Thank you for trying Sticky AMP!!

অস্থিরতা বাড়ছে অর্থনীতিতে

বিশ্ব অর্থনীতির নানা সংকটের প্রভাব পড়ছে দেশের মধ্যেও। বিভিন্ন ধরনের পণ্যমূল্য বাড়াচ্ছে মূল্যস্ফীতি, চাঙা ডলার সংকট বাড়াচ্ছে আরও বেশি।

বিশ্বজুড়েই ডলারের দর চড়া। এক বছরে ডলারের দর বেড়েছে ১৬ শতাংশ। গত ২০ বছরের মধ্যে বিশ্বে ডলারের দর এখন সবচেয়ে বেশি। আর চাঙা ডলারের প্রভাবে বিপাকে আছে ছোট অর্থনীতির দেশগুলো। বিপদে পড়েছে বাংলাদেশও। অর্থনীতিতে দেখা দিয়েছে অস্থিরতা, সংকটের প্রভাব পড়ছে বেশ কিছু সূচকে।

বাংলাদেশ বিনিময় হার কখনোই বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়নি। অর্থনীতি যখন স্বস্তিদায়ক অবস্থায়, বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে কোনো সংকট ছিল না, তখনো টাকার বিনিময় হার কৃত্রিমভাবে ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। আর এখন চরম সংকটের সময় বাংলাদেশ ব্যাংক পরিস্থিতি সামাল দিতে দফায় দফায় টাকার মান কমাচ্ছে। পরিস্থিতি এতটাই নিয়ন্ত্রণের বাইরে যে বাংলাদেশ ব্যাংক–নির্ধারিত টাকায় ডলার কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঠিক করে দেওয়া দর হচ্ছে ৮৭ টাকা ৫০ পয়সা, কিন্তু ব্যাংকে কিনতে হচ্ছে কমবেশি ৯৫ টাকা দরে। আর খোলাবাজারে ডলার তো শতক হাঁকিয়েছে। খোলাবাজারে গতকাল মঙ্গলবার ডলারের মূল্য ছিল ১০২ টাকা, তা–ও আবার সহজে পাওয়া যায়নি।

ডলারের দর বেড়ে যাওয়া মানেই আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি। বাংলাদেশে রপ্তানির তুলনায় আমদানি বেশি। বিশেষ করে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, ভোজ্যতেল, সার, গমসহ প্রায় সব ধরনের পণ্য বেশি দামে আমদানি করতে হচ্ছে। আর এর মাধ্যমেই এখন মূল্যস্ফীতিও আমদানি হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশগুলো মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে নীতিনির্ধারণী সুদের হার বাড়িয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষে সুদহার কমানোর সুযোগ কম। কেননা, কোভিড-১৯–এর সময় অর্থনীতি চাঙা রাখতে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ প্রণোদনা হিসেবে ব্যবসায়ীদের অর্থ দিয়েছে। সেই অর্থ মুদ্রা সরবরাহ বাড়িয়ে দেয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় ইউক্রেন সংকট। এসবই মূল্যস্ফীতির চাপ তৈরি করেছে। ফলে অর্থের প্রবাহ সংকুচিত করার জন্যই বিভিন্ন দেশকে সুদহার বাড়াতে হচ্ছে।

Also Read: অর্থনীতির চার সূচকে বিপৎসংকেত

বাংলাদেশ ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা হিসেবে দিয়েছে মূলত কম সুদের ব্যাংকঋণ। সেই অর্থের বড় অংশই পরিশোধ করা হয়নি। প্রণোদনার অর্থ উৎপাদনশীল খাতে খরচ হয়েছে কি না, তা নিয়েও আছে প্রশ্ন। এর সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতি। এর জন্য দায়ী মূলত বিশ্ব অর্থনীতি।

ফলে সব দিক থেকেই বিপদ বাড়ছে। মূল্যস্ফীতির কারণে বেড়ে গেছে জীবনযাত্রার ব্যয়, কষ্টে আছে সীমিত আয়ের সাধারণ মানুষ। এ অবস্থায় অর্থনীতিবিদেরা এখনই প্রস্তুতি নেওয়ার তাগিদ দিচ্ছেন। সামনে আসছে বাজেট। এই বাজেটে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বাড়ানো এবং অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানোর কথাও বলছেন তাঁরা।

বিপদ কি আঁচ করা গিয়েছিল

২০২০ সালে কোভিড-১৯ সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লেও ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত দেশে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি ছিল যথেষ্ট ভালো। শুরুতে রপ্তানি নিয়ে শঙ্কা থাকলেও পরে তা–ও কাটিয়ে ওঠা গেছে। এমনকি আমদানি ব্যয়ও ছিল সাধ্যের মধ্যে। কিন্তু চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের শুরু থেকেই কয়েকটি সূচকে ভঙ্গুরতা দেখা দেয়। বিশেষ করে প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি তো দূরের কথা, আগের বছরের সমান আয়ও করা যায়নি। অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে প্রবাসী আয় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কমে ১৬ দশমিক ২৫ শতাংশ। আগের অর্থবছরে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ।

গত অর্থবছরের ১২ মাসে আমদানি ব্যয় ছিল ৬ হাজার কোটি টাকার সামান্য বেশি। আর চলতি অর্থবছরের ৯ মাসেই আমদানির জন্য ব্যয় করতে হয়েছে ৬ হাজার ১৫২ কোটি ডলার। এখন দেশে যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আছে, তা দিয়ে সাড়ে পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব, যা আগে ছিল আট মাসেরও বেশি। ৯ মাসের আমদানি ও রপ্তানির হিসাব ধরলে ঘাটতি প্রায় আড়াই হাজার কোটি ডলার। মূলত এখন বাংলাদেশ যত বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে, তার চেয়ে ব্যয় অনেক বেশি হয়ে গেছে। প্রবাসী আয়ে নিম্নগতি ও উচ্চ আমদানি ব্যয়ের কারণে চলতি আয়ে দেখা দিয়েছে রেকর্ড ঘাটতি। মূল সংকট এখানেই।

সুতরাং অর্থবছরের শুরু থেকেই অল্প অল্প চাপ বাড়ছিল। এর মধ্যে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ পরিস্থিতি আরও খারাপ করে দিয়েছে। কোভিড–পরবর্তী অর্থনৈতিক উত্তরণের পরিবর্তে নতুন মন্দায় নিয়ে যাচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতিকে। নীতিনির্ধারকেরা উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি আর মাথাপিছু আয় বাড়াতে এবং ১৭ বছর আগের ভিত্তিবছর ধরে মূল্যস্ফীতি গণনাতেই ব্যস্ত থেকেছে বেশি। এতে মূল্যস্ফীতি কম দেখালেও যা প্রকৃত পরিস্থিতির সঙ্গে মিল ছিল না। ফলে বাস্তব পরিস্থিতি মূল্যায়নে মনোযোগ ছিল কম।

ডলারের দর কেন বাড়ানো হয় না

বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের হার নির্ধারণ সব সময়েই নিজের হাতে রেখে দিয়েছে। ২০ বছর আগেও বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষণা দিয়ে টাকার অবমূল্যায়ন করেছে। ঘোষণা দিয়ে টাকার দর পরিবর্তন থেকে বাংলাদেশ সরে এসেছে ২০০৪ সাল থেকে। সাধারণত টাকার দর কমানো বা অবমূল্যায়ন করা হলে রপ্তানিকারকেরা উৎসাহিত হন। কারণ, আগের তুলনায় প্রতি ডলারে বেশি স্থানীয় মুদ্রা পাওয়া যায়। তবে অবমূল্যায়ন করলে আমদানি ব্যয় বেড়ে যায়। একটি দেশ আমদানিনির্ভর হলে অবমূল্যায়ন মূল্যস্ফীতি ডেকে আনে। বাংলাদেশে এখন এটাই হচ্ছে।

আমদানিনির্ভরতা বেশি বলেই বাংলাদেশ শুরু থেকেই ডলারের দর কৃত্রিমভাবে ধরে রেখেছে। ৮০ টাকার ওপরে ওঠা যাবে না—এই নীতি ছিল দীর্ঘদিন। রপ্তানিকারকদের অনেক দাবির পরও টাকার অবমূল্যায়ন করা হয়নি। কিন্তু এবার আর সেই নীতিতে থাকতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি বছরে এখন পর্যন্ত পাঁচবার টাকার মান কমানো হলো। শুরুতে ২০ পয়সা করে অবমূল্যায়ন করা হলেও গত সোমবার একলাফে ৮০ পয়সা বাড়ানো হয়েছে ডলারের দাম। প্রতিযোগী দেশগুলোও তাদের মুদ্রা অবমূল্যায়ন করছে বলে রপ্তানি খাতে টিকে থাকতে পিছিয়ে থাকতে পারেনি বাংলাদেশও। স্থিতিশীল সময়ে ডলারের দর আরেকটু বাজারমুখী করা হলে তখনই পরিস্থিতির সঙ্গে সমন্বয় করা এখনকার তুলনায় সহজ হতো। সেটা করা হয়নি বলে ডলারের বাজার এখন অস্থির।

বাংলাদেশ ব্যাংক এখন ডলারের দর স্থিতিশীল রাখার জন্য বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রি করছে। কিন্তু তাতেও সংকট মেটানো যাচ্ছে না। চাহিদা-জোগানের মধ্যে মিল হচ্ছে না। এভাবে ডলারের দর স্থিতিশীল রাখা যাবে না বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ফলে শেষ পর্যন্ত ডলারের দর কোথায় দাঁড়ায়, সেদিকেই লক্ষ্য এখন সব পক্ষের।

Also Read: আন্তর্জাতিক লেনদেন ও মূল্যস্ফীতি নিয়ে বিপদ বাড়ছে

অস্থিরতা কত দিকে ছড়াতে পারে

দাম বাড়লেও ভোজ্যতেল ও জ্বালানি তেল আমদানি করা সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু বেশি অর্থ দিয়েও গম ও রাসায়নিক সার সহজে আমদানি করা যাবে কি না—এই প্রশ্নই এখন দেখা দিয়েছে। জ্বালানি তেলের উচ্চ দাম উৎপাদন ব্যয় বাড়িয়ে দিচ্ছে। ভোজ্যতেল ও গমের দাম বাড়াচ্ছে জীবনযাত্রার ব্যয়। তবে রাসায়নিক সার নিয়েই বিপদ বেশি এখন সরকারের। কৃষি উৎপাদনের সারের বিকল্প নেই। সরকার এমনিতেই সারে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দেয়। ফলে বিশ্ববাজারে সারের দাম যত বাড়বে, সরকারের ভর্তুকি ব্যয়ও তত বাড়বে।

বিশ্ববাজারের পণ্যমূল্য বাড়লে কিছুটা লাভবান হয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। মূল্যমানের ওপর কর বা শুল্ক আরোপ করা হয় বলে রাজস্ব আদায় কিছুটি বৃদ্ধি পায়। ফলে এখন পর্যন্ত আমদানি শুল্ক আদায় বেড়েছে, ভ্যাটও পাচ্ছে এনবিআর। তারপরও কর-জিডিপি অনুপাতের দিক থেকেই বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে নিচে থাকা একটি দেশ। নতুন ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে সরকারের ভর্তুকি ব্যয় ও সুদ পরিশোধের পরিমাণ বাড়বে। অর্থনীতিবিদেরা এখন বলছেন, মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে বাঁচাতে অসহায় মানুষদের জন্য বাজেটে বিশেষ সামাজিক কর্মসূচি রাখতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন হবে বাড়তি অর্থের। আবার দেশি-বিদেশি ঋণের দায় পরিশোধের জন্য বাজেটে বিপুল অর্থ বরাদ্দ রাখতে হয়। নতুন অর্থবছরে তা আরও বাড়বে। বেতন-ভাতা তো আছেই। আরও থাকবে নির্বাচনের আগে প্রকল্পের চাপ।

গত প্রায় দেড় দশকে সামষ্টিক অর্থনীতি নিয়ে এত বড় চ্যালেঞ্জের মধ্যে আর কখনো পড়তে হয়নি বাংলাদেশকে। রপ্তানি ছাড়া আপাতত স্বস্তির সূচক খুব একটা নেই। তবে ইউরোপসহ বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন করে মন্দা দেখা দিলে বিপদ বাড়বে এখানেও। সুতরাং সরকারকে একদিকে অর্থনীতির নানা সূচকের স্থিতিশীলতাকে ধরে রাখতে হবে, অন্যদিকে সহায়তা দিতে হবে ক্ষতিগ্রস্তদের। কমাতে হবে অপ্রয়োজনীয় ব্যয়, নজর রাখতে হবে দেশি-বিদেশি ঋণের দায় পরিশোধের দিকে। সব মিলিয়ে কঠিন এক চ্যালেঞ্জের মধ্যে সরকার।