Thank you for trying Sticky AMP!!

পানিতে ভর্তুকির ৩২ শতাংশই পায় অতিধনীরা

বাংলাদেশে গ্রাহক পর্যায়ে পানি সরবরাহের জন্য সরকার প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ ভর্তুকি দেয়। কিন্তু এই ভর্তুকির সুবিধা গরিব মানুষের চেয়ে ধনীদের কাছেই বেশি যায়। বাংলাদেশ প্রতিবছর পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন খাতে যত টাকা ভর্তুকি দেয়, এর ৩২ শতাংশ সুবিধাই পায় অতিধনী ১০ শতাংশ পরিবার। আর সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশ পরিবারের কাছে যায় মাত্র আড়াই শতাংশ টাকা।

বিশ্বব্যাংকের ‘ডুয়িং মোর উইথ লেস স্মার্টার সাবসিডিজ ফর ওয়াটার সাপ্লাই অ্যান্ড স্যানিটেশন’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে এসব তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটি গত ২৮ আগস্ট প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। ওই প্রতিবেদনে বিশ্বের ক্রমবর্ধমান নিম্ন ও মধ্যম আয়ের ১০টি দেশের তুলনা করা হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, পানি সরবরাহে ভর্তুকির অপব্যবহারে ওই ১০টি দেশের মধ্যে পঞ্চম স্থানে আছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে সবচেয়ে ধনী ২০ শতাংশের কাছে ভর্তুকির অর্ধেক টাকা চলে যায়। আর সবচেয়ে গরিব ২০ শতাংশের কাছে যায় মাত্র সাড়ে ৪ শতাংশ ভর্তুকির টাকা।

বিশ্বব্যাংকের ওই তালিকার শীর্ষ স্থানে আছে আফ্রিকার দেশ নাইজার। ওই দেশের সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ পরিবারের কাছে চলে যায় সুপেয় পানি সরবরাহের জন্য সরকারের দেওয়া ভর্তুকির ৭০ শতাংশ অর্থ। দ্বিতীয় স্থানে থাকা উগান্ডায় এই হার ৬৯ শতাংশ। তাই ভর্তুকির অর্থ ন্যায্যতা ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে খরচের সুপারিশ করেছে বিশ্বব্যাংক।

জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে পানির মূল্যের ওপর ভর্তুকি দেওয়া হয়। পাইপের মাধ্যমে যে পানি সরবরাহ করা হয়, তা ধনীরা বেশি পায়। তারা বেশি পানি ব্যবহার করার সুযোগ পায়। তাই পানিতে ভর্তুকির সুবিধা ধনীরা বেশি পায়। অন্যদিকে গরিব মানুষ, বিশেষ করে বস্তিতে যারা থাকে, তারা পর্যাপ্ত পানি পায় না। তারা অবৈধ সংযোগের মাধ্যমে সরবরাহ করা পানি ব্যবহার করে। এ কারণে বাজারদরের চেয়ে দুই থেকে আড়াই গুণ বেশি খরচ করে তাদের ওই পানি কিনতে হয়। তিনি সুপারিশ করেন, গরিবদের পানি কেনার জন্য বিশেষ সহায়তা দেওয়া যেতে পারে, যাতে তারা বাজারদরে পানি কিনতে পারে।

বিনিয়োগ ও ভর্তুকি

সুপেয় পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে নানা ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প নেয় সরকার। এর উদ্দেশ্য, সমাজের সব শ্রেণির পাশাপাশি পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়া। কিন্তু প্রকল্পগুলো এমনভাবে বাস্তবায়ন করা হয়, যাতে ধনী পরিবারগুলো সুবিধা বেশি পায়। আবার পাইপলাইনের মাধ্যমেও এ দেশে রাজধানীসহ বড় শহরগুলোতে পানি সরবরাহ করা হয়। সেখানেও ভর্তুকি দেয় সরকার। বিশ্বব্যাংক বলছে, বাংলাদেশে ৯৫ শতাংশের বেশি পানি সরবরাহে ভর্তুকি দেয় সরকার।

ঢাকা ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে এক হাজার লিটার (এক ইউনিট) পানির দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১১ টাকা ৫৭ পয়সা। এর উৎপাদন খরচ ১৭ টাকার বেশি। এ ক্ষেত্রে প্রতি এক হাজার লিটার পানিতে সরকার সাড়ে ছয় টাকার মতো ভর্তুকি দেয়। পাইপলাইনের মাধ্যমে পানি সরবরাহের জন্য দেওয়া এই সুবিধার সিংহভাগই ধনীরা পায়।

শহর ও গ্রামীণ এলাকায় পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে বর্তমানে সাড়ে ৪১ হাজার কোটি টাকার ৪৩টি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এর মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনায় ওয়াসার প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকার ১৩টি প্রকল্প চলছে। এ প্রকল্পগুলোর সুবিধা মূলত শহরের ধনীরাই পাবে। আর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের ৩০টি প্রকল্পে পৌরসভা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা খরচ হচ্ছে।

নিরাপদ পানি ব্যবস্থাপনায় ভর্তুকির অর্থের অপব্যবহারে বাংলাদেশের চেয়ে খারাপ অবস্থা উগান্ডার। কিন্তু বাংলাদেশ এখন সেই উগান্ডার কাছ থেকেই শিখতে চায়! তাই তো পানি ব্যবস্থাপনা দেখতে সম্প্রতি চট্টগ্রাম ওয়াসার একটি প্রকল্পের ৪১ জন সরকারি কর্মকর্তা উগান্ডায় গেছেন। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকার ‘চিটাগং ওয়াটার সাপ্লাই ইমপ্রুভমেন্ট অ্যান্ড স্যানিটেশন প্রজেক্ট’ (সিডব্লিউএসআইএসপি) বাস্তবায়নের কাজ করছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। এ প্রকল্পের অধীনে ‘ওয়াসার সক্ষমতা বাড়াতে’ পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে উগান্ডার ন্যাশনাল ওয়াটার অ্যান্ড সুয়ারেজ করপোরেশন। এগুলো তো সরকারি অর্থ অপচয় বা অপব্যয়ের একটি বড় নজির।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন

সারা বিশ্বে প্রতিবছর ৩২ হাজার কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ পানি সরবরাহে ভর্তুকি দেওয়া হয়। বিশ্বব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে ১০টি দেশের পানি সরবরাহে ভর্তুকির অপব্যবহারের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ধনীদের কাছে ভর্তুকির অর্থ বেশি যায়—এই বিবেচনায় বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে আছে নাইজার, উগান্ডা, ইথিওপিয়া ও মালি। বাংলাদেশের পেছনে আছে নাইজেরিয়া, জ্যামাইকা, এল সালভাদর, পানামা ও ভিয়েতনাম।

বিশ্বব্যাংক বলছে, ওই ১০ দেশে নিরাপদ পানি সরবরাহে যত অর্থ ভর্তুকি দেওয়া হয়, এর ৫৬ শতাংশ যায় ওই সব দেশের ধনী ২০ শতাংশ মানুষের কাছে। আর মাত্র ৬ শতাংশ অর্থ যায় সবচেয়ে গরিব ২০ শতাংশের কাছে। বিশ্বব্যাংকের মতে, নাইজার ও উগান্ডার সবচেয়ে গরিব ৩০ শতাংশের কাছে রাষ্ট্রীয়ভাবে পানি সরবরাহ করা হয়ই না। তারা ভর্তুকির কোনো সুবিধা পায় না। ওই দুটি দেশের সবচেয়ে ধনী ২০ শতাংশের কাছে যায় যথাক্রমে ৯৫ ও ৯১ শতাংশ ভর্তুকির অর্থ। অন্যদিকে ইথিওপিয়া ও মালির সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশের পেছনে ভর্তুকির ৫৭ ও ৫৬ শতাংশ অর্থ খরচ হয়।

বিশ্বব্যাংকের পানিবিষয়ক পরিচালক জেনিফার সারা প্রতিবেদনটিতে বলেন, পানি ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনায় ভর্তুকির অর্থ গরিবের কাছে পৌঁছায় না। এই ভর্তুকির অর্থের প্রায় পুরোটাই ধনী পরিবারগুলোর কাছে চলে যায়। এর ফলে গরিব পরিবারগুলো প্রয়োজনীয় নিরাপদ পানি পায় না। এতে বৈষম্য আরও বাড়ে।