Thank you for trying Sticky AMP!!

ধার করেই এখন সংসার চলছে

মো. সাইফুল ইসলাম

দূরপাল্লার বাসচালক মো. সাইফুল ইসলাম (৫৩) ঠিক সকাল সাড়ে ৬টায় রাজধানীর মহাখালী বাস টার্মিনালে গিয়ে পৌঁছান। ঢাকা-শেরপুর রোডে গাড়ি চালান তিনি। কিন্তু ৩০ মিনিট অপেক্ষা করার পর টার্মিনাল থেকে বেরিয়ে আসেন।

কারণ হিসেবে সাইফুল ইসলাম জানান, সরকার বলে দিয়েছে ৪০ সিটের বাসে ২০ জন যাত্রী তোলা যাবে। তাতেও কোনো অসুবিধা ছিল না। কিন্তু যাত্রী মাত্র ৩ জন। এ যাত্রীতে তো গাড়ির তেল খরচই উঠবে না। তাহলে চালক হিসেবে আপ-ডাউনে (যাওয়া-আসা) নিজের ৮০০ টাকা এবং হেলপার বা সহকারীর পাওনার কী হবে?

>অন্য অনেক চালকের মতো সাইফুলও গাড়ি চালাতে রোজ সকালে বাস টার্মিনালে যান
কিন্তু যাত্রী না পেয়ে হতাশা নিয়ে ফিরে আসেন

কেমন আছেন? জানতে চাইলে মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে সাইফুলের। চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারছিলেন না। শুধু বললেন, 'আপনাকে ধন্যবাদ দিই যে কেমন আছেন অন্তত জিজ্ঞাসা করছেন। কেউ তো জিজ্ঞাসাও করে না—কী খাচ্ছি, কী পরছি, বাড়িভাড়া দিতে পারছি কি না, ছেলেমেয়ের স্কুলের বেতন দিতে পারছি কি না। কেউ জানতেও চায় না, বাজার-সদাই করতে পারছি কি না।'


চাঁদপুর থেকে ১৯৮৮ সালে ঢাকায় এসে এখন পর্যন্ত গাড়ির সঙ্গেই আছেন বলে জানালেন সাইফুল। শুরুটা হেলপারি (চালকের সহকারী) করার মাধ্যমে। পরে চালক হয়েছেন। স্ত্রী আর দুই মেয়েকে নিয়ে মহাখালীর অদূরে নাখালপাড়ায় একটি ছোট্ট ভাড়া বাসায় থাকেন। মেয়েরা স্কুলে পড়ে।

সাইফুলের সঙ্গে কথা হয় গত বৃহস্পতিবার সকালে। তিনি বলেন, 'টিভিতে বড় বড় লোকদের বলতে দেখি অর্থনীতির চাকা ঘুরতে হবে। আমার কথা হচ্ছে, গাড়ির চাকা না ঘুরলে অর্থনীতির চাকা কেমনে ঘুরবে? বিদেশ থেকে মাল আনবেন, গাড়ি চলতে হবে। বিদেশে মাল পাঠাবেন, তাও ঘুরতে হবে গাড়ির চাকা। গাড়ির চাকা না ঘুরলে অর্থনীতির চাকা ঘুরবে না।'

চারদিকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ, গাড়ির চাকা কেমনে ঘুরবে? গাড়ি চালাতে গিয়ে জীবনই যদি না থাকে, তাহলে? প্রশ্নটা শুনে ঘুরে দাঁড়ান সাইফুল। বলেন, 'ভালো প্রশ্ন করেছেন। আমি অবশ্য সংক্রমণ বলি না। বলি আক্রমণ। কিন্তু সবই তো খোলা রাখলাম আমরা। বাজার খোলা, বড় বড় মার্কেট খোলা। অবশ্যই নিয়মকানুন মেনে চলা সবার দায়িত্ব। যাত্রীদের যেমন দায়িত্ব, আমাদেরও। কিন্তু সমস্যা তো অন্য জায়গায়। করোনাভাইরাসকে সারা দেশে আমরা ছড়িয়ে দিলাম কেন? এর জন্য দায়ী কে? বিদেশ থেকেই তো আসল! বন্দরগুলো কেন চেক দিলাম না?'

কথায় ক্ষোভ থাকলেও সাইফুল বিজ্ঞের মতোই উল্টো প্রশ্ন করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু প্রশ্নগুলো ছুড়ে দেওয়ার পরই গলা যেন ধরে আসে তাঁর। নিজের কথা শুরু করেন। সঙ্গে সব পরিবহন শ্রমিকের কথা। বললেন, দুটি মেয়েসহ স্বামী-স্ত্রী—চারজনের সংসার। জীবন টেনে নেওয়াই দায়, জমানো বলতে কিছু তো আর নেই। অকপটে বলেন, দুই মাস ধরে বাড়িভাড়া দেওয়াই কঠিন হয়ে গেছে। মাছ-মাংস খাওয়া বন্ধ হয়েছে এপ্রিল থেকেই।

আরও জানালেন, লজ্জায় তিনি অন্য পেশা ধরেননি। অথচ তাঁর মতো চালকেরাই এখন ভ্যান চালাচ্ছেন। কেউ বাড়ি বাড়ি গিয়ে তরকারি বিক্রি করছেন। টিকতে না পেরে কেউ ঢাকা শহর ছেড়ে গেছেন। অনেকে প্রায় অনাহারে আছেন। দেশের ৭০ লাখ পরিবহন শ্রমিক প্রায় একই অবস্থায় আছেন। তাঁদের জন্য এই করোনাভাইরাস দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতি এনে দিল।

সরকার যে ধান-চাল-নগদ টাকা দিচ্ছে, পাচ্ছেন না? এসব প্রশ্ন শুনে সাইফুল ইসলামের চোখে যেন আগুন। আড়াই হাজার টাকা করে নগদ পাব বলে ৬ হাজার ৫০০ জনের নাম লিখে নিয়েছে গত ঈদের আগেই। ২-৩ জনও পেয়েছেন কি না, সন্দেহ।

এই সময়ে চালক, চালকের সহকারী ও পরিবহন শ্রমিকদের মূল সমস্যা কী, আর সারা বছরের সমস্যা কী? জানতে চাইলে সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘এখন ধার করে চলছি। একজনের কাছ থেকে ধার করে কিছু টাকা এনেছিলাম। আরেকজন বলল তার বাচ্চাটা অসুস্থ। কিছু টাকা লাগবেই। কী আর করব। ধার করা টাকা থেকেই কিছু আবার ধার দিই তাকে। দেশজুড়েই আমাদের অবস্থা এখন এমন। এখন দরকার হচ্ছে পরিবহন শ্রমিকদের জন্য প্রত্যেক বাসস্ট্যান্ডে ১০ টাকা কেজিতে চাল দেওয়ার কর্মসূচি শুরু করা।

‘আর সব সময়ের জন্য যদি বলতে হয়, আমাদের জগৎটা সব সময়ই অবহেলিত। পদোন্নতি নেই, চিকিৎসার বন্দোবস্ত নেই, পেনশন নেই, এমনকি বয়স হলে চাকরিও নেই। আমাদের একজন নেতাকে আমরা মন্ত্রী হিসেবে পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, আমাদের জন্য কিছু করে যাবেন তিনি। অন্তত একটা জায়গায় দাঁড় করিয়ে যাবেন। কিন্তু করেননি।’ একদমে আক্ষেপ করতে করতে এসব কথা বলেন সাইফুল।

সাইফুল বলতে থাকেন, ‘আর কী করব। কাল সকালে আবার বাস টার্মিনালে যাব। যাত্রী বেশি না থাকলে মন খারাপ করে বাসায় ফিরব। চলার জন্য আবার হয়তো কারও কাছে হাত পাতব। করোনাভাইরাস না যাওয়া পর্যন্ত এভাবেই কাটবে দিন। একসময় হয়তো ধারও পাব না। স্ত্রী ও মেয়েদের সামনে তখন লজ্জামাখা মুখ নিয়ে দাঁড়াতে পারব কি না, সেই আশঙ্কায় জীবন কাটছে।’