Thank you for trying Sticky AMP!!

পারিবারিক খ্যাতি অপব্যবহার করে যেভাবে শীর্ষ নারী ধনী

ইসাবেলা দস সান্তোস

বিশ্বকে তিনি বুঝিয়েছিলেন, নিজের চেষ্টায় পুরোপুরি একক পরিশ্রমে ধীরে ধীরে এক বিশাল সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। হয়েছেন আফ্রিকার শীর্ষ নারী ধনী। গৃহযুদ্ধ ও দারিদ্র্যে জর্জরিত অ্যাঙ্গোলার মতো একটি আফ্রিকান দেশে পুরুষশাসিত ব্যবসায়িক পরিমণ্ডলে থেকে তাঁর এই সাফল্য ঈর্ষা জাগালেও গর্বেরও ছিল। বলছি আফ্রিকার শীর্ষ ধনী নারী ইসাবেল দস সান্তোসের কথা।

সবার মতো নিজের সাফল্যে গর্বিত ইসাবেলও। ‘আমি দীর্ঘদিন ধরে সংস্থাগুলো পরিচালনা করে আসছি, ছোট থেকে শুরু করে, তাদের গড়ে তুলছি, একটি সংস্থাকে সফল করতে যা লাগে, সে রকম প্রতিটি স্তরের মধ্য দিয়ে গিয়েছি’—এমন কথায় গর্বই ফুটে ওঠে তাঁর কণ্ঠে। তবে এখন ধীরে ধীরে ফাঁস হচ্ছে গুমর।

অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট (আইসিআইজে) ‘পানামা পেপারস’ ফাঁসের মাধ্যমে ২০১৬ সালে হইচই ফেলে দেয়। এবার তারা সাত লক্ষাধিক তথ্য ফাঁস করেছে। যেটার নাম দেওয়া হয়েছে ‘লুয়ান্ডা লিকস’। এর মাধ্যমে এবার আফ্রিকার এই ধনকুবের নারী ইসাবেলের দুর্নীতি ও কেলেঙ্কারির তথ্য ফাঁস হয়ে গেছে। বর্তমানে অ্যাঙ্গোলার সরকার সেসব সম্পদের খোঁজখবর করতে শুরু করেছে।

কে এই ইসাবেল

ইসাবেলের বাবা হোসে এদুয়ার্দো দস সান্তোস ছিলেন আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলীয় দেশ অ্যাঙ্গোলার প্রেসিডেন্ট। ১৯৭৯ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত অ্যাঙ্গোলার ক্ষমতায় ছিলেন তিনি। বিশ্বের ইতিহাসে অন্যতম দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকা স্বৈরশাসক হোসে এদুয়ার্দো। আর বাবার সাহায্যেই অ্যাঙ্গোলার জায়ান্ট তেল কোম্পানি সোনাঙ্গোল গ্রুপের প্রধান হন ইসাবেল। বছরের পর বছর ধরে এই সংস্থার মাধ্যমে কর সুবিধা, টেলিকম লাইসেন্স এমনকি হীরা-খনির অধিকার নিয়ে এসেছেন ইসাবেল। 

৪৬ বছর বয়সী ইসাবেল দস সান্তোসের জন্ম তেলসমৃদ্ধ দেশ আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে। সেখানকার স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন তাঁর বাবা ও মা। সেখানেই পরিচয়, সেখানেই প্রণয়। ইসাবেলের মা রাশিয়ান তাতিয়ানা কুকানোভা ভূতত্ত্ব বিষয়ে পড়াশোনা করতেন। অন্যদিকে ইসাবেলের বাবা, ভবিষ্যৎ অ্যাঙ্গোলার প্রেসিডেন্ট, কমরেড নম্বর ওয়ান, অ্যাঙ্গোলার মুক্তি আন্দোলনের জনপ্রিয় নির্বাসিত গেরিলা নেতা। ১৯৭৫ সালে পর্তুগাল তার পুরো আফ্রিকান উপনিবেশকে স্বাধীনতা দিয়ে দেয়। সে সময় দেশে ফিরে আসেন ইসাবেলের বাবা হোসে এদুয়ার্দো। অ্যাঙ্গোলার কুকানোভা সদ্য গঠিত এবং সোনাঙ্গোলে কাজ শুরু করেন। সে সময় মায়ের কোলে করে সেখানে যেতেন ইসাবেল।

কীভাবে এত সম্পদ 

আফ্রিকার অন্যতম দরিদ্র দেশ অ্যাঙ্গোলার মূল সমস্যা দুর্নীতি। দেশটির গড় আয়ু মাত্র ৬০ বছর। এবং প্রায় ৫ শতাংশ শিশু তাদের প্রথম জন্মদিনের আগেই মারা যায়। এমন একটি দেশে ইসাবেল, তাঁর স্বামী এবং তাঁদের সহযোগী আরও কয়েকজন ব্যক্তি মিলে ৪০০ কোম্পানি, বিভিন্ন দেশের ৪১টি সহযোগী সংগঠন নিয়ে একটি ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। এর মধ্যে মাল্টা, মরিশাস, হংকংয়ের মতো দেশে অনেক গোপন সংস্থা রয়েছে। এক দশক ধরে এসব কোম্পানির মাধ্যমে পরামর্শমূলক কাজ, ঋণ, গণপূর্ত চুক্তি করে অ্যাঙ্গোলা সরকারের কাছ থেকে বিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নেয় তারা। সেসব অর্থ আবাসন খাত, শক্তি এবং মিডিয়া ব্যবসায় বিনিয়োগ করতেন। ভূমি, তেল, হীরা, টেলিকম ব্যবসার নেমে ইসাবেল ও তাঁর স্বামী দেশের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। আইসিআইজের তদন্তে দেখা গেছে, দস সান্তোস কোম্পানির পুনর্বাসন প্রকল্পের অংশ হিসেবে হাজার হাজার পরিবারকে জোর করে তাদের লুয়ান্ডা জমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল।

বাবার প্রভাব খাটিয়ে

হোসে এদুয়ার্দোর দল দ্য পিপলস মুভমেন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব অ্যাঙ্গোলা (এমপিএলএ) ক্ষমতায় আসে ১৯৭৯ সালে। এ সময় অ্যাঙ্গোলান দলগুলোর মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। সিমেন্ট কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ নিজের কাছে নিয়ে নেন প্রেসিডেন্ট এদুয়ার্দো। এমনকি তেল কোম্পানি সোনাঙ্গোলের ওপরও একনায়ক ক্ষমতা প্রয়োগ করেন তিনি। তেল সংস্থাটি রপ্তানি ও অ্যাঙ্গোলান অর্থনীতির স্তম্ভ হয়ে ওঠে। মোট রপ্তানি আয়ের ৯০ শতাংশের বেশি হিস্যা ছিল এই তেল কোম্পানির। রাস্তা, সেতু, খাদ্য আমদানি এবং সামরিক সরঞ্জামাদি—সবকিছুই আসছিল এটি দিয়ে।

দেশের নায়ক হলেও পারিবারিক জীবনে ভাঙন আসে হোসে এদুয়ার্দোর। স্ত্রী কুকানোভার সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ হয়। সন্তানদের নিয়ে লন্ডনে চলে যান কুকানোভা। জীবনের কৈশোর সময়টা লন্ডনেই কাটান ইসাবেল। পরে লন্ডনের কিংস কলেজ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি নেন।

১৯৯২ সালে প্রেসিডেন্ট হোসে এদুয়ার্দো দস সান্তোস অ্যাঙ্গোলার সংবিধান পরিবর্তন করেন। এতে বলা হয়, ঘুষ বা বিশ্বাসঘাতকতার ঘটনা ব্যতীত রাষ্ট্রপতিকে কোনো সরকারি পদক্ষেপের মাধ্যমে অপসারণ করা যাবে না। তিনি এমনভাবে দেশ চালাতেন মনে হতো, এটি যেন তাঁর পারিবারিক সম্পত্তি, ব্যক্তিগত ব্যবসা। আর এতে সবচেয়ে লাভবান হতেন তাঁর বড় মেয়ে।

১৯৯৯ সালে অ্যাঙ্গোলান হীরা বাজারজাত করার একচেটিয়া লাইসেন্স নিয়ে অ্যাঙ্গোলা সেলিং করপোরেশন প্রতিষ্ঠা করেন প্রেসিডেন্ট। দেশের অর্থনীতির আরেক স্তম্ভ ছিল এটি। পরে তিনি একটি আলাদা কোম্পানি করে দেন ইসাবেল ও তাঁর মাকে। অ্যাঙ্গোলা সেলিং করপোরেশনের সাড়ে ২৪ শতাংশ শেয়ার ছিল ওই কোম্পানির। এক বছর পরে সরকার ইউনিটেল নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়। যেটি ছিল দেশের প্রথম ও বৃহত্তম টেলিকমিউনিকেশন প্রতিষ্ঠান। এটির মালিক এবং প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে ছিলেন ইসাবেল। দেশের বৃহত্তম মোবাইল ফোন সরবরাহকারী ইউনিটেলের ২৫ শতাংশ শেয়ার নেন ইসাবেল।

২০০২ সালের ডিসেম্বরে কঙ্গোর ধনাঢ্য ব্যবসায়ী সিনদিকা দোকোলাকে বিয়ে করেন ২৯ বছর বয়সী ইসাবেল। ৩০ বছর বয়সী দোকোলা ছিলেন খুবই বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত। বিয়ের পর স্ত্রীর সঙ্গে ব্যবসায় যুক্ত হন দোকোলা।

বাবার মাধ্যমে ভালো সম্পর্ক গড়ে তোলেন পর্তুগিজ ধনকুবের আমেরিকো অ্যামোরিমের সঙ্গে। ২০০৫ সালে এই দুজন মিলে প্রতিষ্ঠা করেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বানকো বিআইসি এসএ ব্যাংক। এটি
বর্তমানে অ্যাঙ্গোলার সবচেয়ে বড় ব্যাংক।

 ২০০৫ সালে অ্যামোরিমের সঙ্গে একটি চুক্তি করেন ইসাবেল। ওই চুক্তি অনুসারে তিনি ও তাঁর স্বামী খুবই কম দামে একটি এনার্জি কোম্পানির শেয়ার কিনে নেন। পরে তাঁরা দুজন একটি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট বাবার বদৌলতে সোনাঙ্গোলের দায়িত্ব পান ইসাবেল।

 সোনাঙ্গোলের ব্রিটিশ সাবসিডিয়ারির মাধ্যমে একটি সন্দেহজনক চুক্তি লন্ডন থেকে সম্পন্ন করেন ইসাবেল। সেটি ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় অঙ্কের দুর্নীতি। তবে ২০১৭ সালে বাবা প্রেসিডেন্ট পদ থেকে অবসর গ্রহণ করলে ইসাবেল আর বেশি দিন সোনাঙ্গোলের প্রধান হিসেবে থাকতে পারেননি। দুই মাসের মধ্যেই তাঁকে বরখাস্ত করা হয়। 

ইসাবেলের পর্দা কেলেঙ্কারির খবরও ফাঁস করে আইসিআইজে। পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে নিজের ডুপ্লেক্স বাড়িটি একবার সাজাতে ইসাবেল খরচ করেন ২৫ লাখ মার্কিন ডলার। ওই বাড়ির পর্দা কিনতেই ব্যয় করা হয় ৫০ হাজার ডলার।