Thank you for trying Sticky AMP!!

আটকে গেছে বস্ত্রবয়ন খাত

দেশের কোটি কোটি মানুষের কাপড়ের চাহিদার বিরাট অংশের জোগান বিদ্যুৎ-চালিত তাঁত ও বিশেষায়িত বস্ত্রকল থেকে আসে। আড়াই যুগের বেশি সময় ধরে এটি চলে আসছে। অবশ্য দীর্ঘদিন আধুনিকায়নের ছোঁয়া না লাগায় একটি বৃত্তের মধ্যে আটকে গেছে বস্ত্রবয়ন নামের এই সম্ভাবনাময় শিল্প খাত। হচ্ছে না নতুন বিনিয়োগ।
এ খাতের উদ্যোক্তারা জানান, নানা কারণেই একটু একটু করে পিছিয়ে পড়ছে খাতটির ছোট ও মাঝারি কারখানাগুলো। যন্ত্রপাতি পুরোনো হয়ে যাওয়ায় বিশেষায়িত বস্ত্রকলগুলো এখন যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না। ফলে অত্যাধুনিক কাপড় উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না। জায়গাটি নিচ্ছে বিদেশি কাপড়। অন্যদিকে সুযোগ থাকলেও তৈরি পোশাকশিল্পে বিশেষ করে ওভেন খাতে দেশি কাপড়ের অংশীদারত্ব বাড়ানো যাচ্ছে না। অবৈধভাবে বিদেশি কাপড় বাজারে আসায় বাড়তি প্রতিযোগিতায় পড়ছে অনেক কারখানা।
আশির দশকের শুরুতে ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে ঋণ নিয়ে হস্তচালিত তাঁত বদলে অনেক ব্যবসায়ী বিদ্যুৎ-চালিত তাঁত ও বিশেষায়িত বস্ত্রবয়ন কারখানা স্থাপন করেন। অনেকে আবার নতুন করে এই ব্যবসায় আসেন। নতুন ও পুরোনো এই ব্যবসায়ীদের একটি অংশই আবার পরে বৃহৎ আকারের টেক্সটাইল মিল স্থাপন করেছে। কেউ কেউ আবার পোশাকশিল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন।
বর্তমানে সারা দেশে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বস্ত্রবয়ন কারখানা আছে। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ কারখানাতেই পাওয়ারলুম বা বিদ্যুৎ-চালিত তাঁত দিয়ে কাপড় বোনা হয়। বাকিগুলো হচ্ছে বিশেষায়িত বস্ত্রবয়ন কারখানা। বাংলাদেশ স্পেশালাইজড টেক্সটাইল মিলস্ অ্যান্ড পাওয়ারলুম ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন (বিএসটিএমপিআইএ) এই খাতটি নিয়ে কাজ করে। ১৯৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও ১০ বছর পর সমিতিটি নিবন্ধন পায়। বর্তমানে সমিতির সদস্য এক হাজার ৪০০ কারখানা।
সমিতির দেওয়া তথ্যানুযায়ী, তাদের সদস্যভুক্ত কারখানাগুলোতে ৭০ হাজার তাঁত আছে। সম্মিলিতভাবে এসব কারখানার বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ১২৬ কোটি মিটার কাপড়, টাকার অঙ্কে যা প্রায় তিন হাজার ৭৮০ কোটি টাকা। আর খাতটির সঙ্গে জড়িয়ে আছেন অন্তত সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষ।
সারা দেশেই বস্ত্রবয়নশিল্পের কারখানা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকলেও একটি বড় অংশই নরসিংদীতে। তা ছাড়া নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ, সিদ্ধিরগঞ্জ, সোনারগাঁ ও আড়াইহাজার, মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, চট্টগ্রাম, কুষ্টিয়া, গাজীপুর, সাভার ও কেরানীগঞ্জে আছে অনেক কারখানা। এসব কারখানায় লুঙ্গি, গামছা থেকে শুরু করে শাড়িকাপড়, থানকাপড়, বিছানার চাদর, শার্ট ও প্যান্টের কাপড় ইত্যাদি তৈরি হয়। পুরো বস্ত্রবয়ন খাতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার মতো বিনিয়োগ আছে বলে দাবি সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের।
জানা গেছে, ১৯৯৪ সালে অর্থ মন্ত্রণালয় বস্ত্রবয়নশিল্পের আধুনিকায়নের জন্য প্রথম উদ্যোগ নেয়। এ জন্য মন্ত্রণালয় তৎকালীন শিল্প ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আকমল হোসেনের নেতৃত্বে ১১ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। এই ‘আকমল কমিটি’ কারখানাগুলোর বিএমআরইসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করে। তবে শেষ পর্যন্ত তা বাস্তবায়িত হয়নি।
সমিতির সদস্যসচিব শেখ আবদুল হাকিম বলেন, আকমল কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন করা গেলে বস্ত্রবয়নশিল্প আজ অন্য উচ্চতায় থাকত। তবে এটি না হয়ে উল্টো অনেক কারখানাই বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকগুলো আবার রুগ্ণ হয়ে পড়েছে।
এদিকে সরকারের রুগ্ণ শিল্পের তালিকায় অন্য খাতের পাশাপাশি বস্ত্রবয়নশিল্পের ১০৮ কারখানা তালিকাভুক্ত হয়। রুগ্ণ কারখানার সমস্যা সমাধানে সরকার বাজেটে থোক বরাদ্দ রাখে ও নীতিমালা তৈরি করে। পরে বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মাধ্যমে কারখানারগুলোর ‘বেল আউট’-এর জন্য প্রজ্ঞাপন জারি হয়। তবে শেষ পর্যন্ত ৩১টি কারখানা এখনো সহায়তা পায়নি। এসব তথ্য দিয়ে সমিতির সভাপতি আজিজুল হক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সব ব্যাংক সহযোগিতা করলেও অগ্রণী ব্যাংক বিষয়টি উদ্দেশ্যমূলকভাবে ঝুলিয়ে রেখেছে। যদিও এই ব্যাংকটিই পোশাকশিল্পের ২৭০ কারখানার বেল আউটের সুযোগ বাস্তবায়ন করেছে।
এদিকে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ভালো সাফল্য পাচ্ছে বাংলাদেশ। অবশ্য নিটের জন্য ৯০ শতাংশ দেশীয় কাপড়ের জোগান নিশ্চিত করা গেলেও ওভেন পোশাক তৈরিতে এখনো ৬০ শতাংশ কাপড় বা ফেব্রিকস আমদানি করতে হয়। ফলে এ ক্ষেত্রে উন্নতির বেশ সুযোগ আছে। আর এটি কাজে লাগানো গেলে পোশাকশিল্পের মূল্য সংযোজন বৃদ্ধি পাবে। বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে।
এই সুযোগ কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের বিশেষায়িত বা স্পেশালাইজড টেক্সটাইল মিলগুলো কিছুটা হলেও এগিয়ে আছে। কারখানাগুলোতে থাকা পুরোনো যন্ত্র পরিবর্তন করে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি বসানো গেলেই এ ক্ষেত্রে বেশ অগ্রগতি হয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে আমদানি করা কাপড়ের চেয়ে কম দামে দেশের কারখানা থেকেই জোগান দেওয়া যাবে। বেশ কয়েক বছর ধরে এমনটাই দাবি করে আসছে বিএসটিএমপিআইএ।
এ দাবির পেছনে সভাপতি আজিজুল হকের যুক্তি হচ্ছে, নিটের কাপড় তৈরিতে বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে তুলনামূলক কম অর্থ বিনিয়োগ প্রয়োজন হয় বলেই এটি সম্ভব হয়েছে। তবে ওভেন কাপড় তৈরিতে একসঙ্গে অনেক টাকা বিনিয়োগের প্রয়োজন হয়, যা ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য কষ্টসাধ্য। তিনি বলেন, ‘আমাদের দক্ষতা, কারখানা ও দক্ষ শ্রমিক আছে, শুধু মূলধনের অভাব। সে জন্য সরকারকে এ খাতে ২০:৮০ অনুপাতে (ব্যবসায়ীর ২০ টাকা পুঁজির বিপরীতে সরকারের ৮০ টাকা) বিনিয়োগ করতে এগিয়ে আসতে হবে।’
তবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে পোশাকমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম কিছুটা দ্বিমত প্রকাশ করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রস্তাবটি ভালো। উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। তবে দেশে বস্ত্রকল হলেই যে পোশাকশিল্পের জন্য কম দামে কাপড় পাওয়া যাবে, সেটি আসলে সত্য নয়। কারণ, এর পেছনে অনেক বিষয় জড়িত আছে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে শহিদুল্লাহ আজিম বলেন, দেশীয় উদ্যোক্তারা নিট কাপড়ের বিশাল জোগান যে দিচ্ছেন সেটি কিন্তু একদিনে হয়নি। ওভেন কাপড়েও হয়তো একসময় হবে। তবে ওই পর্যায়ে যেতে অনেক সময় লাগবে।
বস্ত্রবয়ন খাতের উদ্যোক্তারা জানালেন, বিদ্যুৎ, ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদ আর অবৈধ বিদেশি কাপড়ই এখন মূল সমস্যা। তা ছাড়া বর্তমানে প্রতিটি তাঁত বাবদ মাসে ১০০ ও ২০০ টাকা হারে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) দিতে হয়। যন্ত্রপাতি আমদানিতে ৫ শতাংশ হারে শুল্ক ধার্য করা আছে। এতে করে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। অবশ্য প্রতিটি তাঁত বাবদ মূসক ও আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করতে আগামী ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটে সমিতির পক্ষে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে দাবি জানানো হয়েছে।

.

৫,৫০০ ছোট ও মাঝারি কারখানা দেশজুড়ে
৩,৩৫০ কোটি টাকা ন্যূনতম বিনিয়োগ
১২৬ কোটি মিটার কাপড় বার্ষিক উৎপাদন
লুঙ্গি, গামছা থেকে শুরু করে শাড়ি কাপড়, থান কাপড়, বিছানার চাদর, শার্ট ও প্যান্টের কাপড় ইত্যাদি তৈরি হয়
বেশির ভাগ কারখানা নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, চট্টগ্রাম, কুষ্টিয়া, গাজীপুর, সাভার ও কেরানীগঞ্জে

সমস্যা
 বিদ্যুতের অপর্যাপ্ততা
 ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদ
 অবৈধ বিদেশি কাপড়

সম্ভাবনা
 উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারলে এসব কারখানাই ওভেন পোশাকের কাপড়ের উল্লেখযোগ্য অংশ জোগান দিতে পারবে