেজমিনে যাওয়ার অনুমতি পান এই প্রতিবেদক। এর মধ্যে একটি নগরের পতেঙ্গা বোটক্লাবের কাছে ইনকনট্রেড লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি এখনো অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লাইসেন্স পায়নি। গত বৃহস্পতিবার এই ডিপোতে গিয়ে দেখা যায়, ডিপোর বিভিন্ন স্থানে ফায়ার এক্সটিংগুইশার বসানো হয়েছে। নিজস্ব পানির উৎস হিসেবে একটি জলাধার রয়েছে ডিপোতে। ফায়ার হাইড্রেন্ট বসানোর কাজ চলছে।

জানতে চাইলে ইনকনট্রেডের মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ জাকির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনার বাস্তবায়ন চলছে। ৭০ থেকে ৮০ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

একইভাবে পাশের পতেঙ্গার ইস্টার্ন লজিস্টিক লিমিটেডেও দেখা যায়, ফায়ার হাইড্রেন্ট নির্মাণের কাজ চলছে। জুন-জুলাই মাসের মধ্যে এ কাজ শেষ হবে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

এদিকে দুর্ঘটনার পর বিএম ডিপো অগ্নিনিরাপত্তার ব্যবস্থা জোরদার করেছে। জানতে চাইলে বিএম ডিপোর নির্বাহী পরিচালক ক্যাপ্টেন মঈনুল আহসান প্রথম আলোকে বলেন, গত ১০ ফেব্রুয়ারি ডিপোতে অগ্নিনিরাপত্তার পরিকল্পনা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়েছে। রাসায়নিকের আগুন নেভানোর জন্য ফোমের ব্যবস্থাও রয়েছে এই ডিপোতে।

সুপারিশ বাস্তবায়ন জরুরি

বিএম ডিপোর ঘটনায় জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটির প্রধান ছিলেন চট্টগ্রামের তখনকার অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মিজানুর রহমান। এখন তিনি কক্সবাজারে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি)। তদন্তে দুর্ঘটনা এড়াতে ২০ দফা সুপারিশ করা হয়।

সুপারিশের মধ্যে রাসায়নিক বা দাহ্য পদার্থের জন্য পৃথক শেড, নিয়মিত অগ্নিনিরাপত্তা মহড়া করা, রাসায়নিকের আগুন নেভানোর জন্য পৃথক ব্যবস্থা থাকা অন্যতম। তদন্ত কমিটির মতে, সুপারিশ বাস্তবায়নে ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি বন্দর কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে নিয়মিত তদারকি করা দরকার।

তদন্ত কমিটির সদস্য ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সুমন বড়ুয়া বলেন, বিএম ডিপোর ঘটনা অসতর্কতার কারণে হয়েছে। নতুন করে বড় দুর্ঘটনা এড়াতে তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন জরুরি। হেলাফেলা করলে আরও বড় বিপদ ঘটবে।