Thank you for trying Sticky AMP!!

নতুন নেতৃত্ব নিয়ে এবার পথচলা

ব্র্যাক

বিশ্বের সবচেয়ে বড় এনজিও (বেসরকারি সংস্থা) ব্র্যাকের নেতৃত্বে পরিবর্তন এল। এ দেশে ব্যবসা, সমাজসেবা এবং রাজনীতিনির্বিশেষে কোথাও শীর্ষ নেতৃত্বে খুব একটা পরিবর্তন আসে না। নিয়মতান্ত্রিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে একটি বড় প্রতিষ্ঠানে কীভাবে নেতৃত্বে পরিবর্তন আনতে হয়, তা এবার দেখিয়ে দিল ব্র্যাক।

ব্র্যাকের চেয়ারপারসন স্যার ফজলে হাসান আবেদ গত আগস্ট মাসে স্বেচ্ছায় তাঁর দায়িত্ব ছেড়েছেন। তাঁর জায়গায় সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান দায়িত্ব নিয়েছেন। আর ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারপারসনের দায়িত্ব পেয়েছেন জাতিসংঘের সাবেক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল আমিরা হক। তবে স্যার ফজলে হাসান আবেদ চেয়ার ইমেরিটাসের দায়িত্ব পালন করবেন। ১৯৭২ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তিনি ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পেয়েছেন আসিফ সালেহ। তিনি ব্র্যাকের এনজিও কার্যক্রমের দেখাশোনা করবেন। এর আগে তিনি জ্যেষ্ঠ পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১১ সাল থেকে তিনি ব্র্যাকে আছেন। এ ছাড়া ব্র্যাকের জ্যেষ্ঠ পরিচালক তামারা আবেদের পদোন্নতি হয়েছে। তিনি ব্র্যাকের (এন্টারপ্রাইজ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক হয়েছেন। তিনি ব্র্যাকের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনার মূল দায়িত্বে আছেন। ২০০২ সালে তিনি ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠান আড়ংয়ের মহাব্যবস্থাপক (নকশা ও পণ্য উন্নয়ন) হিসেবে কাজ শুরু করেন। দুজনই গত ১ আগস্ট থেকে নতুন পদে স্থলাভিষিক্ত হন। সর্বশেষ গত ২২ সেপ্টেম্বর তামারা আবেদকে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এত দিন এই দায়িত্বে ছিলেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ।

গত মে মাসে ব্র্যাকের (ইন্টারন্যাশনাল) নির্বাহী পরিচালক হয়েছেন মোহাম্মদ মুসা। তিনি সংস্থাটিতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন।

এদিকে এ বছর ব্র্যাকের পরিচালনা পর্ষদে নিয়মিত পরিবর্তন এসেছে। পর্ষদে নতুন সদস্য হয়েছেন আইরিন খান, সফিকুল হাসান, ফওজিয়া রশিদ, মেলিসা পার্ক, কায়সার জামান ও ফাতিমা দাদা।

যেভাবে নেতৃত্ব পরিবর্তন
২০১৮ সালের জুন মাসে ব্র্যাকের শীর্ষ নেতৃত্ব পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। সংস্থাটির নীতিনির্ধারকেরা চেয়েছেন, ব্র্যাক যেন থমকে না দাঁড়ায়, কর্মকাণ্ড যেন সমসাময়িক বিষয়ে প্রাসঙ্গিক থাকে। তাঁরা খুঁজে পেয়েছেন, বিশ্বে ৫০০ বছর ধরে ৩২টি প্রতিষ্ঠান টিকে আছে। এর মধ্যে ২৯টি বিশ্ববিদ্যালয়, দুটি চার্চ এবং একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।

ব্র্যাকের ভবিষ্যৎমুখী নেতৃত্ব আনার উদ্যোগে পরামর্শ নিতে গত বছর ডালভার্ট অ্যাডভাইজরি গ্রুপ নামের একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এ প্রতিষ্ঠান সরকার, অংশীজন, অন্য এনজিও, উন্নয়ন সহযোগী—সবার সঙ্গে পরিবর্তন বিষয়ে আলোচনা করে। এ বছরের মে মাসে সাভারে ব্র্যাকের শীর্ষ ব্যক্তিরা তিন দিনব্যাপী বৈঠকে বসেন। সেখানে ডালভার্ট অ্যাডভাইজরি গ্রুপের সুপারিশগুলো নিয়ে আলোচনা হয়। ওই বৈঠকেই নেতৃত্ব পরিবর্তনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসে।

ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। কিন্তু প্রবৃদ্ধির সুফল সবার কাছে পৌঁছাচ্ছে না। অথচ এই দেশে এখন জনসংখ্যা বোনাসের যুগ চলছে। এখানে বিপুলসংখ্যক কর্মক্ষম তরুণ-তরুণী আছে। বাজারের চাহিদা অনুযায়ী তাদেরকে দক্ষ কর্মী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এ জন্য এই তরুণ জনগোষ্ঠীর জন্য ব্র্যাক আরও বিনিয়োগ করতে চায়।

বিশ্বের এক নম্বর এনজিও
ব্র্যাক এখন বিশ্বের এক নম্বর এনজিও। মানবকল্যাণে ভূমিকা রাখার জন্য গত ফেব্রুয়ারি মাসে সুইজারল্যান্ডের জেনেভাভিত্তিক সংস্থা এনজিও অ্যাডভাইজার এ সম্মাননা দিয়েছে। পরপর চার বছর এমন সম্মাননা পেল ব্র্যাক। এ বছর দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে আছে যথাক্রমে সুইজারল্যান্ডের ডক্টর উইদাউট বর্ডার ও ডেনমার্কের ড্যানিশ রিফিউজি কাউন্সিল। শীর্ষ ২০টি এনজিওর মধ্যে আছে সেভ দ্য চিলড্রেন, অক্সফাম ও অশোকার মতো নামজাদা এনজিওগুলো।

ইতিহাস ও পথচলা
১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে দুস্থ ও বিপন্ন মানুষজনকে সহায়তা করার মানবিক তাড়না থেকে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথমে সুনামগঞ্জের ভাটি অঞ্চল শাল্লা-দিরাইয়ের সহায়-সম্বলহীন ছিন্নমূল মানুষের পাশে দাঁড়ায় ব্র্যাক। সেই থেকে যাত্রা শুরু। এরপর সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে কেবল ওপরে ওঠা।

১৯৭২ সালে রাজধানীর মতিঝিলে ব্যারিস্টার ভিকারুল ইসলাম চৌধুরীর আইন ব্যবসার কার্যালয়টি ছিল ব্র্যাকের প্রথম অস্থায়ী কার্যালয়। এখন রাজধানীর মহাখালীতে সুরম্য অট্টালিকায় ব্র্যাকের প্রধান কার্যালয়। দেশের প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নেই ব্র্যাকের নিজস্ব কার্যালয় আছে। সংস্থাটি দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে।

খাওয়ার স্যালাইন: জাদু দেখিয়েছে ব্র্যাক
একমুঠো গুড়, এক চিমটি লবণ আর আধা সের পানি—দিলাম ঘুঁটা। হয়ে গেল খাওয়ার স্যালাইন। আশির দশকের এই কথাগুলো বেশ জনপ্রিয় ছিল। এই জনপ্রিয় স্বাস্থ্যসেবার কৌশল সারা দেশে ছড়িয়ে দিয়েছিল ব্র্যাক। ডায়রিয়ার প্রকোপ কমাতে খাবার স্যালাইন বানানোর কর্মসূচিটি ব্র্যাকের অন্যতম সফল একটি কার্যক্রম। সত্তরের দশকে শিশু মৃত্যুর হার অনেক বেশি ছিল। এর অন্যতম কারণ ছিল ডায়রিয়া। ১৯৬৮ সালে তৎকালীন ঢাকার কলেরা রিসার্চ ল্যাবরেটরি (বর্তমানে আইসিডিডিআরবি) খাওয়ার স্যালাইন উদ্ভাবন করেছিল। আর ব্র্যাক সেই স্যালাইন বানানোর কৌশল বা প্রশিক্ষণ দেশের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছিল। প্রতি পরিবারের মাকে স্যালাইন বানানোর কৌশল শেখানো হয়েছিল। ১৯৭৯ সালে সুনামগঞ্জের শাল্লায় ওরাল থেরাপি প্রোগ্রামের (ওটিপি) মাধ্যমে ক্ষুদ্র পরিসরে ব্র্যাকের খাওয়ার স্যালাইন কর্মসূচি পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হয়। ব্র্যাক সিদ্ধান্ত নিল লবণ-গুড়ের খাওয়ার স্যালাইন বানানোর প্রশিক্ষণ দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া হবে। পরের ১০ বছরে তা মহাকর্মযজ্ঞে পরিণত হয়। বাড়ি বাড়ি গিয়ে মায়েদের খাওয়ার স্যালাইন বানানোর কৌশল শেখানোর মহিলা কর্মী নিয়োগ দেওয়া হলো। দেশের সব মাকে স্যালাইন বানানো শেখাতে সময়সীমা নির্ধারণ করা হলো ১০ বছর। ১৯৮০ সালের জুলাই মাসে বৃহত্তর সিলেট, ফরিদপুর, যশোর, খুলনা ও কুষ্টিয়া জেলায় এই কর্মসূচি শুরু হয়। এই কর্মসূচির আওতায় পরের ১০ বছরে বৃহত্তর ২১টি জেলার মধ্যে ২০টি জেলায় ১ কোটি ১৭ লাখ ৯২ হাজার ৬৫৪টি পরিবারে ডায়রিয়া প্রতিরোধক স্যালাইন তৈরির প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। ৪২৩টি উপজেলার ৪ হাজার ২৫৪টি ইউনিয়নের ৭৫ হাজার ৯৯২টি গ্রামে এই কর্মসূচি পৌঁছেছিল। যাতায়াত ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে এই কর্মসূচি পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। সার্বিকভাবে দেশের ৯৮ শতাংশ পরিবার খাওয়ার স্যালাইন বানানোর কৌশল শেখাতে পেরেছিল, যা এই প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম বড় সাফল্য। ঘরে বসেই ডায়রিয়া প্রতিরোধ করার জাদু দেখিয়েছিল ব্র্যাক।

স্বীকৃতি

স্যার ফজলে হাসান আবেদ ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত ব্র্যাক বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পেয়েছেন অসংখ্য। গুরুত্বপূর্ণ কিছু স্বীকৃতির তথ্য এখানে দেওয়া হলো:

স্যার ফজলে হাসান আবেদ

-শিক্ষা উন্নয়নে সর্বোচ্চ স্বীকৃতি ইদান পুরস্কার (২০১৯), স্প্যানিশ অর্ডার অব সিভিল মেরিট (২০১৫), লিও টলস্টয় ইন্টারন্যাশনাল গোল্ড মেডেল (২০১৪), নাইট কমান্ডার অব দি মোস্ট ডিশটিংগুইশড অর্ডার অব সেন্ট মাইকেল অ্যান্ড সেন্ট জর্জ (কেসিএমজি) বা স্যার উপাধি (২০১০) ও র‌্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার (১৯৮০)

ব্র্যাক

-স্বাধীনতা পুরস্কার (২০০৭), কনরাড এন হিলটন হিউম্যানিটারিয়ান প্রাইজ (২০০৮), গ্লাক্সোস্মিথক্লাইন অ্যান্ড সেভ দ্য চিলড্রেন হেলথকেয়ার ইনোভেশন অ্যাওয়ার্ড (২০১৩), ওয়ার্ল্ড জাস্টিস ইনোভেশন অ্যাওয়ার্ড (২০১৫) ও ওএফআইডি অ্যানুয়েল অ্যাওয়ার্ড ফল ডেভেলপমেন্ট (২০১৮)।