Thank you for trying Sticky AMP!!

আর্চারির বন্ধু সিটি গ্রুপ

১৩তম দক্ষিণ এশিয়ান গেমস আর্চারিতে ১০ সোনার সব কটি জিতেছে বাংলাদেশ আর্চারি দল

পৃষ্ঠপোষকেরা আজকাল ক্রিকেটের পেছনেই বেশি ছোটে। ফুটবলেও আসে অনেকে। কিন্তু ব্যতিক্রম সিটি গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটি জনপ্রিয় খেলার পেছনে ছোটেনি। সম্ভাবনাময় একটি খেলার উন্নয়নকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছে। তাই ২০১৭ সালের ২৩ অক্টোবর বাংলাদেশে আর্চারি ফেডারেশনের সঙ্গে সিটি গ্রুপের পাঁচ বছরের চুক্তিটা অনেক বেশি সুচিন্তিত এবং খেলাটির প্রকৃত চাহিদাকে প্রাধান্য দিয়ে করা। সিটি গ্রুপকে তখন অনেকে বলেছিল, ‘আর্চারিতে এসে কী লাভ। কোনো ফল আসবে না। শুধু শুধু টাকা নষ্ট।’ কিন্তু এসব ভাবেনি গ্রুপটি। আর্চারির পেছনে বিনিয়োগ করে তারা যে ভুল করেনি, তা এখন দৃশ্যমান।

সদ্য নেপালে শেষ হওয়া ১৩তম দক্ষিণ এশিয়ান গেমস আর্চারিতে ১০ সোনার সব কটিই জিতেছে বাংলাদেশ আর্চারি দল। যদিও ভারত ছিল না। তারপরও দশে দশ বিরাট সাফল্যই। তার আগে বাংলাদেশের সেরা আর্চার রোমান সানা বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ব্রোঞ্জ জিতে সরাসরি আগামী বছর টোকিও অলিম্পিকের টিকিট পেয়েছেন। গলফার সিদ্দিকুর রহমানের পর বাংলাদেশের দ্বিতীয় খেলোয়াড় হিসেবে রোমান নিজের যোগ্যতায় অলিম্পিকে যাচ্ছেন। গত সেপ্টেম্বরে ফিলিপাইনে এশিয়ান আর্চারিতে সোনা জিতে সাড়া ফেলেন খুলনার তরুণ রোমান সানা। দ্রুততম সময়ে আর্চারির অভাবনীয় এই সাফল্যে সিটি গ্রুপের অবদান বিশাল। তাদের বিনিয়োগ বিফলে যায়নি। এ কারণেই গুলশানে সিটি হাউসে বসে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মো. হাসান তৃপ্তি নিয়ে প্রথম আলোকে বলতে পারেন, ‘আমরা সত্যই খুব আনন্দিত। লক্ষ্যপূরণের পথেই আছি আমরা।’

লক্ষ্যটা অনেক বড়। আপাতদৃষ্টিতে বাংলাদেশের ধরাছোঁয়ার বাইরে। ২০২০ টোকিও অলিম্পিক গেমসে সোনা জয়! এমন লক্ষ্য দাঁড় করানোর প্রেক্ষাপটও আছে। ২০১৬ সালে রিও অলিম্পিকের মার্চপাস্টে টিভিতে বাংলাদেশকে দেখে ঘোষক বলেন, ‘এখন ১৬ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশ। কিন্তু দেশটি এখনো অলিম্পিকে পদক জিততে পারেনি।’ এই ঘোষণা শুনে সিটি গ্রুপের তৎকালীন নির্বাহী পরিচালক শোয়েব মো. আসাদুজ্জামানের মনে প্রশ্ন জাগে, অলিম্পিকে পদক জয়ের চেষ্টা কেন করে না বাংলাদেশ? এই প্রশ্ন নিয়ে তিনি সিটি গ্রুপের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন। সিটি গ্রুপ রাজি হয় অলিম্পিক পদকের সন্ধানে নামতে। অলিম্পিকে পদক জেতার মতো খেলা বাংলাদেশে দুটি আছে—শুটিং আর আর্চারি। যেহেতু আর্চারি মানে তির–ধনুক আর সিটি গ্রুপের প্রতীক তীর, দুইয়ে দুইয়ে চার মিলে আর্চারিতে এল সিটি গ্রুপ। শুরু হলো ‘তীর গো ফর গোল্ড’ নামে আলোচিত কর্মসূচি। এখন সিটি গ্রুপের সব পণ্যে এই লোগোটা থাকে এবং নিচে লেখা, ‘২০২০ টোকিও অলিম্পিকে স্বর্ণ জয়ে তীরের একটি প্রচেষ্টা।’

সেই কর্মসূচি এখন বাংলাদেশের গোটা ক্রীড়াঙ্গনের জন্যই অনুকরণীয়। সিটি গ্রুপের পরিচালক মো. হাসান বলেন, ‘আমরা আর্চারির প্রথাগত স্পনসর নই। একবারে সব টাকা নয়, খেলাটা এগিয়ে নিতে যখন যা প্রয়োজন, তা বিশ্লেষণ করে দিই। আমরা চাই খেলার সত্যিকারের উন্নয়ন।’ তাঁর পাশে বসে এই কর্মসূচি সার্বক্ষণিক দেখভাল করা সিটি গ্রুপের ব্র্যান্ড ম্যানেজার রুবাইয়াৎ আহমেদ বলেন, ‘ফেডারেশন বছরের শুরুতে আমাদের একটা বাজেট দেয়। ওখান থেকে আমরা বেছে নিই কোন কোন খাতে অর্থায়ন করব। এভাবে আমাদের এই কর্মসূচি এগিয়ে চলেছে।’ অভিজ্ঞতা বলছে, বাংলাদেশে অনেক ফেডারেশনই একবারে স্পনসর অর্থ পেয়ে ঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারে না। কিন্তু সিটি গ্রুপের অর্থের যথাযথ ব্যবহারের ফল পাচ্ছে আর্চারি। যদিও মো. হাসান বলেন, ‘আসলে প্রতিদান পাওয়া বা সিএসআরের অংশ হিসেবে আমরা আর্চারিতে আসিনি। আমাদের গ্রুপের বিপণনের বাজেট থেকে একটা অংশ আর্চারিতে দিচ্ছি। স্পনসরশিপ নয়, আমরা বলি, আমরা আর্চারির উন্নয়ন সহযোগী।’

আর এই সহযোগী প্রথমে নজর দেয় আর্চারির অবকাঠামো উন্নয়ন ও বিভিন্ন প্রতিযোগিতার স্পনসরশিপে। টঙ্গীর আহসান উল্লাহ মাস্টার স্টেডিয়ামে আর্চারি কোচিং সেন্টার, সেখানেই খেলোয়াড়দের রান্নাঘর, ডাইনিং রুম, থাকার ব্যবস্থা উন্নত করা হয়েছে। ভালো অনুশীলন–সুবিধা, বিদেশ থেকে খেলার সরঞ্জাম আনা, বিদেশি কোচ নিয়োগ, খেলোয়াড়দের বিদেশে পাঠানো—সবই করছে সিটি গ্রুপ। মো. হাসান বলেন, ‘শুরুতে ফেডারেশন আমাদের বলল, টঙ্গীতে খেলোয়াড়দের থাকার রুমে এসি দরকার। আমরা কোচকে জিজ্ঞেস করেছি এসির দরকার কি না। কোচ বলেন, অবশ্যই দরকার। কারণ, একটা ছেলে ভালোভাবে না ঘুমাতে পারলে ভালো খেলবে কীভাবে। তাই আমরা এসি দিয়েছি।’ সিটি গ্রুপ টঙ্গীতে খেলোয়াড়দের সব রুমেই ৩০টি শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র লাগিয়ে দেয়। রুম সংস্কার করে ক্যাবিনেটের ব্যবস্থা করে দেয়।

খেলোয়াড় তুলে আনতে ২০১৭ সালে প্রতিভা অন্বেষণ করে ফেডারেশন। দ্বিতীয় বছরে সারা দেশে সেটি করেছে সিটি গ্রুপ। ২০১৭-১৮ সালে প্রথম আটটি লক্ষ্য ছিল, যার পাঁচটি পূরণ হয়। ফেডারেশনের কাজের ধারাবাহিকতা ও আর্চারদের নৈপুণ্য চুক্তি বাড়ানো হয় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে। তখন চাকরিহীন ১০ জন আর্চারকে মাসিক ভাতা দেয় সিটি গ্রুপ। কিন্তু এক বছর পর কোচ মার্টিন ফ্রেডরিকের পরামর্শে এই টাকাটা দেওয়া শুরু হয় পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে। মো. হাসান বলেন, ‘আমাদের এই কর্মসূচিটা হচ্ছে পারফরম্যান্স ভিত্তিক। লক্ষ্য বেঁধে দিলে খেলোয়াড়েরা ভালো করার তাগিদ বেশি অনুভব করেন। এতে ভালো ফল আসে।’

খেলোয়াড়দের জন্য চাই জিম। কোচের পরামর্শে আর্চারির জন্য বিশেষ জিমও করে দিয়েছে সিটি গ্রুপ। ফেডারেশনের সঙ্গে আলোচনা করে জার্মান কোচ ফ্রেডরিককে পাঁচ বছরের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে। তাঁর বেতন, বাসস্থান, গাড়ি খরচ, খাওয়া, প্রতিবছর জার্মানিতে যাওয়ার দুটি ফিরতি টিকিট...সবই দিচ্ছে সিটি গ্রুপ। কোচের ওপর তারা এখন অনেক খুশি। মোহাম্মদ হাসান বলেন, ‘কোচ বেশ আন্তরিক। এটা আমাদের ভালো লাগছে। বছরে হয়তো বিদেশে আর্চারির দশ-বারোটা টুর্নামেন্ট থাকে, কোচ-ফেডারেশনের পরামর্শে ঠিক করা হয় কোথায় কোথায় যাওয়া দরকার।’ সব মিলিয়ে ২০১৭-১৮ সালে আর্চারির জন্য সিটি গ্রুপের বরাদ্দ ছিল ২ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২ কোটি ২০ লাখ, ২০১৯-২০-এ ২ কোটি ৪১ লাখ।

তবে মো. হাসানের একটা অতৃপ্তি আছে, ‘বাংলাদেশ আর্চারি দলটা যদি টোকিও অলিম্পিকে কোয়ালিফাই করতে পারত (রোমান সানা শুধু করেছেন)! আরও খুশি হতাশ আমরা।’ ভবিষ্যতে করবে তাঁর আশা। এখন টোকিও অলিম্পিকে যাওয়ার আগে বাংলাদেশ জাতীয় দলের জার্সি-ডিজাইন প্রতিযোগিতা করবে সিটি গ্রুপ। মো. হাসান বলেন, ‘খেলাটাকে আরেকটু মানুষের কাছে নেওয়ার চেষ্টা করছি আমরা।’ সেটি করতে পারলে বাংলাদেশ আর্চারি যাবে দূরে, বহু দূরে।