Thank you for trying Sticky AMP!!

কোনো গভর্নরই তাঁকে ছাড়তে চাননি

>
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ও পরিবর্তন ব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা আল্লাহ মালিক কাজেমী গত ২৬ জুন মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৭৬ সালে যোগদান করে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকে কর্মরত ছিলেন। প্রথাগত চাকরির পরিবর্তে হয়ে তিনি উঠেছিলেন প্রকৃত কেন্দ্রীয় ব্যাংকার। এ জন্য স্বাভাবিক চাকরি শেষ হওয়ার পরও তাঁকে বিদায় দেয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আল্লাহ মালিক কাজেমীকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করেছেন তাঁরই ব্যাচমেট ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর জিয়াউল হাসান সিদ্দিকী। বর্তমানে তিনি সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান।

আল্লাহ মালিক কাজেমী শুধু একটা নাম নয়, তিনি একজন কিংবদন্তি। প্রবাদপ্রতিম মানুষ। তিনি কর্মবীর ছিলেন, আইকনিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। পার্থিব অনেক বিষয়ে বিমুখ ছিলেন। তিনি অর্থনীতির ছাত্র ছিলেন না। কিন্তু অর্থনীতির ওপর ছিল অগাধ জ্ঞান। বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রানীতির যে প্রতিবেদন করে, সেটা তাঁরই লেখা। পুরোনো মুদ্রানীতির প্রতিবেদন খুললে দেখা যাবে, ভবিষ্যতের অনেক বিষয়ে পূর্বাভাস দিতেন। শেয়ারবাজার বা আবাসন খাতে কী হতে পারে, তা তুলে ধরতেন।

আমাদের দেশে একসময় বৈদেশিক মুদ্রার দুই ধরনের মান ছিল। একটি ছিল আনুষ্ঠানিক, অন্যটি প্রবাসী আয়ের ওপর। তিনি আমাকে বলতেন, ‘তুমি কি মনে করো এটা এভাবেই চলা উচিত?’ আমি বলেছিলাম, মনে হয় দুটোই ভুল অথবা একটি ভুল। এরপরই একদিন তিনি প্রজ্ঞাপন করলেন, ডলারের দাম এক করে দেওয়া হলো। আমি মনে করি, বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় এটাই প্রথম সংস্কার। তখন তিনি মুদ্রানীতি বিভাগের ডিজিএম, আমি বৈদেশিক মুদ্রা অপারেশন বিভাগের ডিজিএম।

ভাসমান মুদ্রা বিনিময় হার ঠিক করা হয় ফখরুদ্দীন আহমেদ গভর্নর থাকাকালে। এ নিয়ে যে প্রজ্ঞাপন আছে, সেখানে আমার স্বাক্ষর আছে। কিন্তু প্রজ্ঞাপনটি পুরোটাই কাজেমীর নিজের হাতে করা। যেসব দেশে অর্থ পাচার প্রতিরোধে কোনো আইন নেই, অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে নিয়োজিত আন্তর্জাতিক সংস্থা ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্স (এফএটিএফ) ২০০২ সালে ওই দেশগুলোকে কালো তালিকাভুক্ত করার উদ্যোগ নেয়। ওই সময়ে আমাদের দেশে আসলেই কোনো আইন ছিল না। কাজেমীকে দায়িত্ব দেওয়া হয় আইনের খসড়া তৈরির। পরে আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে যেটা চূড়ান্ত হয়, তাতে কাজেমীর মূল কথার বাইরে নতুন কিছু ছিল না। কাজেমী ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে কাজ করতেন। অথচ অর্থ পাচার প্রতিরোধের পুরো আইন তৈরিতে একক কৃতিত্ব তাঁর। ২০১১ সালের পর বৈদেশিক মুদ্রার অনেক উদারীকরণ হয়েছে। এর সব কটির পেছনে তাঁর অবদান ছিল।

১৯৭৬ সালে আমরা একসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকে যোগদান করি। ওই সময়ে যোগদানের পর বাণিজ্যিক ব্যাংকে ছয় মাসের জন্য প্রশিক্ষণে পাঠানো হতো। আল্লাহ মালিক কাজেমী, এ টি এম নাছির উদ্দিন, আসাদুজ্জামান খান ও আমাকে পাঠানো হয় উত্তরা ব্যাংকের স্থানীয় শাখায়। ওই সময় বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) ছিল সদরঘাটে। তাই আধা বেলা সদরঘাটে ও উত্তরা ব্যাংকে আধা বেলা প্রশিক্ষণ নিতে হতো। বাণিজ্যিক ব্যাংকের সব ধরনের কার্যক্রম আমাদের হাতে-কলমে শেখানো হয়। এর ফলে আমাদের ব্যাচটা অন্যদের থেকে একটু হলেও ভিন্ন ছিল।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমি আল্লাহ মালিক কাজেমীর অনুগামী ছিলাম। আমি যখন সহকারী নিয়ন্ত্রক ছিলাম, তিনি তখন মানবসম্পদ বিভাগে। পরে আমাদের বিভাগ বদলাবদলি হয়। একসময় তিনি বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক হলেন, আমার পদায়ন হলো বৈদেশিক মুদ্রা অপারেশনস বিভাগে। রংপুর অফিসের মহাব্যবস্থাপক হিসেবে তাঁর পরই আমাকে পাঠানো হলো। এ কারণে তাঁকে খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। যখন তিনি ডেপুটি গভর্নর হয়ে গেলেন, তখন নির্বাহী পরিচালক হিসেবে আমাকে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হলো। অসাধারণ প্রজ্ঞা ছিল তাঁর, এ জন্য পাঁচজন গভর্নরের সঙ্গে কাজ করতে পেরেছেন। কোনো গভর্নরই তাঁকে ছাড়তে চাননি।

আমি এক কর্মকর্তার ওপর একবার ক্ষুব্ধ হলাম। ওই সময়ে বার্ষিক কর্মমূল্যায়ন করার সময় হলো। তাৎক্ষণিক প্রতিবেদন দিলে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হতে পারে। কাজেমী আমাকে জানালেন, তাঁর প্রতিবেদনটা সাত দিন পর দেওয়ার জন্য। পরে ওই কর্মকর্তাকে সবচেয়ে ভালো মূল্যায়ন করা হয়। আমাদের ব্যাচের এক বন্ধুর সঙ্গে কাজেমীর সম্পর্ক কোনো কারণে একবার খারাপ হয়েছিল, তিনি কর্মমূল্যায়ন নিয়েও খুব চিন্তিত ছিলেন। কিন্তু কাজেমী তাঁকে সবচেয়ে ভালো মূল্যায়ন দিয়েছেন। তাই ব্যক্তিগত সম্পর্ক যা-ই থাকুক না কেন, শেষ দিন পর্যন্ত ন্যায়পরায়ণতা ধরে রেখেছিলেন। পেশায় যে ধরনের ন্যায়পরায়ণতা প্রয়োজন, তার পুরোটাই ছিল তাঁর।

তাত্ত্বিকভাবে বলতে গেলে তিনি স্টয়িক (নিস্পৃহবাদী) ছিলেন। এ জন্য চার ধরনের গুণাবলি প্রয়োজন। যেমন প্রজ্ঞা, ন্যায়পরায়ণতা, প্রচণ্ড বেদনা ও বিরূপ অবস্থায় নির্ভার থাকা ও পরিমিতিবোধ। এর সব গুণই তাঁর ছিল। তাঁকে আমি স্টয়িক বলছি, কারণ, প্রচণ্ড বেদনা ও বিরূপ অবস্থায় নির্ভার থাকতেন তিনি। একবার তিনি জানালেন, আসতে দেরি হবে। কারণ, তাঁর ভাই অসুস্থ। দুপুরের পর তিনি অফিসে এলে আমি জিজ্ঞেস করি, বড় ভাইয়ের কী অবস্থা। তিনি জানান, দাফন করে এসেছেন।

কয়েক দিন আগে এক আলোচনায় সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেছেন, তাঁর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল গুরু-শিষ্য। কিছু বিষয় তিনি কাজেমীর কাছে শিখতেন, আবার কাজেমীকেও কিছু বিষয় শেখাতেন। আসলেই কাজেমী ছিল জ্ঞানের ভান্ডার।